জয়ের খবরে উচ্ছ্বাস-আবেগ কীর্ণাহারেও
পুজোয় আসবেন প্রণব, আশায় মিরাটি
কাল থেকেই কীর্ণাহার চৌরাস্তা-সহ বিভিন্ন মোড়ে ঝুলছিল ‘রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আন্তরিক অভিনন্দন’ জ্ঞাপক বিভিন্ন ভঙ্গিমার কাট-আউট। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতে তখনও ঢের দেরি। কিন্তু এলাকার মানুষ জানতেন, মিরাটির মুখোপাধ্যায় পরিবারের ওই সদস্যই দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে বসটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
প্যান্ট-শার্ট এবং টাই পরিহিত একটি কাট-আউট দেখে রবিবার সকালে স্থানীয় কিছু যুবক নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলেন, ধুতি-চাদরের পাশাপাশি কোট-টাইয়ে প্রণববাবুকে কেমন সাহেব সাহেব লাগছে দেখছিস? বাংলা ভাষার পাশাপাশি ছাত্রাবস্থা থেকেই ইংরেজিতে প্রণববাবুর দক্ষতা কম ছিল না বলে জানালেন তাঁর স্কুলের সহপাঠী বলদেব রায়। কীর্ণাহার শিবচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম ও দশম শ্রেণিতে বলদেববাবু সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিলেন প্রণববাবুকে। তখন যিনি সহপাঠীদের কাছে শুধুই পল্টু। বলদেববাবু বলছিলেন, “বাংলা ভাষার চেয়ে পল্টুর ইংরেজিতেই দক্ষতা বেশি ছিল বরাবর। আমাদেরও ইংরেজি বলতে উৎসাহ দিত।”
হাসি ‘প্রণবের’। কান্নায় ‘সাংমা’।
জুবুটিয়ায়। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।
কীর্ণাহারে দিদির বাড়িতে এলে এই চেয়ারে
বসেন প্রণববাবু। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
কীর্ণাহারে এ দিন সকাল থেকে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের ভিড়। ওবি ভ্যানের আনাগোনা। এই এলাকার মানুষের কাছে অবশ্য এই দৃশ্য খুব নতুন নয়। কারণ প্রণববাবু কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী থাকাকালীনও বারবার সংবাদমাধ্যমে এসেছে এখানে। কিন্তু, এ বারেরটা কোথায় যেন আলাদা। আসলে রাষ্ট্রপতির গ্রামের বাড়ি ‘কভার’ করতে সংবাদমাধ্যমের উৎসাহও ছিল বেশি।
উৎসাহ আরও বেশি ছিল কীর্ণাহার-মিরাটির কংগ্রেস কর্মীদের। প্রণববাবুর রাষ্ট্রপতি হওয়ার খবরটা তাঁর মিরাটি গ্রামের বাড়িতে সাংবাদিকদের মাধ্যমে পৌঁছয় বিকেল ৪টে নাগাদ। কিন্তু তার আগেই সেখানে শুরু হয়ে গিয়েছিল বিজয় উৎসব। বিকেল ৩টে থেকেই প্রণববাবুর ছবি-সহ ঢাল-ঢোল-কাঁসি-বাঁশি নিয়ে পথ পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়েছিলেন গ্রামবাসী এবং কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরা। সবুজ আবিরে মিরাটি থেকে বলরামপুর পর্যন্ত রাস্তা কার্যত ঘাসের মতো দেখাচ্ছিল। ব্রাহ্মণপাড়া গ্রাম হয়ে সেই মিছিল যায় কীর্ণাহার পর্যন্ত।
মিরাটিতে পোস্টার। —নিজস্ব চিত্র।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফল বেরোতেই মিরাটি গ্রামের বাড়িতে তারস্বরে বেজে ওঠে ঢাক-ঢোল-খোল-করতাল। আবির ছড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে মিছিল। আট থেকে আশিসব বয়সের মানুষই পা মিলিয়েছিলেন মিছিলে। মিরাটিরই বৃদ্ধা আদুরি বায়েন, লতিকা দাস বা সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সুবোদ বাগদিরা বললেন, “আজ আমাদের গর্বের দিন। দেশের সর্বোচ্চ পদে বসেছেন আমাদেরই গ্রামের লোক। আনন্দ ধরে রাখতে পারছি না।”
সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের আনাগোনায় মাঝেমধ্যেই হতচকিত হয়ে পড়ছিলেন নলহাটির লোহাপুরের বাবর আলি কিংবা মুর্শিদাবাদের বেলুইপাড়ার মহম্মদ সামসুদ্দিন শেখরা। টানা তিন মাস ধরে তাঁরা মিরাটিতে প্রণববাবুর বাড়ির দুর্গামণ্ডপ তৈরি করছেন। প্রণববাবুর ঘনিষ্ঠ স্থানীয় কংগ্রেস নেতা রবি চট্টরাজ বলেন, “ফি বছরই বন্যার জল দুর্গামন্দির চত্বরে ঢুকে যাওয়ায় পুজো দেখতে গ্রামবাসীদের অসুবিধা হত। এ জন্য মাটি ভরাট করে চত্বর উঁচু করা হয়েছে। এর ফলে ছাদ ভেঙে মন্দিরও নতুন করে গড়া হচ্ছে।” তিনি জানান, প্রণব-পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশ অনুযায়ী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে হবে। প্রণববাবু মন্দিরের রং হাল্কা গৈরিক হবে বলে নির্দেশ দিয়েছেন।
এ দিন সকালেই জুবুটিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় প্রণববাবুর নাম লেখা পোস্টার নিয়ে এলাকা পরিক্রমা, বাজি ফাটানো, প্রণববাবুকে নিয়ে গান, এমনকী প্রণববাবুর প্রতিদ্বন্দ্বী পূর্ণ সাংমা ও তাঁকে নিয়ে কার্টুনও ছিল। সেখানে সাংমাবেশি একটি বাচ্চাকে কাঁদতে এবং জয়ী প্রণববাবুকে হাসতে দেখা যায়। বস্তুত, মিরাটি-কীর্ণহারের বাসিন্দারা বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁদের এলাকার লোক বিশাল ব্যবধানে জিততে চলেছেন।
মিষ্টি মুখ
সিউড়িতে ছবিটি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। রামপুরহাটে সব্যসাচী ইসলামের তোলা ছবি।
শুধু, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, ধর্মেও প্রণববাবুর অবাধ বিচরণ রয়েছে বলে মনে করেন তাঁর বাড়ির কুলপুরোহিত, স্থানীয় ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বিপদতারণ বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের বাবার সঙ্গে ১৭ বছর এবং বাবার মৃত্যুর পরে পাঁচ বছর, মোট ২২ বছর প্রণববাবুর গ্রামের বাড়ির দুর্গাপুজো-সহ অন্যান্য পুজো করেছেন বিপদতারণবাবু। অষ্টমীর দিন প্রণববাবুকে কাছ থেকে চণ্ডীপাঠ করতেও তিনি দেখেছেন। তাঁর কথায়, “প্রণববাবুর সংস্কৃত উচ্চারণের কাছে বহু পেশাদার পুরোহিতও হার মানবেন। পুজোর আচারবিধি নিয়েও উনি অনেক সময় যুক্তি দিয়ে আমাদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। এত দিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পাশে বসে পুজো করেছি। রাষ্ট্রপতি প্রণববাবুর পাশে বসে পুজো করা হবে কি না, তা জানি না।”
তবে গ্রামের লোকের দৃঢ় বিশ্বাস, রাষ্ট্রপতি হলেও প্রণববাবু যাবতীয় ব্যস্ততাকে দূরে সরিয়ে রেখে এ বারের দুর্গাপুজোতেও গ্রামে আসবেন। করবেন চণ্ডীপাঠও।
উচ্ছ্বাস-আবেগের একই ছবি এ দিন ছিল মিরাটি-কীর্ণাহারে। কীর্ণাহারে প্রণববাবুর দিদির বাড়ি লাগোয়া কংগ্রেস ভবনে ছিল এলাকার কংগ্রেস কর্মীদের ভিড়। সবুজ আবিরে পরস্পরকে রাঙিয়ে দিচ্ছিলেন দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা। কিন্তু চোখে পড়েনি কংগ্রেসের দলীয় পতাকা। বরং জাতীয় পতাকাই শোভা পাচ্ছিল চারপাশে। প্রণববাবুর দিদির বাড়ির সামনেও অনুগামীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
উল্লাস কংগ্রেস কর্মীদের। দুবরাজপুরে। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত।
বাচ্চা থেকে বুড়ো, সকলেই একে একে এসে দেখা করে গিয়েছেন প্রণববাবুর অশীতিপর দিদি অন্নপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আর অন্নপূর্ণাদেবী আত্মীয়-পরিজনদের নিয়ে কখনও টিভির সামনে চোখ রেখেছিলেন, কখনও বা প্রদীপ আর ধূপ-ধুনো দিচ্ছিলেন ঠাকুর-দেবতার ছবির সামনে। নিজে মিষ্টি খেয়েছেন। খাইয়েছেনও সকলকে। কথা বলেছেন সবার সঙ্গে। সংবাদমাধ্যমকে নিরাশ করেননি একবারের জন্যও। ক্যামেরার সামনে বারবার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁর নিজের কথায়, “পল্টু যতবারই মিরাটি এসেছে, বেশির ভাগ সময়েই যাওয়ার পথে আমার বাড়িতে ঢুকেছে। অসুবিধা হলে সরাসরি মিরাটি গেলেও ফেরার পথে একবার এখানে এসে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছে। রাষ্ট্রপতি হয়েও তার অন্যথা ও করবে না। সময়-সুযোগ পেলেই আমিও রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে ঠাকুরের আশীর্বাদি ফুল দিয়ে আসব। যাতে, ও যে দায়িত্ব পেয়েছে, তা যেন ভালভাবে পালন করতে পারে।”
শেষ যে দিন মিরাটি এলেন (রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসাবে নাম ঘোষণা হওয়ার পরে পরেই), সে দিনও কীর্ণাহারে গিয়ে দিদির আশীর্বাদ নিয়েই বাড়িতে ঢুকেছিলেন দেশের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রকপতি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার আগেও দিদির পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন। অন্নপূর্ণাদেবীর আজ সে কথাই বারবার মনে পড়ছিল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.