পুস্তক পরিচয় ২...
রামায়ণের এক আশ্চর্য মৌলিক পাঠ
‘‘মহাকাব্যের যুগ শেষ হয়েছে কিন্তু মহাকাব্য পাঠকের?’ ফাদার রবের আঁতোয়ানের রাম অ্যান্ড দ্য বার্ডস: এপিক মেমোরি ইন দ্য রামায়ণ-এর তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক প্রয়াত সুবীর রায়চৌধুরী অনূদিত রূপ ‘রাম এবং চারণেরা/ রামায়ণে এপিক স্মৃতি’ (পত্রলেখা, ১২০.০০)। অনুবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল সুভাষ ঘোষাল সম্পাদিত ‘হীনযান’ পত্রিকায়। সেটি সংগ্রহ করে প্রকাশ করার জন্য শুভাশিস চক্রবর্তী এবং প্রকাশক ধন্যবাদার্হ। যে গ্রন্থ প্রসঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘...শতাব্দীর পর শতাব্দী যাইতেছে কিন্তু রামায়ণ-মহাভারতের স্রোত ভারতবর্ষে আর লেশমাত্র শুষ্ক হইতেছে না’, সেই গ্রন্থ প্রসঙ্গে ফাদার আঁতোয়ান বলেন, মহাকাব্য সাহিত্য তাই সৃষ্টিশীল ঐতিহ্য— যত দিন এপিক জনগোষ্ঠী সম্প্রদায় হিসেবে জীবন্ত, তত দিন পর্যন্ত এই পরমের অনুসন্ধান কখনোই থামবে না।’ বিশ্বাস, ঐতিহ্য আর পরিবেশকে মননে আর হৃদয় গভীরে অনুভব করে ধর্মগ্রন্থ পরিচিতির চেনা সীমার সম্পূর্ণত বাইরে রামায়ণের এক আশ্চর্য মৌলিক পাঠের সন্ধান দেয় এই বই। প্রবন্ধগ্রন্থের অনুবাদও যে কত হৃদয়গ্রাহী হতে পারে, আলোচ্য বইটি তার উদাহরণ।
“‘চলো চলো যাই মানবসংসর্গে’ ভেতর থেকে কে যেন আমায় বলে উঠল।” এই একমুখী বাক্যে অপরূপ এক স্মৃতিকথা দেখা না-দেখায় মেশা-য় (লালমাটি, ৪০০.০০) যতি টেনেছেন প্রাবন্ধিক সুধীর চক্রবর্তী। এক দৈনিক কাগজের রবিবারের ‘কলামে’ প্রকাশিত এই লেখাগুলিতে ভাস্বর হয়ে আছেন অনেকেই। আছেন ‘আশ্চর্য স্বভাবের চিরকুমার কবি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার সামন্ত সন্তান’ রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী— ‘এমন চমকপ্রদ সহকর্মী আর কখনো পাইনি’ বলেছেন প্রাবন্ধিক। আছেন সত্তর দশকের পণ্ডিচেরিতে দেখা ‘সেলাই দিদিমণি’ সাহানাদেবী ‘তাঁর গলা দিয়ে শত অনুরোধে একটুও সুর বার করতে পারিনি, এমনই অভিমান।’ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পাওয়া সাহানা দেবীর লেখা দিলীপকুমার রায় সম্পর্কে কিছু ‘অভিযোগ’ এমনকী ‘নিন্দেমন্দ’ সংবলিত চিঠির কপি করা খাতা প্রাবন্ধিকের কাছে থাকলেও তিনি তাঁর ‘প্রসন্ন স্মৃতির অংশ’-র ভাগ কাউকে দিতে নারাজ। আছেন কেরুকাকা, যার অসামান্য উক্তি: ‘...কলকাতার ফুটপাথে খানিকটা দাঁড়ালে মনে হয় মানুষ পিতৃশোক ভুলে যাবে।’ লোকায়ত জীবনের শিকড় থেকে উঠে আসে ঈশ্বরকে নিয়ে রসিকতা ‘চাষার সঙ্গে মাঠে নামো, জল-কাদা-মাখো, নইলে কীসের দেবতা?’ আছেন অসামান্য সব অধ্যাপককুল— চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, জনার্দন চক্রবর্তী— যিনি শিশিরকুমার দাসের লেখা ‘সুন্দরতা’ শব্দের পাশে মন্তব্য করেছিলেন, ‘সুন্দর স্বতঃস্ফুট। তাকে তা দিয়ে ফোটাতে হয় না।’ আছেন অমিয়নাথ সান্যাল, রাজ্যেশ্বর মিত্র, দিলীপকুমার রায় থেকে গৌরী আইয়ুব, চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, কত গুণিজন। এত ‘মানব সংসর্গের’ পরও যাঁর পথিকপরাণ চলা থামায় না, তাঁকে প্রণতি।
‘সংসারে ক্ষুদ্র কালটাই সত্য হয়ে দেখা দেয় কুমু, চিরকালটা থাকে আড়ালে; গানে চিরকালটা আসে সামনে, ক্ষুদ্র কালটা যায় তুচ্ছ হয়ে, তাতেই মন মুক্তি পায়’— যোগাযোগ উপন্যাসে বিপ্রদাসের কথাটি মনে পড়ে যেতে পারে যে উপন্যাস পড়তে পড়তে তার নাম মালবকৌশিক (দে’জ, ৫০০.০০)। মালবকৌশিক মানে মালকোশ রাগ। তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এই সুদীর্ঘ উপন্যাসে জড়িয়ে আছে গান— ‘ধুরপদ’ থেকে ‘ধ্রুপদ’ হয়ে ওঠার আশ্চর্য ইতিকথা। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে গোয়ালিয়রকে কেন্দ্র করে ধ্রুপদ ধারার বিস্তারের পাশাপাশি ধ্রুপদপ্রেমী সংগীতজ্ঞ রাজা মানসিংহ তোমর, তাঁর রানি মৃগনয়নী, তানসেন-পূর্ব অসামান্য সংগীতশিল্পী বজ্জু-র (ধর্মান্তরিত হয়ে বক্সু) জীবনকাহিনির সঙ্গে ইতিহাসের চরিত্র সুলতান সিকান্দার লোদি, পানিপথে সুলতান ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে বাবরের যুদ্ধ অপূর্ব এক আলপনা সৃষ্টি করেছে। ইতিহাস-সংগীত আর নানা ব্যক্তিজীবনের মেলবন্ধনে মালকোশ রাগের প্রজ্ঞা, দাপট আর সবার ওপরে এক নিরন্তর নিস্পৃহ প্রবহমানতার সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে এখানে, বাংলা উপন্যাস ধারায় যা অনন্য।
১৭৮৩-র সেপ্টেম্বরে কলকাতায় পা রাখেন সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম বিচারপতি স্যর উইলিয়াম জোন্স। অক্সফোর্ডের ছাত্র, আইন অধ্যয়নের পাশাপাশি আরবি, ফার্সি ও হিব্রু ভাষায় গভীর বুৎপত্তি, ছবি আঁকায় আগ্রহী জ্ঞানপিপাসু, প্রাচ্যপ্রেমী, ‘রয়্যাল সোসাইটি’র ফেলো সেই উইলিয়াম জোন্সের উদ্যোগেই ১৭৮৪-র ১৫ জানুয়ারি স্থাপিত হয় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’। ১৭৯৪ পর্যন্ত সভাপতি হিসেবে তাঁর দেওয়া দশটি ভাষণের অমিতা চক্রবর্তী কৃত অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে (এশিয়াটিক সোসাইটি, ৩০০.০০)। এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্দেশ্য থেকে এশিয়ার শিল্প, বিজ্ঞান, আইন, প্রাচীন ‘হিন্দু’দের বিস্ময়কর সৃষ্টিশীলতা, ভারতীয়, চিনদেশীয়, তাতার, আরব ও পারসিক এশিয়ার এই মুখ্য পাঁচটি সভ্যতার ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, ভাস্কর্য, কলাবিদ্যা, বিজ্ঞান প্রভৃতি সর্ববিষয়ে গভীর আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে পর্বত ও দ্বীপপুঞ্জের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলি সম্পর্কে বক্তার সুগভীর বক্তব্য পাঠককে আজও অভিভূত করে। অনুবাদ সামান্য ক্লিষ্ট হলেও যথাযথ টীকা দিয়েছেন অনুবাদিকা। পরিচ্ছন্ন ছাপার বইটি কিছু মুদ্রণপ্রমাদ সত্ত্বেও অবশ্য সংগ্রহযোগ্য।
যে উপন্যাস শুরু হয় ডিকেন্সের ‘ইট ওয়াজ দ্য বেস্ট অফ টাইমস, ইট ওয়জ দ্য ওয়ার্স্ট অফ টাইমস’ দিয়ে সে বই যে কালের এক উত্তাল সময়কে বিম্বিত করে তা অনায়াসবোধ্য। নকশাল আন্দোলনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়া একদল তরুণের ব্যক্তিজীবন আর রাজনৈতিক দিনযাপনের ইতিকথা এ বই। সবুজ, স্বপন, ফুলকি, অবনীর মতো সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী থেকে সুশীতল রায়চৌধুরি, সি এম (চারু মজুমদার), সরোজ দত্তের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে অনায়াস দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন চিত্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর আমার বাড়ি তোমার বাড়ি (পরম্পরা, ১৫০.০০) উপন্যাসে, বিপ্লবের অন্তরমহলের বাসিন্দা না হলে চেনা যায় না ‘এম এম’-এর মতো লোকদের, যারা বলে, ‘আমার আবার ভাত না হলে চলে না’। একাধিক যৌনতা বিষয়ক বাক্য এ কাহিনিতে কতটা জরুরি? যে উপন্যাস শেষ হয় ‘ওরা আমাকে আর কমিউনিস্ট মনে করে না’-র হাহাকারে নয় ‘...লক্ষ কোটি বঞ্চিতের বজ্রনিনাদ, নতুন বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’-এ তার লেখকের কাছ থেকে তো আরও একটু দায়িত্বশীলতা আশা করতে পারেন পাঠক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.