খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি থেকে শুরু করে পেনশন এবং বিমা বিল কেন্দ্রের আর্থিক সংস্কার কর্মসূচির কমবেশি সবেতেই আপত্তি রয়েছে তাঁর। কিন্তু রাজ্যের উন্নয়নের জন্য রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে এখন ধীর পায়ে হলেও নিঃশব্দে সংস্কারের পথেই হাঁটছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গের বেহাল আর্থিক দশা কাটাতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের (এডিবি) সহায়তা নিতে চলেছে মমতার সরকার। রাজ্যের আর্থিক উন্নয়ন ও সংস্কার কর্মসূচির জন্য ৩০ কোটি ডলার বা ১৬৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে এডিবি। আরও ২০ কোটি ডলার বা ১১০০ কোটি টাকা দেওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু এই ঋণ নিতে গেলে কিছু শর্ত মানতে হবে। কেন্দ্রের পরামর্শ মেনে ঢিলেঢালা কর কাঠামো সংস্কারের সেই শর্ত স্বীকার করা নিয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাতারাতি করকাঠামো সংস্কারের এমন দাওয়াই এডিবি দেবে না, যাতে রাজ্যের অসুবিধা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে মূলত ৩টি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এক, রাজস্ব বাড়াতে আরও উপায় খোঁজা। দুই, অপচয় বন্ধ করা। এবং তিন, ঋণ ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকরী করা।
পশ্চিমবঙ্গের দুর্বল কর কাঠামো নিয়ে বাম আমল থেকেই সতর্কবার্তা দিচ্ছে কেন্দ্র। রাজ্যে পালাবদলের পরে নতুন সরকারকেও একই পরামর্শ দিয়েছে তারা। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের তরফে রাজ্যকে বলা হয়েছে, রাজস্ব না বাড়ালে এক তরফা ভাবে আর্থিক সাহায্য দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, “গত সেপ্টেম্বরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, জলকর না বসালে রাজ্য জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশনের (জেএনএনইউআরএম) টাকা পাবে না। কারণ, এই প্রকল্পের আওতায় রাজ্য যে পরিকাঠামো বা পরিষেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে, তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টাকা দরকার। কর বসিয়েই সেই টাকা তুলতে হবে।”
মমতা তখন রাজি হননি। কিন্তু এখন বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে তিনি ক্রমশ ইতিবাচক পথে হাঁটছেন বলেই অর্থ মন্ত্রকের মত। বেশি জল ব্যবহারকারীদের উপরে কর বসানোর প্রস্তাব ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছে রাজ্য। অন্য দিকে ঘুরপথে হলেও বিদ্যুতের মাসুল বৃদ্ধির ব্যাপারেও সায় দিয়েছেন তিনি। বাড়ানো হয়েছে দুধের দামও।
রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ফাঁকফোকর বন্ধে রাজ্য সরকারের এই ‘সদিচ্ছা’ দেখে কেন্দ্রও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। মমতার দাবি মেনে আসল ও সুদ পরিশোধের উপরে তিন বছরের স্থগিতাদেশ জারি করা হয়নি ঠিকই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক উন্নয়ন ও রাজস্ব আদায় ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য এডিবি যাতে সাহায্য করে সে জন্য তাদের অনুরোধ জানিয়েছে কেন্দ্র।
রাজ্যের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার পর গত ১১ জুলাই সেই প্রস্তাবে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে এডিবি। ৩০ অক্টোবর এডিবি বোর্ড এ ব্যাপারে চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে। অবশ্য তার আগে রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে তা শোধরানোর উপায় বাতলানোর জন্য বেসরকারি পরামর্শদাতা সংস্থার মাধ্যমে টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্স রিপোর্ট তৈরি করা হবে। সে জন্য এডিবি ইতিমধ্যেই অর্থ বরাদ্দ করেছে।
রাজ্যের আর্থিক উন্নয়নের পথ খোঁজার এই চেষ্টা অবশ্য নতুন নয়। সাত বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঠিক একই ভাবে এডিবি-র সাহায্য নিয়ে রাজ্যের আর্থিক হাল ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন। সে জন্য প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্স ৬৯০ পৃষ্ঠার টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিপোর্টও তৈরি করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রকল্প আর দিনের আলো দেখেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কাণ্ডের জেরেই এ ব্যাপারে আর আগ্রহ দেখায়নি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার।
আর্থিক দুরবস্থার জন্য বাম আমলের যে ঢিলেমি ও অকর্মণ্যতার অভিযোগ তোলেন মমতা, এডিবি-র প্রাথমিক রিপোর্টে পরোক্ষে তা-ই তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, “বছরের পর বছর রাজ্য সরকার আর্থিক বিষয়গুলি অবহেলা করেছে। সেই জন্য ২০১০-’১১য় পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক ঘাটতি ছিল দেশের মধ্যে সর্বাধিক। পাশাপাশি, সেই বছর রাজ্যের নিজস্ব কর আদায়ের পরিমাণ ছিল রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৪.৬%। যেখানে জাতীয় গড় ৭.৩%।”
এডিবি-র বক্তব্য, রাজ্যের আর্থিক বৃদ্ধির যেটুকু সম্ভাবনা রয়েছে, তার পথও রুদ্ধ করছে এই দুর্বল কর ব্যবস্থা। পেনশন, বেতন ও সুদ দিতে গিয়েই ভাঁড়ার খালি হয়ে যাচ্ছে। ঋণভারে জর্জরিত হয়ে পড়ছে রাজ্য।
সেই পরিস্থিতিতে থেকে রাজ্যকে বের করে আনার ইঙ্গিত দিচ্ছেন মমতা। শেষ পর্যন্ত কতটা করে উঠতে পারবেন, সেটাই এখন দেখার। |