বিক্রমকে ‘জেরা করে পাওয়া’ তথ্য
রঞ্জিত-অনিতার খোঁজে নামবে সিআইডি
নানা নাশকতায় অভিযুক্ত মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াড কার্যত ‘ছত্রভঙ্গ’ হয়ে গিয়েছে। দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে গিয়েছেন একাধিক স্কোয়াড-সদস্য। ধরা পড়া মাওবাদী নেতা বিক্রম ওরফে অর্ণব দামকে ‘জেরা করে পাওয়া’ তথ্যের ভিত্তিতে এমনই দাবি করছে সিআইডি। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই স্কোয়াডে বিক্রমের ‘ছায়াসঙ্গী’ বলে পরিচিত আর এক মাওবাদী নেতা রঞ্জিত পালের হদিস পাওয়ারও চেষ্টা চলছে।
সিআইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, নিজের স্ত্রী, নন্দীগ্রামের মেয়ে অনিতাকে (অযোধ্যা স্কোয়াড সদস্য) নিয়ে রঞ্জিত মুম্বইয়ে চলে গিয়েছেন বলে গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন বিক্রম। তাঁকে জেরা করে অযোধ্যা স্কোয়াডের অন্য সদস্যদের ব্যাপারেও প্রাথমিক কিছু তথ্য মিলেছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। সিআইডি-র এক কর্তা বলেন, “রঞ্জিত পাল-সহ অন্য মাওবাদীদের খোঁজ শুরু করার তোড়জোড় চলছে।”
কে এই রঞ্জিত?
রঞ্জিত পাল
মাওবাদীদের অযোধ্যা স্কোয়াডে বিক্রমের পরেই আসে রঞ্জিতের নাম। পুলিশের দাবি, পশ্চিম মেদিনীপুরে যেমন শশধর মাহাতো ছিলেন ‘ঠান্ডা মাথায় খুন’ করায় পারদর্শী, বাঁকুড়ার বারিকুল থানার খেজুরখেন্না গ্রামের বাসিন্দা রঞ্জিত পালও তাই। শশধর যৌথ বাহিনীর গুলিতে নিহত। রঞ্জিত আজও অধরা। স্কোয়াডে নানা নামে পরিচিত তিনি। প্রথম দিকে সিরাজ ও তড়িৎ, রানিবাঁধে রাহুল, দলমা ও অযোধ্যা স্কোয়াডে নিতিন বা প্রভাতজী। বিক্রম ধরা পড়ার পরে বন্ধের ঘোষণা সংবলিত চিঠিতে যে রাকেশের নাম ছিল, সেটিও আদতে রঞ্জিতের বলে গোয়েন্দাদের ধারণা।
২০০৩ সালে বান্দোয়ানের ওসি নীলমাধব দাস বা ২০০৬-এ বারিকুল থানার ওসি প্রবাল সেনগুপ্তকে খুন করা থেকে শুরু করে ২০১০-এর অক্টোবরে অযোধ্যা পাহাড়ে গোয়েন্দাকর্মী পার্থ বিশ্বাস এবং স্কুলশিক্ষক সৌম্যজিৎ বসুর গুমখুনএমন সব বড় নাশকতায় বছর পঁয়ত্রিশের এই মাওবাদী স্কোয়াড নেতার নাম জড়িয়ে। ২০০৭-এ ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলায় ফুটবল ম্যাচ চলাকালীন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সাংসদ সুনীল মাহাতোকে হত্যা করা কিংবা ২০১০-এর ডিসেম্বরে পুরুলিয়ার বাগবিন্ধ্যায় এক রাতে ৭ জন খুনেও অন্যতম অভিযুক্ত এই রঞ্জিত। অযোধ্যা পাহাড়তলির বিভিন্ন গ্রামে বাম নেতা-কর্মী এবং তৃণমূল কর্মী খুনে নেতৃত্ব দেওয়ায় অভিযোগও রয়েছে রঞ্জিতের বিরুদ্ধে। গত ১৫ নভেম্বর রাতে বলরামপুরের খুনটাঁড় গ্রামে রঞ্জিতের নেতৃত্বেই এক তৃণমূলকর্মীর বাবা ও ভাইকে খুন করে মাওবাদীরা বলে অভিযোগ। শুধু বারিকুল থানায় তাঁর বিরুদ্ধে ৮-১০টি নাশকতার মামলায় পরোয়ানা রয়েছে।১৯৯৮ সালে যখন ঘর ছেড়েছিলেন, তখন তিনি বারিকুল হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে বড় রঞ্জিত প্রথমে মাওবাদীদের গণমুক্তি গেরিলা ফৌজে যোগ দেন বনমালী দেশওয়ালির হাত ধরে। স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন লোকের গলা নকল করতে পারতেন বলে হরবোলা বলে তাঁর পরিচিতি ছিল। ২০০১-এ রানিবাঁধ থানার পুলিশ তাঁকে প্রথমবার ধরে। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর থেকে পুলিশ আর তাঁর হদিস পায়নি। পুলিশ সূত্রের খবর, দলমা ও ঘাটশিলা স্কোয়াডে কাজ করার পরে ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনের সময় সেখানে ছিলেন রঞ্জিত। আবার ২০০৯-এ পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে হওয়া আন্দোলনের সময় লালগড়ে আসেন। কিন্তু সেখানে মাওবাদী নেতত্বের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তাঁকে পাঠানো হয় অযোধ্যা স্কোয়াডে। একে-৪৭, এসএলআর, এলএমজি থেকে থ্রি-নট-থ্রি, সব ধরনের বন্দুক চালানোয় সমান দক্ষ এই মাওবাদী নেতা পাহাড়ে ‘মিলিটারি কমিশনের’ দায়িত্বে ছিলেন। স্ত্রী অনিতাও নানা নাশকতায় জড়িত থাকায় অভিযুক্ত।
এহেন মাওবাদী দম্পতিকে ধরতে পারাটা বড় চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করছেন গোয়েন্দারা।
সিআইডি সূত্রের খবর, জেরায় বিক্রম তাদের জানিয়েছেন, গত বছর মে মাসে রাজ্য রাজনৈতিক পালাবদলের পরেই মাওবাদীদের সংগঠনে ‘ভাঙন’ ধরতে থাকে। দলের নেতাদের একাংশ মনে করতে থাকেন, তাঁরা ক্রমশ ‘জনবিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়ছেন। ২০১১-র নভেম্বরে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা কিষেণজির মৃত্যুর পরে নাশকতার পথ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিক্রম। এ ব্যাপারে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অযোধ্যা স্কোয়াডের ১১ জন এবং দলমা স্কোয়াডের ৫ প্রতিনিধিকে নিয়ে অযোধ্যা পাহাড় এলাকায় এক বৈঠকও করে মাওবাদীরা।
বিক্রম সিআইডি-কে জানিয়েছেন, সেই বৈঠকে তিনি রঞ্জিত পালকে বলেন, ‘‘মানুষ আর আমাদের বিশ্বাস করছে না। আমাদের চাইছে না। আমাদের এই কাজ (নাশকতা) বন্ধ করা উচিত।” সহমত হন রঞ্জিত-সহ অযোধ্যা স্কোয়াডের সদস্যেরা। তবে দলমা স্কোয়াডের প্রতিনিধিরা কোনও মন্তব্য না করে ফিরে যান। ওই বৈঠকের পরে ‘লেভি’ বাবদ ঠিকাদার, ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ‘তোলা’ আদায় করে অযোধ্যা স্কোয়াড। টাকাটা ভাগ করে নেন স্কোয়াড-সদস্যেরা।
গোয়েন্দাদের দাবি, বিক্রমকে জেরা করে তাঁরা জেনেছেন, ভাগের টাকা নিয়ে জানুয়ারিতেই রঞ্জিত ও অনিতা তাঁদের এক আত্মীয়ের কাছে মুম্বই চলে যান। ‘জেরায় পাওয়া’ তথ্য অনুযায়ী, নানা নাশকতায় অভিযুক্ত আর এক অযোধ্যা স্কোয়াড সদস্য, পুরুলিয়ার বলরামপুরের যুবক হলধর (গড়াই) যান বিহারে। নন্দীগ্রামের
সোনাচূড়ার মেয়ে কবিতা ওরফে কল্পনাও অযোধ্যা পাহাড় ছেড়ে সরে যান অন্যত্র। রঞ্জিত-অনিতার মতো এই দু’জনের হদিসও এখনও পাননি গোয়েন্দারা। অযোধ্যা স্কোয়াডের অন্য সদস্যদের মধ্যে শিখা ও চম্পা সম্প্রতি কলকাতা আত্মসমর্পণ করেছেন। হেমলতা ওরফে শিবানী সিং সর্দার আত্মসমর্পণের পরে এখন পুরুলিয়ায় পুলিশের ‘ট্রানজিট ক্যাম্পে’ রয়েছেন।
অযোধ্যা স্কোয়াডের ‘শুরু-শেষ’
পুরুলিয়ায় ৮০০ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে অযোধ্যা পাহাড়।
২০০৬ থেকে বিক্রমের নেতৃত্বে স্কোয়াডের সূচনা।
বলরামপুর, বাঘমুণ্ডি, ঝালদা, কোটশিলা ও আড়শাএই পাঁচ থানা এলাকায় ‘অপারেশন’।
২০০৬-এ কাঁটাডি পুলিশ ক্যাম্প থেকে অস্ত্র লুঠ করে নাশকতার শুরু।
২৩ এপ্রিল, ২০০৯ বলরামপুরের সুপুরডি গ্রামে দুই সিপিএম নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যা।
১৯ জুলাই, ২০১০ আড়শার সিঁদুরপুরে সিপিএম নেতা ও তাঁর বড় ছেলেকে খুন।
২৪ জুলাই, ২০১০ বাঘমুণ্ডির মাঠায় অতিথি নিবাস ওড়ানো।
৯ অক্টোবর, ২০১০ বলরামপুরে দুই সিপিএম নেতাকে খুন।
অক্টোবর, ২০১০ পার্থ-সৌম্যজিৎকে অপহরণ করে খুন।
১৬ ডিসেম্বর, ২০১০ ঝালদার বাগবিন্ধ্যা ও সংলগ্ন গ্রামে এক রাতে সাত জনকে খুন।
২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে স্কোয়াডের দুর্বল হওয়া শুরু।
গোয়েন্দারা জেনেছেন, স্কোয়াড ভেঙে যাওয়ার পরে বিক্রম ফেব্রুয়ারিতে আসানসোলে জমি কিনে বাড়ি করেন। সেখানে থাকাকালীন স্কোয়াডের অন্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল কি?
এক গোয়েন্দা-কর্তার বক্তব্য, “বিক্রম আমাদের জানিয়েছেন, অযোধ্যা স্কোয়াড ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পরে উনি আর কোনও সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেননি। ওঁর সঙ্গেও কেউ যোগাযোগ করেনি। মনে হচ্ছে, উনি এ পর্যন্ত আমাদের কাছে যা বলেছেন, তা ভুল নয়। তাই তার ভিত্তিতে রঞ্জিত পালের মতো মাওবাদীদের হদিস পাওয়ার তোড়জোড় হচ্ছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.