সরকারি ‘অবহেলা’ নিয়ে প্রশ্ন
প্রাক্তন জঙ্গিরা কি ফের জঙ্গলমুখী, ধন্দে রাজ্য
ঙ্গল-জীবন ছেড়ে ‘মূলস্রোতে’ ফেরার আর্জিতে সাড়া দেওয়ার দীর্ঘ দিন পরেও মেলেনি পুনর্বাসন। ‘অবহেলা’র শিকার হয়ে ‘কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ (কেএলও)-এর প্রাক্তন জঙ্গিরা এখন ফের নাশকতার পথে ফিরতে চলেছেন কি নাতা নিয়ে ধন্দে পড়েছে প্রশাসন। প্রশাসনের কপালে ভাঁজ পড়ার কারণ, খুব অল্প সময়ের মধ্যে উধাও হয়ে গিয়েছেন কেএলও-র প্রথম সারির বেশ কয়েক জন নেতা।
কেন্দ্রীয় বরাদ্দে তিন বছরের মধ্যে প্রাক্তন কেএলও জঙ্গি, ‘লিঙ্কম্যান’ মিলিয়ে ১,২০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করার প্রকল্প চালু হয় ২০০৪ -এ। ২০১০-এ দেখা গেল, প্রশিক্ষণ দেওয়া গিয়েছে মাত্র ৬৩৪ জনকে। প্রকল্প বন্ধ হয়েছিল তার আগেই। প্রাক্তন জঙ্গিদের একাংশের আশঙ্কা, “সরকারি তরফে পুনর্বাসন নিয়ে ভুল পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়িত করতে টালবাহানার ফলে এক সময়ে নানা নাশকতা চালিয়ে আতঙ্কের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠা টম অধিকারী, মালখান সিংহের মতো কেএলও-র প্রথম সারির জঙ্গিরা ফের সংগঠনকে চাঙ্গা করতে অরণ্য জীবনে ফিরে গিয়েছেন।”
গত কয়েক মাসে টম ওরফে জয়দেব দাস, মালখান ওরফে মাধব মণ্ডল, বেলাকোবার নারায়ণ রায় ওরফে তরুণ থাপা, ময়নাগুড়ির প্রদীপ রায় ওরফে ইকবাল সিদ্দিকির মতো চার জন প্রথম সারির প্রাক্তন কেএলও জঙ্গি ‘উধাও’ হওয়ার পরে প্রাক্তন কেএলও-দের ওই আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয় বলে মানছে পুলিশ-প্রশাসনও। টম যে এলাকার বাসিন্দা, সেই জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার সুগত সেন বলেছেন, “কিছু দিন আগে অবধি টম বাড়িতেই ছিলেন। মাস দেড়েক আগে শোনা গেল, তিনি নাকি চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে তা ঠিক নয়। একটা দুর্ভাবনা তো হচ্ছেই।” পাশাপাশি, মালখান সিংহ যে জেলার বাসিন্দা, সেই মালদহের পুলিশ সুপার জয়ন্ত পালও বলেছেন, “মাস দেড়েক হল মালখান সিংহের কোনও খবর নেই। আমরা কিন্তু ওঁর গতিবিধি জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়!”
টম-মালখানরা যদি ফের কেএলও-র স্বঘোষিত ‘চিফ’, আত্মগোপনকারী জীবন সিংহের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আলফা-সহ উত্তর-পূবের্র নানা জঙ্গি গোষ্ঠীর মদত নেন, তা হলে কী হতে পারে ভেবেই রাতের ঘুম উবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে রাজ্য পুলিশের সদর দফতরেরও অফিসারদের অনেকেরই।
এত দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ কেন?
১৯৯৫-এ জন্ম কেএলও-র। প্রশাসন সূত্রেই জানা গিয়েছে, আলফা-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের নানা জঙ্গি গোষ্ঠীর মদতে প্রশিক্ষিত হন কেএলও সদস্য-সদস্যারা। সংগঠনের শীর্ষে ছিলেন কুমারগ্রামের জীবন সিংহ ওরফে তমির দাস। নানা ধরনের নাশকতার অভিযোগ উঠেছে কেএলও-র বিরুদ্ধে। ২০০২-এ ধূপগুড়িতে সিপিএমের দলীয় কার্যালয়ে হানা দিয়ে ৭ সিপিএম কর্মীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে কেএলও-র ‘অপারেশন কমান্ডার’ টম অধিকারীর বিরুদ্ধে। পরে প্রশাসনিক অভিযানের মুখে এ রাজ্যে কেএলও প্রশমিত হয়। টম-সহ কেএলও-র অনেক শীর্ষ নেতাই ধরা পড়েন। অনেকে আত্মসমর্পণ করেন। ১৯৯৯-এ ধরা পড়লেও পরে পালিয়ে যান জীবন সিংহ। এখনও তিনি অধরা। আত্মসর্মপণকারী কেএলও জঙ্গিদের মূলস্রোতে ফেরাতে ২০০৪ সালের ১৫ অগস্ট ‘নব দিশা’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রীয় সমবিকাশ যোজনার (আরএসভিওয়াই) অধীনে ওই প্রকল্পে প্রাক্তন জঙ্গিদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবিরে রাজ্য সরকারের নানা দফতরের যে সব প্রকল্পে বেকার যুবক-যুবতীরা স্বনির্ভর হতে পারেন, তা বিশদে জানানো হত। সেই প্রকল্পে ব্যাঙ্ক ঋণ নেওয়ার শর্ত বা পদ্ধতি জানানো হত। প্রশিক্ষণের শেষে কে, কোন ব্যবসায় আগ্রহী তা জেনে তাঁকে সংশ্লিষ্ট দফতরে যোগাযোগ করিয়ে ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করা হত। শিবির শেষে প্রত্যেকের হাতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে মূলধন হিসেবে দেওয়া হত।
২০০৭-এ আরএসভিওয়াই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ওই প্রকল্প খাতে বরাদ্দ অর্থের কিছু অংশ পড়ে থাকায় ২০০৯ পর্যন্ত চলে ‘নব দিশা’ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিয়ে প্রাক্তন কেএলও জঙ্গিরা পুর্নবাসন প্যাকেজের দাবি করেন। রাজ্য সরকার ওই দাবি না মানায় তাঁরা প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দিতে অস্বীকার করেন।
সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে চাওয়া প্রাক্তন কেএলও-দের মধ্যে নতুন করে ‘উষ্মা’র সূত্রপাত সরকারি ‘টালবাহানা’র জন্যই, অভিযোগ মিল্টন বর্মার। এক সময় কেএলও জঙ্গিদের মধ্যে টম অধিকারীর সঙ্গে প্রায় একযোগে নামোচ্চারিত হত মিল্টনের। ধরাও পড়েন একই সঙ্গে ২০০৩-এ। ২০১১-য় জামিনে মুক্তি পান দু’জনে। সেই সময় থেকে নিজেদের ‘আলোচনাপন্থী কেএলও’ হিসেবে দাবি করে মূলস্রোতে ফিরতে চেয়ে সরকারকে সব রকম সহযোগিতা করতে রাজি হন টম-মিল্টন। সেই মিল্টনের অভিযোগ, তাঁদের মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য রাজ্য সরকারের তরফে আশ্বাস দেওয়া হলেও কাজের কাজ হয়নি।
আর এক প্রাক্তন কেএলও নৃপেন সিংহ বড়ু্য়ার ক্ষোভ, “২০০৪-এ আত্মসমর্পণ করেছি। অথচ পুনর্বাসনের জন্য পুলিশ-প্রশাসন, পঞ্চায়েতের কাছে আমাকেই ছুটতে হয়েছে। কেউ আমাকে প্রশিক্ষণের কথা জানায়নি। কোনও মতে চাষবাস করে মূলস্রোতে আছি। এ ভাবে চলে না।” আর এক প্রাক্তন কেএলও মধুসূদন দাস ওরফে টারজান বললেন, “২০০২-এ আত্মসমর্পণ করি। ২০০৬-এ নব দিশা প্রকল্পের আলোচনায় ডাক পাই। সেখানে মূলস্রোতে ফিরতে গেলে অনেক ঘাম ঝরাতে হবে গোছের নানা কথা বলে আমাকে ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। ওই টাকায় কী ব্যবসা হবে, ব্যাঙ্ক ধার দেবে কেন এ সব প্রশ্নের জবাব পাইনি। এখন টাকা শেষ। ছোটখাটো ঠিকাদারি করে সংসার চালাচ্ছি।”
কেন বন্ধ হল নব দিশা প্রকল্প?
সরকারি সূত্র বলছে, খরচের পরে রাজ্য সরকার ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ দিতে না পারায় ২০০৫ সালে কেন্দ্র টাকা পাঠানো বন্ধ করে। তবে আগের খরচ না হওয়া টাকায় ২০০৯ সালে এক দফায় প্রশিক্ষণ হয়। আরএসভিওয়াই বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ২০১০ সালে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদ থেকে নব দিশা প্রকল্পকে অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেই সময় পর্ষদ জানায়, ১২৮ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তাঁদের নামের তালিকা মহাকরণে পাঠানো হয়। বিষয়টি সেখানেই থমকে যায়।
জলপাইগুড়িতে নব দিশা প্রকল্প চালু ছিল জেলা পরিষদের মাধ্যমে। প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি বনমালী রায় বলেছেন, “একটা সময় পর্যন্ত কাজ ভাল হয়েছে। পরে প্রকল্প কেমন পরিচালনা করা হয়েছে জানি না।” প্রাক্তন অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণমন্ত্রী যোগেশ বর্মনের বক্তব্য, “ওই প্রকল্পে বেশ কিছু ছেলে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত কত জন ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমরা রাখতে পারিনি। নানা কারণে ব্যাপারটা ঢিলেঢালা হয়ে যায়।” জলপাইগুড়ির বর্তমান জেলা সভাধিপতি দীপ্তি দত্ত বলেছেন, “আরএসভিওয়াই শেষ হয়ে যাওয়ার নবদিশা প্রকল্পের কাজ আর চালানো যায়নি।” অন্য উপায় করা হয়নি কেন? দীপ্তিদেবীর বক্তব্য, “প্রকল্পটি যখন তৈরি হয়েছিল, সেই সময়ের জেলাশাসক নিজে এর রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। সে কারণে এ বিষয়ে বিশদে কিছু বলা সম্ভব নয়।”
সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘসূত্রিতা বা অবহেলার যে অভিযোগ মিল্টনেরা করেছেন, তা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় বলে মেনেছেন কেএলও-র প্রাথমিক আন্দোলন পর্বে জঙ্গিদের সামাল দিয়ে তাঁদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা রাজ্য পুলিশেরই এক পদস্থ আধিকারিক। তাঁর মতে, জঙ্গিদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আমার জন্য সরকার অর্থনৈতিক প্যাকেজ দিয়েই ক্ষান্ত হয়। অথচ, ‘উপেক্ষিত’ হয়েছিল জঙ্গিদের সামাজিক সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্ন। মূল স্রোতে ফেরত আসা জঙ্গিদের নিয়ে বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করা হলেও তাঁদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া যায়নি। প্রশিক্ষণ অন্তে সরকারি সাহায্য হাতে পেতেও অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে প্রাক্তন জঙ্গিদের। কী হতে পারে এই পরিস্থিতিতে? মিল্টনের আশঙ্কা, “হতাশায় টমরা হয়তো জীবন সিংহের কাছে গিয়ে কেএলও-কে ঘুরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।” তাঁর মতো অনেক প্রাক্তন কেএলও-র আক্ষেপ, “সরকার আগে সতর্ক হলে, এই পরিস্থিতিই হত না!”
পুরো নাম কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন।
প্রথম প্রশিক্ষণ শিবির ১৯৯৬-এ ভুটানে।
১৯৯৯-এ শিলিগুড়ির কাছে রাঙাপানিতে
দু’জনকে খুন করে রেলের টাকা লুঠ।
২০০০-২০০১-এ কুমারগ্রাম, ময়নাগুড়ি,
ধূপগুড়িতে একাধিক বাম নেতাকে খুন ।
২০০২-এ ধূপগুড়িতে সিপিএম অফিসে হামলা। নিহত ৭।
২০০৬-এ আলফা-কেএলও যোগসাজসেই
জলপাইগুড়ির বেলাকোবায় ট্রেনে বিস্ফোরণ বলে অভিযোগ। হত ১০।

উধাও দুই কেএলও

টম অধিকারী
পিস্তল, নানা ধরনের রাইফেল, মর্টার,
রকেট লঞ্চার চালানোয় পারদর্শী। দু’হাতে
আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে পারেন। মাস দেড়েক নিখোঁজ।

মালখান সিংহ
সব ধরনের স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র
চালাতে ও নানা ধরনের বিস্ফোরক
তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। খোঁজ নেই মাসখানেক।


মিল্টন বর্মা
হতাশায় টমরা হয়তো জীবন সিংহের কাছে গিয়ে কেএলও-কে ফের ঘুরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.