কয়লা পাচার কমেছে, লোকসান পুষিয়ে দিচ্ছে লোহা চুরির রমরমা
ত বছর রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, আসানসোল-রানিগঞ্জের খনি এলাকায় কয়লা মাফিয়াদের রাজত্ব আর চলতে দেবেন না। তাঁর চাপে অবৈধ কয়লা কারবারের রমরমা বেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু তার বদলে হু-হু করে ছড়িয়ে পড়েছে অবৈধ লোহার কারবার। যদিও পুলিশ তা মানতে নারাজ। কিছু রাজনৈতিক নেতার ‘সদিচ্ছা’ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
রাজ্যে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার মাস তিনেক বাদে, গত ১ সেপ্টেম্বর গড়া হয়েছিল আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট। যার অন্যতম কাজ ছিল মাফিয়ারাজ বন্ধ করা। পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দর দাবি, “কয়লার মতো লোহার অবৈধ কারবারও এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে।” অথচ এলাকার মানুষ অন্য কথা বলছেন। তৃণমূলের বর্ধমান জেলা (শিল্পাঞ্চল) কমিটির সাধারণ সম্পাদক ভি শিবদাসনের মতে, “গত ন’দশ মাস ধরেই লোহাচুরি বেড়েছে।”
কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআইএসএফের দাবি, গত এক বছরে তারা ইস্কো থেকে দেড়শো লোহাচোরকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। অথচ এই এক বছরেই ইস্কো থেকে বিপুল পরিমাণ লোহা চুরি হয়েছে দাবি করে কেন্দ্রীয় ইস্পাত মন্ত্রকে চিঠি দিয়েছেন আসানসোলের সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরী। এবং তার জন্য বিশেষ করে সিআইএসএফের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। রানিগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক সোহরাব আলি অবশ্য দাবি করেন, “লোহা চুরির কারবার চলছে বলে আমার জানা নেই। যদি এমন ঘটে, পুলিশ-প্রশাসনের তা দেখা উচিত।”
তৃণমূল এবং কংগ্রেস নেতাদের একাংশই কিন্তু অভিযোগ করছেন, হিরাপুর ও কুলটিতে সবচেয়ে বেশি চোরাই লোহার কারবার চলছে। বিশেষ করে ইস্কোর লোহা প্রতি দিন লুঠ হচ্ছে। কেউ-কেউ পুলিশ-প্রশাসনের হয়ে মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁদের একাংশ সরাসরি লোহাচুরিতেও যুক্ত। অন্য দিকে, দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট ও বেশ কিছু বন্ধ কারখানা থেকে লোহা কাটা হচ্ছে। সেই লোহা যেমন পাচার হচ্ছে এলাকার ছোট-ছোট স্পঞ্জ আয়রন কারখানায়, বিভিন্ন যানবাহনে করে ভিন্ প্রদেশেও যাচ্ছে।
সোহরাব আলি


লোহা চুরির কারবার চলছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।
 
অজয় নন্দ


কোথাও লোহা চুরি হচ্ছে খবর পেলেই বন্ধ করে দেব।
 
হিরাপুরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, নরসিংহবাঁধে প্রদীপ, রহমতনগর ও শান্তিনগরের সীমানায় বিশু, রামবাঁধে গিয়াসুদ্দিন, রহমতনগরের আকবর মাঠের কাছে ওয়েলডিংয়ের দোকানের পিছনে রাজুর নেতৃত্বে চলছে লোহার ডিপো। দামোদরের ও পারে পুরুলিয়ার মধুকুণ্ডায় একটি বন্ধ মেটাল কারখানা ও ইস্কোর কারখানা থেকে ওই ডিপোগুলিতে মাল আসছে। তৃণমূল নেতা শিবদাসনের আক্ষেপ, “বানর্পুর মোড় থেকে চিত্রা মোড় পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে লোহাচোরদের ডেরা। আমরা পুলিশকর্তাদের জানালেও তারা উদাসীন। বার্নপুর সমাজবিরোধীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠছে। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। দলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও বিষয়টি জানাব।”
স্থানীয় সূত্রের খবর, কুলটির চলবলপুরে ডাকু, কেন্দুয়াবাজার হাসনাবাদে গয়নার বাড়ির পাশের ডিপোয় লোহা কেনাবেচা চলছে। নিয়ামতপুরে একটি পেট্রোল পাম্পের পিছনে গুলবাহারের ডিপো চলছে। লোহা আসছে কুলটি গ্রোথ ওয়ার্কস-সহ নানা এলাকা থেকে। রাধানগরের কামুয়ার ইসিএলের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতেও চলছে অবৈধ লোহার ডিপো। অভিযোগ, অন্ডালের বনবহাল ফাঁড়ি এলাকার বহুলায় ডিপো চলছে যুগল, রাজু, গৌতমের নেতৃত্বে। ছাতাডাঙাতেও ডিপো চালায় যুগল। সঙ্গে রয়েছে বাবুরাম।
জামুড়িয়ার বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, ডোবরানা মোড়ে পুলিশের কেন্দা ফাঁড়ি থেকে শ’দেড়েক ফুট দূরে চলছে অজয় ও প্রদীপের ডিপো। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, কেন্দার পরিত্যক্ত বাঙ্কার ও ৮ নম্বর বন্ধ পিট থেকে কাটা লোহা এনে সেগুলিতে জমা করা হয়। এর পর জুড়া নামে এক জন তা পৌঁছে দেয় পাঞ্জাবি মোড়ে গফর এবং কাজোড়ায় ডালিমের ডিপোয়। সেখান থেকে তা চলে যায় বিভিন্ন কারখানায়। বাদ বাকি লোহা কিনে নেয় দুর্গাপুরের ভিড়িঙ্গির মোসা। জামুড়িয়ার ব্যাঙ্কপাড়ায় শামিম, পেট্রোল পাম্পের কাছে সঞ্জয়, যাদুডাঙায় চন্দন, শ্রীপুরে ছাঙ্গুয়া, মিঠাপুরে গফর এবং এ বি পিটে উমেশ কারবার চালায়। পিকআপ ভ্যান বা লরিতে সেখান থেকে প্রথমে মহাজনের কাছে, তার পরে ঝাড়খণ্ড বা কলকাতার বজরঙ্গী মার্কেটে যায় লোহা।
রানিগঞ্জে রনাইয়ে ইদগা এলাকার গুজা ও নিমচার উপেন্দ্র ডিপো চালায় বলে অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ঝাটিডাঙা, ৩ নম্বর ধাওড়া ও কুমারবাজারে ডিপো চালায় ইদু, রাজি ও কালি। সারা দিনই এদের রেলমাঠে বসে থাকতে দেখা যায়। রাতে মালগাড়ি থেকে চুরি করে পাচার করা হয় আকরিক লোহা। তপসি পেট্রোল পাম্পের কাছে নৌশাদ ও রেললাইনের কাছেই শম্ভু ও মহেশ ডিপো চালায়।
দুর্গাপুরও কম যায় না। স্থানীয় সূত্রের খবর, এনটিপিএস থানার বিধাননগর এলাকায় ঝরনাপল্লিতে সঞ্জয়, কোকওভেন থানার শ্যামপুরে বুড়ো ও কার্তিক, অঙ্গদপুরে জ্ঞানী, কাদা রোডে গোপাল, ভিড়িঙ্গিতে মোসা, বেনাচিতির মসজিদপাড়ায় সাহেব, প্রান্তিকা বস্তিতে মাহিদ, এএসপি মেন গেটে বিজয়, ডিটিপিএস এলাকায় পদারতের নেতৃত্বে চলছে লোহার ডিপো। অন্ডালের ডিভিসি ও ডিটিপিএস এলাকার বিভিন্ন বন্ধ কারখানা থেকে লোহা কেটে এনে সেগুলিতে জমা করছে চোরেরা।
আসানসোল উত্তরের বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, ২ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরেই গাড়ির শোরুমের পাশে প্রকাশ্যে চোরাই লোহার ডিপো চালাচ্ছে রাজু। শীতলা মুচিপাড়ায় রঞ্জিত, পলাশডিহা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে সুরেশ, সালানপুরের দেবীপুরে রঞ্জিত, দেন্দুয়ায় টাব্বুর ডিপোও চলছে রমরমিয়ে। চিত্তরঞ্জন থেকে সালানপুরে প্রভাবশালী লোহাচোর ‘রিং মাস্টার’ পান্নাকুমার। আসানসোলের রেলপাড়েও চলছে অজস্র ছোট ডিপো। এর মধ্যে রয়েছে মেহবুবের নেতৃত্বে ‘থ্রি স্টার’-এর ডিপোও। একদা সিপিএম-আশ্রিত কুরবানের ছেলে আব্বাসও সেখানে কারবার চালাচ্ছে। আসানসোল দক্ষিণে মোর্গাশোলে দিলীপ, রাঙানিয়াপাড়ায় আরিফ, শাহিদ মার্কেটের কাছে বাহিদের ডিপোও যথেষ্ট সক্রিয়।
আসানসোলের সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরীর অভিযোগ, “ইস্কো-কে কেন্দ্র করে গত এক বছরে বিপুল অঙ্কের টাকার লোহা চুরি হয়েছে। সিআইএসএফের ভূমিকা ন্যক্কারজনক।” ইস্কোর আধুনিকীকরণের কাজ ইতিমধ্যেই প্রায় শেষের দিকে। পুরনো পরিকাঠামো ভাঙার জন্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকার দরপত্র ডাকা হবে। তা নিয়েও সমস্যার আশঙ্কা রয়েছে বলে ইস্পাত মন্ত্রকে জানিয়েছেন সাংসদ। ইসকো কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও কথা বলতে চাননি। ইস্কোর সিআইএসএফের ডিআইজি অনিলকুমারের দাবি,
বংশবাবুর দাবি, “রানিগঞ্জের বার্নস কোম্পানির লালকুঠির সব যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপুরের এমএএমসিতেও চলছে ব্যাপক লোহা কাটা। স্থানীয় বহু মানুষ অভিযোগ করছেন, পুলিশ-প্রশাসন সরাসরি চুরিতে যুক্ত। কর্তৃপক্ষের তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আসানসোলের সেন র্যালে কারখানার গোটা পরিকাঠামো কারা কেটে বিক্রি করে দিল, তা-ও খুঁজে বের করতে হবে।” তবে পুলিশ কমিশনার বলেন, “কোথাও লোহা চুরি হচ্ছে বলে খবর পেলেই আমরা তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.