|
|
|
|
|
|
|
খেলাধুলা ১... |
|
|
নক আউট: বক্সিং |
অলিম্পিক। মহিলা বক্সিং-য়ে দেশের একমাত্র প্রতিনিধি। প্রতিপক্ষ কখনও মানুষ।
কখনও সমাজ।
আর তাঁর দিকে তাকিয়ে রাসবিহারী মোড়ের অচেনা কিছু বক্সার মেয়ে।
লন্ডনের রিং-য়ে নামার আগে
মেরি কম কথা বললেন শতরূপা বসু-র সঙ্গে |
বেজেই যাচ্ছে ফোনটা। এক বার। দু’বার। তিন বার। কী মুশকিল। কথা ছিল এই সময়েই ফোন করবার। তাহলে? আবার প্র্যাকটিসে চলে গেল? নাকি ফোনটা ‘নীরব’ মোড-এ রাখা? নাকি স্রেফ মেজাজ বিগড়ে আছে? তাহলেই হয়েছে। আজ আর হল না। সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতেই...“সরি, সরি। ছেলের সঙ্গে কথা বলছিলাম অন্য ফোনে। আমি এখন লিভারপুলে। জোর প্র্যাকটিস করছি। বিদেশি কোচের কাছে। ওদিকে মণিপুরে আমার মাসতুতো বোন আমার যমজ ছেলেদের দেখাশোনা করছে। আমি না থাকলে ও-ই করে। তাই এত ফোন। এত প্ল্যানিং।”
এক নিশ্বাসে বলে গেলেন মা। মায়ের নাম এম সি মেরি কম। বা স্রেফ মেরি কম।
মহিলা বক্সিং-এ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। পর পর পাঁচ বার। বক্সিং দুনিয়ার ‘ম্যাগনিফিসেন্ট মেরি’।
খেলার কুরুক্ষেত্রর জন্যে গ্লাভসে শান দিচ্ছেন। অলিম্পিক ২০১২। এই বছর প্রথম বার অলিম্পিকে মহিলা বক্সিং অর্ন্তভুক্ত হল। আর ভারত থেকে মহিলাদের মধ্যে একমাত্র মেরি-ই কোয়ালিফাই করেছেন।
গাণ্ডিব তৈরি। টঙ্কার তো শুনেইছে তামাম দুনিয়া। মাছের চোখটা জ্বলছে। অর্জুনের দৃষ্টি স্থির। অর্জুন? দূর! তাকে তো কবেই কব্জা করা হয়ে গিয়েছে! অর্জুন পুরস্কার তো এখন কেবল বাড়ির শো’কেসের শোভা বাড়াচ্ছে।
বাকি শুধু তির বেঁধানো। থুড়ি, ফাইনাল পাঞ্চ। চিত্রাঙ্গদার।
“বাড়িতে থাকলে তো সব আমি নিজেই করি।” সব মানে? “মানে, রান্না, কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার করা, ছেলেদের দেখা-শোনা। আসলে চুপ করে বসে থাকতে পারি না। ভীষণ অস্থির,” নিরুত্তাপ গলা মেরির। আর প্র্যাকটিস? “সে তো চলছে সেই ১১ বছর ধরে। প্র্যকটিস না। স্ট্রাগল বলা ভাল। স্ট্রাগল, স্ট্রাগল, স্ট্রাগল...” বলতে বলতেই হাসির পশলা।
হাসতে তিনিই পারেন। বাবা মণিপুরের চাষি। মা, চার ভাই-বোন নিয়ে টানাটানির সংসার। বাড়ির কাজের অভ্যেস সেই ছোটবেলা থেকেই। আরও একটা অভ্যেসও ছিল। খেলাধুলো। মারপিটও। যে কারণে মেয়ের বক্সিংয়ের সাধ শুনে আঁতকে উঠেছিলেন বাবা। হেসেছিল পাড়া। “একঘরে করে দিয়েছিল সবাই। বাড়ির লোকজন। আত্মীয়স্বজন। পাড়া-পড়শি। পদে পদে। প্রথমে, মেয়ে হয়ে বক্সিং করবে? তার পর, স্ত্রী হয়ে বক্সিং করবে? আর এখন, মা হয়ে বক্সিং করবে? “এই বিপরীত কথাগুলোই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওদের। আর আমার নিজের স্বপ্নকে সফল করার প্রধান অস্ত্র। মা’কে কাজে সাহায্য করতে করতেই স্বপ্ন দেখতাম বক্সিংয়ের। এক একটা তীব্র ঘুঁসিতে উড়ে যাচ্ছে প্রতিপক্ষ। কী করব? মহম্মদ আলী আমার আদর্শ যে,” হাসতে হাসতে বলছেন বছর আঠাশের মেরি।
হাসির পেছনে চোখের জল, বাধা-বিপত্তি, সমাজের চোখ-রাঙানির বিরুদ্ধে তাঁর ছোঁড়া উত্তরটা অবশ্য আজ সবারই জানা।
বলা বাহুল্য, মেরি ‘চিত্রাঙ্গদা’ পড়েননি। না কি ওখানকার সব মেয়ের মধ্যেই বইছে সেই যোদ্ধা রানি ‘মণিপুরনৃপদুহিতা’র রক্ত? |
|
অলিম্পিকের প্রস্তুতি: মেরি কম। ছবি: এএফপি |
বিকেল সাড়ে চারটে। রাসবিহারী মোড়ের কাছে সাউথ ক্যালকাটা ফিজিকাল কালচার অ্যাসোসিয়েশন ক্লাব। জ্যাবজ্যাবে গরম। গেটের ভেতর ক্লাবের বক্সিং রিং’এ একমনে কাজ করছে প্রিয়ঙ্কা। ১৫ বছরের কালো লম্বা চুল কোমরে থমকেছে আঁটো বিনুনির শাসনে। শর্টস-টি-শার্ট। পায়ে স্নিকার্স। হাতে ঝাঁটা। মুখ থমথমে। “গত কাল দশ মিনিট দেরি হয়ে গিয়েছিল ঢুকতে। বকা খেয়েছি। আজ সময়মতো এসেছি। কিন্তু এখনও কারও পাত্তা নেই। কোনও কাজ নেই। তাই ঝাঁট দিয়ে রাখছি। আমি টিম ম্যানেজার তো,” কপালে বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে থামল প্রিয়ঙ্কা। তার গ্লাভ্সে এখনও পর্যন্ত রাজ্য স্তরে দু’টো সোনা, একটা রুপো। জাতীয়তে একটা রুপো, একটা ব্রোঞ্জ।
শিয়ালদহ থেকে ট্রেন-পথে প্রায় ৪৫ মিনিট দূরে নুঙ্গি থেকে রোজ প্র্যাকটিসে আসে প্রিয়ঙ্কা। কথা বলে কম। সঙ্গে মা। বক্সারের সঙ্গে রক্ষী! তীক্ষ্ন চোখে মা’কে এক ঝলক দেখে নিয়ে প্রিয়ঙ্কার জবাব, “কী করব। একা ছাড়ে না।” প্রিয়ঙ্কার বাবা রাজমিস্ত্রি। মা বাড়ির কাজের ফাঁকে বিড়ির বাক্স তৈরি করেন। মেয়ের ঝাঁট দেওয়ার ধরনে অভ্যেসের ছাপ স্পষ্ট। হবে না-ই বা কেন? তার রুটিনে ভোর ছ’টায় উঠে বাড়ির কাজে মা’কে সাহায্য করা যে মাস্ট। তার পর আছে স্কুল, স্কুল শেষে প্র্যাকটিস। নিজের পড়াশোনা। এ বছর মাধ্যমিকের জন্য মাস দু’য়েক প্র্যাকটিস কামাই হয়ে গেছে। তাতে হারানো সময় মেক-আপ করবার তাগিদ কয়েক’শ গুণ গেছে বেড়ে। “সারা দিন খাটনির পর বাড়ি ফিরে আর কাজ করতে চায় না,” মায়ের গলায় মৃদু সহানুভুতি। বছরখানেক আগেও এই সহানুভূতির বদলে ছিল বিরক্তি। শেষ পর্যন্ত মেয়ের প্রবল জেদ আর অধ্যবসায়ের কাছে হেরে গেছেন বাবা-মা। পরিস্থিতি একটু শান্ত মেয়ে গত বছর রাজ্য চ্যাম্পিয়ান হওয়ায়। সোনা না জিতলে আর খেলতে দিতেন? মায়ের উত্তরের আগেই, মাটির দিকে তাকিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে মেয়ের উত্তর, “না জিতলেও খেলা ছাড়তাম না।” আপাতত মেরি কমের দিকে তাকিয়ে প্রিয়ঙ্কা। “আমাদের মতোই তো লড়াই করে উঠেছে। ওর গল্পে শক্তি পাই আমি।” যদি অলিম্পিকে পদক জেতে? “খুব বড় করে পুজো দেব। আর নিজের ওপর বিশ্বাসটাও দশগুণ বেড়ে যাবে,” বলছে প্রিয়ঙ্কা।
বাকি মেয়েরা এসে গিয়েছে। প্রায় জনা ২০। বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের। সংলগ্ন মাঠে তাদের জগিং প্র্যাকটিসে পাঠিয়ে দিলেন রাজিয়া। রাজিয়া শবনম। ইকবালপুরে গোঁড়া সমাজের মধ্যে দিয়ে বোরখা পরে বক্সিং প্র্যাকটিসে আসতেন। সেটা ১৯৯৭-৯৮। রিং-এ এসে পোশাক পালটাতেন। রাজ্য, জাতীয় স্তরে জিতেছেন প্রচুর পদক। প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক বক্সিং রেফারি হয়ে ঘুরেছেন পৃথিবীর নানা জায়গা। এখনও ভারতের একমাত্র মহিলা টেকনিকাল কোচ। মনে করেন বক্সিং পুরোদস্তুর মেয়েদের খেলা। “এটা শরীর গরম, মাথা ঠান্ডার খেলা। কত দূর নিজেকে ঠেলে নিয়ে যেতে পারি, লড়তে পারি, তার পরীক্ষা। নিজেকে ছাড়া কাউকে দোষ দিতে পারবে না। নিজের সম্মান নিয়ে হারতে শিখতে হবে। যেটা আসলে জীবনের শিক্ষা,” বলছেন রাজিয়া। প্রিয়ঙ্কাদের ‘খিদ্দা’।
একটু দূরে আজমিরা খাতুন। প্রায় প্রিয়ঙ্কার সমবয়সি। সিট-আপস্-এ ব্যস্ত।
ক্যানিং-এ বাড়ি। খিদিরপুরের বাড়িতে মা-বাবা, আট ভাই-বোনের জায়গা কুলায় না। তাই বাধ্য হয়ে মা’কে নিয়ে ক্যানিং পাড়ি। “রোজ চারটের সময় উঠি। বাড়ির কাজ করতে। তার পর মাদ্রাসায় যাই।” রোজ চার ঘণ্টা যাওয়া-আসা করে প্র্যাকটিস? “সে তো করতেই হবে। অভ্যেস হয়ে গেছে। মার যেমন খাই, মার দিতেও তো দারুণ লাগে,” আজমিরার উত্তর। জাতীয়স্তরে রুপো-জয়ী আজমিরা। তার চোখেও খেলছে মেরির স্বপ্ন।
শক্তিশালী মায়েরাই এক শক্তিশালী দেশের উৎস। এই ‘স্লোগানে’ই বিশ্বাস করেন অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় বক্সিং ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। এই খেলার সঙ্গে তাঁর চলা ৪৪ বছর। রাজ্য এবং পূর্বাঞ্চলীয় বক্সিং সংস্থার সভাপতি। শ্যেন দৃষ্টি ক্লাবে প্র্যাকটিস করতে আসা প্রত্যেক মেয়ের প্র্যাকটিসের ওপর। গাইড করেন। ইন্ধন জোগান আরও ভাল করবার জন্য। ক্লাবে এসে এবং প্র্যাকটিসের শেষে মেয়েরা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে যায় তাঁকে। “এত ট্যালেন্টেড, লড়াকু এই মেয়েগুলো। কে বলতে পারে, এরাই এক দিন মেরি কমের সাফল্য পাবে না?” স্বপ্ন তাঁর।
এক পিঠে রূঢ় বাস্তবের রক্তাক্ত পাঞ্চ। অন্য পিঠে নিজের ওপর চূড়ান্ত বিশ্বাস, অধ্যবসায় আর জেদকে সম্বল করে স্বপ্নে উড়ান। চোখের সামনে মেরি কমের লড়াই। আর সাফল্যের জিয়নকাঠি। “ও যদি পারে আমিও পারব। জিততে আমাকে হবেই,” মন্ত্রে এগিয়ে যাওয়া। শুধুই কি ঘুসোঘুসির খেলা? না কি নিজের সমস্তটা নিংড়ে দিয়ে প্রখর বাস্তবের মারকে উল্টে এক হাত নেওয়া? সামান্য অবসরে সাইকেল নিয়ে ঘোরে প্রিয়ঙ্কা। একা-একা। মাঝে-সাঝে সিনেমা। ‘ইকবাল’ দেখেছ? ‘মিলিয়ন ডলার বেবি’? ‘রেজিং বুল’? “না। আমি জ্যাকি চ্যান আর ব্রুস লি’র ফ্যান”। কী দেখো ওদের ছবিতে? “দেখি কত জোরে আর ক্ষিপ্রতায় ওঁরা প্রতিপক্ষকে মারেন।” ক্বচিৎ রোল, ফুচকা। সে কি! স্যার বকবে না? “স্যার জানেই না,” মুচকি হাসি। |
|
রাসবিহারী মোড়ের সাউথ ক্যালকাটা ফিজিকাল কালচার অ্যাসোসিয়েশন ক্লাবের বক্সার মেয়েরা। ছবি: সুমন বল্লভ |
“আমার সব খাবারই পছন্দ। মানুষের মাংস ছাড়া। ওটা কোনদিন খেয়ে দেখিনি তো!” হো হো করে হাসি মেরি কম-এর। কিন্তু এখন কঠোর ডিসিপ্লিন। কোনও খাবারই এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই।
আর বাড়িতে? স্বামী ওমলার কম-এর নাকটা আস্ত আছে তো? “আমি লড়ি একমাত্র রিং-এ। বাড়িতে নয়,” ওপার থেকে উত্তর আসে শান্ত গলায়। আবার হাসি।
অলিম্পিয়ান বিজেন্দ্র সিংহ’র সঙ্গে দেখা হয় নিশ্চয়ই? “হুম। হয়। আমার কাছে ওর ফোন নম্বর নেই। প্রতিযোগিতায় কয়েক বার দেখা হয়েছে। তখন আমরা একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানিয়েছি।”
তিনি তো যুব আইকনও। নিরন্তর দারিদ্র, লাঞ্ছনা, দয়া-ভিক্ষার সমুদ্র পেরিয়ে যিনি স্বাদ নিয়েছেন বিশ্বের। “মানুষ মানে ইচ্ছাশক্তি। এটাই আমার জয়মন্ত্র। তার সঙ্গে যোগ করুন জেদ আর ডিসিপ্লিন। তাহলে মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই,” বলছেন ২০১২-র লন্ডন অলিম্পিকে যোগ দিতে যাওয়া ভারতের এক মাত্র মহিলা বক্সার।
গত বছর, ছেলে নাইনাই-এর হার্ট সার্জারি হয়েছিল। ছেলে হাসপাতালে ভর্তি থাকতেই অসম্ভব মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে মেরি এশিয়ান কাপ উওমেন’স বক্সিং টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিলেন টোকিওয়। ছেলেকে কথা দিয়ে গিয়েছিলেন সোনা জিতে আনবেন। কথা রেখেছিলেন। আর এ বার? “যদি জিতি,অবশ্যই ছেলেদের জন্যেই থাকবে আমার পদক। আর ঈশ্বরের জন্য”।
কোথায় গিয়ে যেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মেরি কম এক হয়ে যান কলকাতার এখনও অচেনা প্রিয়ঙ্কা, আজমিরা, তসলিমাদের সঙ্গে।
স্ট্রেট পাঞ্চ। হুক। আপার কাট।
গেম। ম্যাচ। |
|
|
|
|
|