|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
ভারত-পাকিস্তান থেকে চিন-ভারত |
অমিতাভ গুপ্ত |
প্যাক্স ইন্ডিকা: ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অব দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি, শশী তারুর। অ্যালেন লেন, ৭৯৯.০০ |
চিন তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভারতকে সটান পাঁচ গোল দিয়ে রেখেছে। তা হলে কোন যুক্তিতে ধরে নেব যে আগামী দিনের প্রতিযোগিতায় ভারত চিনের সঙ্গে কোনও ক্রমে হলেও তাল রাখতে পারবে? পারবে, কারণ ২০০৪ সালে ভারতে যে সরকারটি শপথ নিয়েছিল, তার প্রধান ছিলেন এক জন শিখ, যাঁকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন এক ইতালিয়ান রোমান ক্যাথলিক, যাঁকে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন এক মুসলমান! যুক্তিটি পেশ করেছেন শশী তারুর, তাঁর নতুন বই প্যাক্স ইন্ডিকা: ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড অব দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি-তে। এক অর্থে কথাটা ভুল নয়। প্রথম দুনিয়ার চোখে ভারতীয় গণতন্ত্র এবং তার উদারতা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্বমঞ্চে ভারত তার গণতন্ত্রের বিপণনও যথেষ্টই করে। কিন্তু, চিন-ভারতের আর্থিক ভবিষ্যতের কথা আলোচনা যদি শুধু এটুকুতেই আটকে থাকে, ব্যবসা করার সুবিধার সূচক, চিনের এখনও আগ্রাসী রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র অথবা আগামী দশক থেকে ক্রমে ভারতের দিকে তারুণ্যের পাল্লা ভারী হওয়া— কিছুই যদি আলোচনায় না আসে, তবে মুশকিল। তারুর এই বিপত্তিটিই ঘটিয়েছেন। গোটা দুনিয়া যে ভাবে চিন আর ভারতকে জুড়ে দিয়ে ‘চিন্ডিয়া’র ধারণা তৈরি করেছে, সেটা কেন বাস্তবের যথার্থ প্রতিফলন নয়, তা বোঝাতে তারুর অলিম্পিকস-এর উদাহরণ টেনে এনেছেন— ভারত যেখানে পদকতালিকায় কায়ক্লেশে ৫০ নম্বরে, চিন সবার ওপরে। তার পর আর তুলনা চলে!
বইয়ের একেবারে গোড়ায় শশী তারুর একটা সুর বেঁধে দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে দেখতে হবে অর্থনীতির চশমা দিয়ে। বিশ শতকের সামরিক শক্তির আধিপত্যের দিন শেষ। প্রতিশ্রুতি রাখতে পারলেন না তিনি। বইটি বিষয়ের ব্যাপ্তিতে বিশাল— গোটা দুনিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক। কিন্তু এই বিশালতার প্রতি সুবিচার করতে বিশ্লেষণের যে গভীরতা প্রয়োজন, তা বহুলাংশেই নেই। খবরের কাগজের তাৎক্ষণিক লেখায় যা চলতে পারে, বইয়ে যে তা চলে না, এই কথাটা স্মরণে রাখা উচিত ছিল। তারুর কবুল করেছেন, হাজারটা ব্যস্ততার মধ্যে এই বইটি লেখা। তার ছাপ বড় স্পষ্ট।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আলোচনা করতেই সবচেয়ে বেশি শব্দ খরচ করেছেন তারুর, এবং তার সিংহভাগ গিয়েছে মুম্বই হামলার কথা আলোচনা করতে। তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের ভারত-বিদ্বেষ জিইয়ে রাখার কথা বলেছেন। কিন্তু, অবিভক্ত ভারতের ইতিহাস অস্বীকার করতে গিয়ে যে পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদের ধারণাটি গড়ে তোলার জন্য ভারত-বিদ্বেষ ছাড়া আর কোনও অবলম্বন ছিল না— উপমহাদেশের এই প্রতিষ্ঠিত সত্যটিকে তারুর সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছেন। ফলে, পাক-রাজনীতির ভারত-বিদ্বেষ সংক্রান্ত আলোচনাটি কোথাও দাঁড়ায়নি। বরং, ২৬/১১-র আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য যে শুধু ভয় দেখানো নয়, ভারতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করা, তারুর তা প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। ভারতের বর্তমান আর্থিক সমৃদ্ধিতে পাকিস্তানকে কী ভাবে শরিক করে নেওয়া যায় যাতে সে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারত-বিদ্বেষ কমতে পারে, তারুর সে আলোচনায় ঢোকেননি।
বস্তুত, ভারতের নিকট প্রতিবেশী দেশগুলির ক্ষেত্রে ভারতীয় বিদেশনীতি দীর্ঘ দিন ধরেই ভ্রান্ত। এই অঞ্চলে ভারতের আর্থিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক শক্তি বাকি দেশগুলোর তুলনায় ঢের বেশি। ভারত তার এই অসমঞ্জস গুরুত্বের যথেচ্ছ ব্যবহারও করেছে, ফলে এই দেশগুলি ভারতের প্রতি অনুকূল নয়। তারা সুযোগ পেলে ভারত-বিরোধিতায় পিছপা হয় না। এই বিরোধিতাকে বদলে দেওয়ার একটা মস্ত সুযোগ ভারতের কাছে এখন আছে— নিজের আর্থিক সমৃদ্ধিতে এই দেশগুলিকে খোলা মনে ভাগ বসাতে দিতে হবে। এই দেশগুলির পণ্যের জন্য ভারতের বাজার খুলে দিতে হবে, পরিবর্তে কোনও প্রত্যাশা ছাড়াই। ভারতের ওপর অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল করে তুলতে হবে দেশগুলিকে। সেই নির্ভরশীলতাই দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে কূটনৈতিক আধিপত্য দিতে পারে। চিন ঠিক এই কাজটাই করে চলেছে। এবং, তাতে যে শুধু কূটনৈতিক লাভ, তা নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যের পরিমাণ এখনও খুবই কম। এই বাণিজ্য বাড়লে সব দেশেরই লাভ হতে পারে। ভারতকে দায়িত্ব নিতে হবে। বস্তুত, শুধু ভারতের বাজার খুলে দিলেই চলবে না, প্রতিবেশী দেশগুলিতে বিনিয়োগ করতে হবে ভারতকে, নিজের উপস্থিতি সদর্থক ভাবে জাহির করতে হবে। চিন তার নিজের প্রতিবেশী দেশগুলিতে এই কাজটা তো করেছেই, ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতেও চিনের উপস্থিতি ভারতের পক্ষে রীতিমত উদ্বেগজনক।
|
দেশ |
সোনা |
রুপো |
ব্রোঞ্জ |
মোট |
চিন |
১৮ |
১১ |
৫ |
৩৪ |
আমেরিকা |
১৮ |
৯ |
১০ |
৩৭ |
|
|
|
|
|
ভারত |
০ |
০ |
১ |
১ |
যে যেখানে দাঁড়িয়ে। অলিম্পিকের দৌড়ে, অর্থনীতিরও।
পদকসংখ্যা শুক্তবার সন্ধ্যা পর্যন্ত। |
|
|
মুশকিল হল, ভারতের অবস্থা ঠিক চিনের মতো নয়। তারুর তাঁর বইয়ে যে কথাটি কোথাও লেখেননি, তা হল, ভারতের আর্থিক সামর্থ্য এত কম নয় যে তাতে প্রতিবেশী দেশগুলো কিঞ্চিৎ নিরাপত্তার অভাবে ভুগবে না, আবার এত বেশিও নয় যে এই দেশগুলিতে প্রভূত বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারত তাদের প্রশ্নাতীত আস্থা অর্জন করতে পারবে। ভারতের যা সামর্থ্য, তাকে বুঝেসুঝে ব্যবহার করতে হবে। তার সঙ্গে কূটনীতির মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। সেটা কী ভাবে সম্ভব, তারুর লেখেননি।
ভারত যে ভাবে মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকারের সর্বার্থেই অগণতান্ত্রিক শাসনের সঙ্গে সমঝোতা করেছে, তারুর তার সমালোচনা করেছেন, আবার এ কথাও বলেছেন যে সে দেশে প্রভূত প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া যাওয়ার পরেও যদি ভারত গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে মায়ানমারের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকত, তবে তা কূটনৈতিক বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক হত। প্রথমত, তাঁর নিজের মত কোনটি, বোঝা গেল না। দ্বিতীয়ত, মায়ানমারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটি যে এমন সরলরৈখিক নয়, ভারত যে চিরকাল মায়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেও সে দেশের অগণতান্ত্রিক শাসনের সমালোচনা করার জায়গাটি রাখতে পেরেছিল, সেই কথাটি তারুরের লেখায় পাওয়া গেল না। থিয়েন সেনের সরকার যখন ক্রমে গণতন্ত্রের পথে ফেরার চেষ্টা আরম্ভ করল, তখন বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ দেশের প্রধানরা মায়ানমার সফর আরম্ভ করলেন। তারুর, সম্ভবত তাঁর কংগ্রেস-প্রীতির কারণেই, উল্লেখ করেননি যে মনমোহন সিংহ প্রায় সবার শেষে মায়ানমার সফরে গিয়েছিলেন— হিলারি ক্লিন্টন, সারকোজি, হু জিনতাও, সবাই তাঁর আগে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
তারুর ভারতের সফট পাওয়ার নিয়ে একটা গোটা অধ্যায় লিখেছেন। তবে, যে প্রশ্নটি তিনি উত্থাপন করেননি বস্তুত, সফ্ট পাওয়ার নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান, তাঁরা কেউই যে প্রশ্নটি তোলেন না— সেটা হল, শুধুমাত্র সফট পাওয়ারের জোরে কি কোনও দেশের বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠা সম্ভব? আজ যে বলিউড আর যে আয়ুর্বেদ বা যোগব্যায়াম ভারতের সফ্ট পাওয়ার হিসেবে মহা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তার সবই ষাট বছর আগেও ছিল। বস্তুত, তখন ভারতের জওহরলাল নেহরু ছিলেন। তবুও ভারত বিশ্বমঞ্চে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর শক্তি ছিল। তার কারণটি সহজ— তখন ভারতের অর্থনৈতিক জোর ছিল না। এখন হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে ভারত আর পাকিস্তান, এই দুটো নাম এক সঙ্গে উচ্চারিত হত। এখন বলা হয় চিন আর ভারত। ভারতের আসল গল্পটা সেখানেই। তারুরের গোটা লেখায় এই কথাটাই স্পষ্ট ভাবে বলা হল না। |
|
|
|
|
|