এ যেন অনেকটা রোগী মারা যাওয়ার পরে নাড়ি দেখা শুরু করার মতো ঘটনা। চিকিৎসক যে রোগীর অবস্থা সঙ্কটজনক বলে জানিয়ে দ্রুত পরীক্ষানিরীক্ষার পরামর্শ দিলেন, সেই রোগীকেই পরীক্ষার জন্য আসতে বলা হল এক বছর পরে। এর জেরে রোগ সময় মতো ধরা না পড়া এবং তার জেরে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে রাজ্যের সব চেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল, এসএসকেএমের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য ভবনে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে সংশ্লিষ্ট রোগীর আত্মীয়েরা জানিয়েছেন, সময় মতো পরীক্ষা হলে রোগ ধরা পড়ত এবং চিকিৎসাও শুরু করা যেত। তা না হওয়ায় কার্যত বিনা চিকিৎসায় ওই রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
এটি একেবারেই বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয় বলে মনে করছেন এসএসকেএমের কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ। তাঁরা জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের কাছে এমন অজস্র অভিযোগ জমা রয়েছে। যেমন, চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছেন ইকোকার্ডিওগ্রাম করাতে হবে। বিষয়টি যে জরুরি, উল্লেখ করে দিয়েছেন সে কথাও। কিন্তু সেই ‘জরুরি’ পরীক্ষার জন্য হাসপাতাল রোগীকে ‘ডেট’ দিয়েছে আট মাস পরে। অন্তঃসত্ত্বা মহিলার হৃদ্রোগ ধরা পড়ায় তাঁকেও ওই একই পরীক্ষা করাতে বলেছিলেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। কিন্তু ওই মহিলাকে যে ‘ডেট’ দেওয়া হল, ততদিনে তাঁর প্রসব তো হয়ে যাবেই, এমনকী সেই সন্তানেরই বয়স হয়ে যাবে সাত মাস। এখানেই শেষ নয়, কার্ডিওলজির আউটডোরে দেখানোর পরে এক রোগীকে বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। ওই পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে সেই ভিত্তিতেই পরবর্তী চিকিৎসা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু অন্যান্য পরীক্ষা হয়ে গেলেও তাঁকে ইকোকার্ডিওগ্রামের ‘ডেট’ দেওয়া হয়েছিল ন’মাস পরে।
ন’মাস পরে তিনি যখন এলেন, তখন জানা গেল যন্ত্র খারাপ। ক্ষুব্ধ ওই রোগীর আত্মীয়েরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি নিয়ে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছেন।
কেন এমন অব্যবস্থা? কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক তথা ‘ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিও-ভাস্কুলার সায়েন্সেস’-এর অধিকর্তা অরূপ দাস বিশ্বাস বলেন, “যন্ত্রের সংখ্যা কম। তাই দেরি হয়ে যায়। যন্ত্র বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।” হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জানিয়েছেন, ইকোকার্ডিওগ্রাম যন্ত্র এই মুহূর্তে মাত্র দু’টি। স্বাস্থ্য ভবনে বারবার যন্ত্রের সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলেও ফল হয়নি। হাসপাতালের এক কর্তা বলেন, “দু’টি যন্ত্রের একটিতে ইনডোরের রোগী এবং শিশু রোগীদের পরীক্ষা হয়। অন্যটি আউটডোরের জন্য বরাদ্দ। যেহেতু পুরনো যন্ত্র, তাই দিনে ৩০টির বেশি পরীক্ষা করা যায় না। অথচ, দিনে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জনের পরীক্ষা প্রয়োজন হয়। সে কারণেই অপেক্ষা দীর্ঘ হচ্ছে। নতুন যন্ত্র এলে এক-একটি যন্ত্রেই ৭০ থেকে ৮০ জনের পরীক্ষা করা যাবে।”
সরকারি হাসপাতালে সব সময়েই বিপুল রোগীর চাপ। সেই তুলনায় পরিকাঠামো কম। তাই কম খরচে বা দরিদ্র রোগীদের ক্ষেত্রে নিখরচায় পরীক্ষা করানোর জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হয়। কিন্তু যে রোগের সঙ্গে মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করছে, সেই হৃদ্রোগের পরীক্ষার তারিখ পেতে বছর ঘুরে যাওয়ার ঘটনা যে অস্বাভাবিক, তা মেনে নিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ইদানীং টাকার অভাবে প্রকল্প আটকে থাকে না। থাকে সদিচ্ছার অভাবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসেকরা যদি উদ্যোগী হন, তা হলে ফাইল দ্রুত নড়ে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই উদ্যোগই চোখে পড়ে না। তবে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই যন্ত্র বাড়বে।” |