|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি ২... |
|
আলোর সুন্দরী...
অন্ধকারের রাজপুত্র |
ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। নাইজেল আকারা। সেটের বাইরে আড্ডা।
জীবনের দুই ‘মুক্তধারা’। সিনেমার সন্ধিক্ষণে। সেখানে ছিলেন শতরূপা বসু |
পত্রিকা: এক জন সারাক্ষণ লাইমলাইটে থাকা সুপারস্টার। অন্য জন অন্ধকার থেকে উঠে আসা প্রাক্তন কয়েদি... এই দু’জনের এক সঙ্গে আসাটাই তো সব চেয়ে রোমহর্ষক স্ক্রিপ্ট...
নাইজেল: প্রথমেই যেটা আমার মনে হয়েছিল সেটা হল ম্যাডাম, মানে ঋতুপর্ণা, এক জন নামী অভিনেত্রী। আমি এমন একজনের সঙ্গে কাজ করব যিনি এই কাজে দুর্দান্ত। তার ওপর নিজেকে জাস্টিস করতে হবে তাঁদের কথা ভেবে যাঁরা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন... সেই মা’য়ের প্রতিও...
পত্রিকা: মা...?
নাইজেল: অলকানন্দা রায়। যিনি আমাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন। সেই চরিত্রটাই সিনেমায় ঋতুপর্ণা করেছেন। এই চিন্তাও কাজ করেছিল যে আমি সমস্ত কয়েদির প্রতিনিধি...সুতরাং আমাকে আমার বেস্ট দিতে হবে...
ঋতুপর্ণা: ও সত্যিই নিজের শ্রেষ্ঠটা দিয়েছে। আমি তো পুরো চমকে গিয়েছি। নাইজেল সামনে বসে আছে বলে বলছি না। ওর পারফর্ম্যান্সের কথা বলছি। নতুনদের কাছে ও একটা উদাহরণ। শিবু (পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) আমাকে বলেছিল, তোমাকে বিরাট একটা চমক দেব। আর আমি বলতাম আমার হিরোকে তো দেখাচ্ছই না...
(হাসি)
পত্রিকা: হিরোকে দেখে কী মনে হল?
ঋতুপর্ণা: অসম্ভব শার্প। দারুণ ফিচার্স। কিন্তু এত ভাল অভিনয় করবে ভাবিনি। আগে ও খুব কম কথা বলত।
নাইজেল: এখনও কম কথা বলি।
ঋতুপর্ণা: এখন তো তাও কথা বল। তখন মনে হয় ও খুব গুটিয়ে ছিল। |
|
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী |
পত্রিকা: নাইজেল, জেলে অলকানন্দা রায়ের পরিচালনায় কয়েদিদের করা ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ ছিল জীবনের থেরাপি। আর এটা অভিনয়। কতটা আলাদা?
নাইজেল: একেবারেই আলাদা। বিশেষ করে যখন আপনাকে ৬/৭ বার টেক দিতে হয়।
(ঋতুপর্ণার হাসি)
নাইজেল: একই অনুভুতি বার বার করে দেখাতে হয়।
ঋতুপর্ণা: আমার তো মনে হয় ও লুকিয়ে লুকিয়ে প্রিপারেশন নিত। (হাসতে হাসতে)
নাইজেল: কিছুই নিতাম না। আসলে ছোটবেলা থেকেই যা করি ফুল ডেডিকেশন দিয়ে করি। আর এই ছবির ওয়ার্কশপ করার সময় শিখেছিলাম যে বিশ্বাস করতে হবে তুমি ক্যামেরার সামনে বেস্ট। (হাসি)
ঋতুপর্ণা: (হাসি) দেখেছেন কী রকম আত্মবিশ্বাস?
পত্রিকা: আপনি নাকি ডাবিং করার সময় পর্যন্ত পকেটে খাবার নিয়ে আসতেন। যাতে খেতে খেতে কথা বলার অংশগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয়। এমনিতে ডাবিংয়ের সময় ওই আওয়াজ তো ফোলে আর্টিস্টরা করে থাকেন...
নাইজেল: কী করব! আগে তো কখনও করিনি এ সব। বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে তো ব্যাপারটাকে। ঋতুপর্ণাকে দেখতাম ডাবিং করতে...
পত্রিকা: ঋতুপর্ণার কোনও ছবি দেখেছেন?
নাইজেল: অনেকগুলো দেখেছি।
পত্রিকা: যেমন?
নাইজেল: ‘পারমিতার একদিন’...
ঋতুপর্ণা: (খুশিতে) ওওওওওওও...!
নাইজেল: আরও দেখেছি। নাম-ফাম অত মনে নেই।
পত্রিকা: ‘তৃষ্ণা’? ‘মার্ডার’?
ঋতুপর্ণা: ও আমার বাণিজ্যিক ছবি খুব একটা দেখেনি।
নাইজেল: এই তো সেদিন একটা ছবিতে দেখলাম গ্রামের মেয়ে সেজে রেললাইন ধরে দৌড়োচ্ছেন...
(ঋতুপর্ণার হাহা হাসি)
পত্রিকা: হিরো কে ছিলেন?
নাইজেল: হয় চিরঞ্জিত। নয় তাপস পাল।
পত্রিকা: প্রসেনজিতের সঙ্গে কোনও ছবি দেখেননি?
নাইজেল: ন্না।
(ঋতুপর্ণা চুপ)
ঋতুপর্ণা: আর ‘মুক্তধারা’?
নাইজেল: সেটা এখনও বলতে পারছি না। নিজের জিনিসকে কখনও ভাল বলতে নেই। অন্যরা বলবে। কিন্তু আপনাকে ভাল লেগেছে।
ঋতুপর্ণা: (হাসতে হাসতে) থ্যাঙ্ক ইউ নাইজেল।
পত্রিকা: সিনেমার অফার পাচ্ছেন না?
নাইজেল: না। এখনও পাচ্ছি না।
পত্রিকা: ঋতুপর্ণা নিশ্চয়ই নাইজেলকে রেকমেন্ড করবেন?
(নাইজেলের মৃদু হাসি)
ঋতুপর্ণা: ও যদি তখন অফার নেয়! (নাইজেলকে) আচ্ছা নাইজেল, তুমি যদি মেয়েদের হার্টথ্রব হয়ে যাও? মেয়েদের ফোন সামলাতে তোমার অবস্থা কাহিল। ফেসবুক রিকোয়েস্ট...
নাইজেল: ১২০০ ফ্রেন্ড
রিকোয়েস্ট আছে...
ঋতুপর্ণা: (চোখ গোল গোল করে) দেখেছেন? অলরেডি ১২০০ এসে গেছে...
নাইজেল: ওটা খালি ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ দেখে। ঘটনা হল, যে কেউ-ই তো রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারে। বাছাই তো আমার হাতে...
পত্রিকা: তা কাকে বাছলেন?
নাইজেল: এখনও বাছিনি। সময় পাইনি। এখনও জেলে কাটানো সেই ন’বছর নষ্ট সময় মেক-আপ করছি।
পত্রিকা: জীবন নিশ্চয়ই বদলেছে?
নাইজেল: অনেকটাই। মেক-আপ করতে শিখেছি। (হাসি) আগে মাঝে মাঝে নিজের ভাল লাগত বলে চোখে সুর্মা পরতাম। এখন ইন্টারভিউতে এসেই সুর্মা পরতে হচ্ছে! অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে। তাই একটু বেশি হাসতে শিখেছি।
ঋতুপর্ণা: সত্যি। আগে কম হাসত।
পত্রিকা: ঋতুপর্ণা আপনাকে কী কমপ্লিমেন্ট দিয়েছেন?
নাইজেল: উনি আমাকে কোনও কমপ্লিমেন্ট দেননি। আপনার সামনে শুনছি অনেক কিছু বলছেন...
পত্রিকা: আর নাইজেলের কমপ্লিমেন্ট? শিবপ্রসাদ বলছিলেন এই সিনেমা ঋতুপর্ণাকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে...
ঋতুপর্ণা: বেশি কথা তো বলে না। তার মধ্যেই বলেছে আমি নাকি একটা ট্রেডমার্ক। বাকিটা দর্শক বলবেন।
নাইজেল: কেন বলেছি সেটা বলুন। এক দিন ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় ঋতুপর্ণা আমাকে বললেন, ভাল তো। তোমার এত পাবলিসিটি হচ্ছে... তাতে আমি বলেছিলাম ‘আইএসআই’ মার্কা জিনিসের কোনও কভারেজ লাগে না। কিন্তু নতুন হারকিউলিস সাইকেলের লাগে!
(ঋতুপর্ণার হা হা হাসি...)
ঋতুপর্ণা: আসলে ও সত্যি ভাল কাজ করেছে। আপনারাও যখন দেখবেন একই কথা বলবেন। ও যে ভাবে সবাইকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে...
নাইজেল: আসলে এই সিনেমাটা অলকানন্দা’র সিনেমা। সব কয়েদি ওঁকে দেবী বলে পুজো করে।
পত্রিকা: বাল্মীকি আপনাকে এতটাই অনুপ্রেরণা দিয়েছে...
নাইজেল: বাল্মীকি নয়। অলকানন্দা রায়। (থেমে) কী জানেন? যখন আপনি জানেন কেউ আপনার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতেই পারেন না, তখন যদি কেউ ভাল ব্যবহার করেন তাঁর জন্যে তো একটা আলাদা অনুভুতি থাকবেই।
পত্রিকা: তার মানে বলা যায় যে নাইজেল আকারার জীবনের সেই ধ্রুবতারা হলেন অলকানন্দা রায়?
নাইজেল: ধ্রুবতারা মানে কী?
পত্রিকা: মানে, যে তারা পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে অলকানন্দার আসার আগে ও পরে নাইজেল এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।
নাইজেল: হুম। বলা যায় কেন?
তিনি তো তাই। উনি আসার পরেও হয়তো জীবন অন্য রকম ছিল। মানে সেই আগের মতো। তার পর পুরো পাল্টে গেল।
পত্রিকা: আগে কী রকম ছিল?
নাইজেল: নাস্তিক ছিলাম। ভাবটা ছিল ‘হু দ্য হেল ইজ গড’ যখন আমিই সব কিছু করতে পারি? পুলিশ হেপাজতে ছিলাম ৮৭ দিন। অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিল। এক ফোঁটাও কাঁদিনি। তার পর গেলাম জেলে। ভাবিনি কখনও কোনও কিছু ভাল করতে পারব।
ঋতুপর্ণা: আচ্ছা, নাইজেল আকারা, এই নামটার মধ্যে কী জুড়ে আছে? অনুশোচনা না গর্ব?
নাইজেল: এত হাই-ফাই বাংলা বললে আমি বুঝব না...
ঋতুপর্ণা: মানে বলতে চাইছি নামের সঙ্গে কোনও রিগ্রেট জড়িয়ে আছে? না প্রাইড?
নাইজেল: রিগ্রেটও নেই। প্রাইডও নেই। এই নামটা তো আমি জন্ম থেকেই বয়ে বেড়াচ্ছি। এখন তো হুট করে আমি নামটা পালটাতে পারব না। নাইজেল-এর মানে জানি...গুগল-সার্চ করেছি। ‘দ্য ডার্ক ওয়ান’।
ঋতুপর্ণা: দ্য ডার্ক ওয়ান? দ্য ডার্ক হর্স।
পত্রিকা: বেশ তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু...
ঋতুপর্ণা: একদম।
নাইজেল: আকারা আমার ফ্যামিলি নেম। আমি মালয়ালি ক্রিশ্চান।
ঋতুপর্ণা: গির্জায় যাও?
নাইজেল: (একটু থেমে) না, যাই না।
পত্রিকা: মানে আপনি ক্রিশ্চান, আর জীবনের প্রথম ছবিতে
অভিনয় করেছেন এক জন মুসলমানের চরিত্রে (ইউসুফ মহম্মদ খান) যে আবার কি না বাল্মীকির চরিত্রেও অভিনয় করে...
নাইজেল: হুম। আমি এখন আমার মতো করে ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। ধ্যান করি। যন্ত্রসঙ্গীতের সাহায্যে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, টিসিএস-য়েও (টাটা কনসালটেনসি সার্ভিস) মেডিটেশনের ক্লাস নিতাম।
ঋতুপর্ণা: জেলে থাকার সময় কি প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করত?
নাইজেল: ঠিক প্রতিশোধস্পৃহা নয়। ভাবতাম যে আমি কখনই ভুল হতে পারি না। যতক্ষণ না অলকানন্দা রায় এলেন। আর আমাকে জোর করা হল নাচ করবার জন্য...
ঋতুপর্ণা: কী রকম ছিল প্রথম পারফর্ম্যান্স?
নাইজেল: খুব নার্ভাস ছিলাম।
ঋতুপর্ণা: কেউ বলেনি খুব সুন্দর লাগছে দেখতে?
নাইজেল: ওটা ছিল জেলের ভেতরে। কিন্তু একটা ব্যাপার হয়েছিল। আস্তে আস্তে বন্ধুত্বগুলো আর ভাল লাগছিল না। এক দিন ম্যাডাম বললেন তুমি কি প্রার্থনা কর? আমি বললাম করি না। উনি বললেন পাঁচ মিনিট রোজ প্রার্থনা করো। ভগবান যদি কিছু নাও দেন, কেড়েও নেবেন না। প্রার্থনা শুরু করলাম। করতে করতে বাইবেল মুখস্ত হয়ে গেল। কোরান পড়লাম, গীতা পড়লাম।
পত্রিকা: জীবনে প্রথম বার প্রার্থনা করলেন?
নাইজেল: হ্যাঁ, প্রথম বার।
পত্রিকা: কী চলছিল মনে তখন?
নাইজেল: কিছু একটা হয়ে যাচ্ছিল। ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে সবার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছি। একা হয়ে যাচ্ছি। ঘুমের মধ্যে চোখ পিটপিট করছি। ঝরঝর করে জল গড়াচ্ছে। কিন্তু আমি কাঁদছি না। এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে শুনলাম বাইরে অনুষ্ঠান হবে। আমি তখন মা-কে গিয়ে বলেছিলাম আমাকে একটা সুযোগ দিতে। বলেছিলাম আমি তোমার নাম ডোবাব না। আরেকটা ব্যাপার হয়েছিল। রবীন্দ্র সদনে অন্ধকার স্টেজে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ‘মার্ক’ দেখছি। সামনে ফাঁকা সিটের সারি। দেখতে দেখতে হাউহাউ করে চেঁচিয়ে কেঁদে ফেললাম। মনে হল ভেতরে যা জমা ছিল সব বেরিয়ে এল।
নিঃশব্দ
নাইজেল: তার পর থেকে আর কোনও দিন পেছনে ফিরে তাকাইনি। কারণ তখনই ‘মা’ এসেছিল। একটাই কথা মনে হত। যাই করি না কেন, ওঁর সম্মান হারাতে দেব না।
পত্রিকা: মানে ‘মুক্তধারা’য় জীবনই নাটক, নাটকই জীবন।
ঋতুপর্ণা: একদম। এই ছবিটা মুক্তির গল্প বলে। নানা স্তরে নানা মানুষের মুক্তি। |
|
|
|
|
|