জেলের মধ্যে তাঁর চোখের সামনে সার দিয়ে দাঁড়ানো বিভিন্ন বয়সের কিছু লোক। ‘বিশ্বাসঘাতক’-কে চিনে নিতে অবশ্য এক মুহূর্তও সময় লাগল না তাঁর। সামনে গিয়ে সপাটে ওই যুবকের দু’গালে চড় কষালেন তরুণী!
ঠিক যেমন চোখের সামনে ভাইয়ের ‘খুনি’কে দেখে মাথার ঠিক রাখতে পারেননি বারাসতের রিঙ্কু দাস। দমদম সেন্ট্রাল জেলে একই ভাবে টিআই প্যারেডের সময় রাজীব দাস হত্যায় মূল অভিযুক্ত মিঠুন দাসকে চড় মেরেছিলেন রিঙ্কু। সেটা এক বছর আগের ঘটনা। এ বারের ঘটনাস্থল, বসিরহাট সাব-জেল। বিয়ের নাম করে নিয়ে গিয়ে পুণের যৌনপল্লিতে ওই তরুণীকে বিক্রি করে দিয়েছিল বসিরহাটের ট্যাটরা এলাকার বাসিন্দা পলাশ দাস ওরফে সেলিম। সেই তরুণীকে উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ধরা পড়েছিল পলাশ ও তার তিন শাগরেদ। বৃহস্পতিবার ওই তরুণীকে বসিরহাট জেলে অভিযুক্তদের শনাক্তকরণের জন্য নিয়ে আসে পুলিশ। সেলিমকে সামনে দেখে রাগে মাথা ঠিক থাকেনি মেয়েটির। পলাশের দু’গালে চড় কষিয়ে দেন তিনি। সে জন্য প্রশাসনের কাছে ‘মৃদু ধমক’ও খেতে হয়েছে। ভুল করেছেন মেনে নিয়ে পরে ওই তরুণী বললেন, “ওকে বিশ্বাস করে আমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে! তাই ওকে থাপ্পড় মারি। এখানে কাজটা করা ঠিক হয়নি জানি। কিন্তু এ জন্য আমার অনুশোচনা নেই। কারণ ও যা করেছে, তাতে আরও মারতে পারলে ভাল লাগত!”
এত রাগ? |
তরুণীর জবাব, “রাগ হবে না? আমার সর্বনাশের জন্য যে ও-ই দায়ী! ওর যে স্ত্রী আছে, সে কথা লুকিয়ে আমার সঙ্গে মিশেছিল। বিয়ে করার নাম করে আমাকে পুণেতে নিয়ে গিয়ে এক মহিলার কাছে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করে পলাশ পালিয়ে যায়। এ দিন ওকে দেখে তাই মাথা ঠিক রাখতে পারিনি।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে পলাশ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বাড়ি থেকে ফুসলিয়ে নিয়ে যায় স্থানীয় একটি গ্রামের ওই তরুণীকে। দু’জনের আলাপ অবশ্য অনেক আগের। ঘটনার দিন ওই তরুণীকে নিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে নামে পলাশ। সেখানে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় এক মহিলা-সহ আরও কয়েক জন। হাওড়া স্টেশন থেকে তারা তরুণীটিকে নিয়ে পুণের পথে রওনা দেয়। তরুণীর অভিযোগ, সেখানে বুধবারপেট রামেশ্বরপুরে এক যৌনপল্লিতে তাঁকে বিক্রি করে দেয় পলাশরা। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান না পেয়ে তরুণীর বাড়ির লোক জন থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন।
মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশাই যখন ছাড়তে বসেছেন বাড়ির লোক জন, তখনই আসে তরুণীর ফোন। দাদাকে তিনি সব জানান। কিন্তু পুণে শহরের ঠিক কোথায় তাঁকে রাখা হয়েছে, তা বলার আগেই ফোনের লাইন কেটে যায়।
এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “ফোনের সূত্র ধরে আমরা জুনের গোড়ায় পুণে গিয়ে স্থানীয় পুলিশের সাহায্যে ৩১ মার্চ ওই তরুণীকে যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার করি।”
এর পরে শুরু হয় পলাশের খোঁজ। কিন্তু জয়দেব, সেলিম, পলাশএই তিন নামে পালিয়ে বেড়াতে থাকা যুবকটিকে ধরাই মুশকিল হচ্ছিল পুলিশের পক্ষে। শেষ পর্যন্ত গোপন সূত্রে এ মাসে তার বাড়িতে ফেরার খবর পায় পুলিশ। সেখান থেকে গত ৬ জুলাই পলাশকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশের দাবি, জেরায় পলাশ অপরাধের কথা কবুল করে এবং জানায় আরও কয়েক জন এই নারী পাচার চক্রে জড়িত। এর পরে একে একে বাদুড়িয়ার সরফরাজপুর থেকে হাফিজুল সর্দার, বাঁশঝাড়ি গ্রাম থেকে রেখা বিবি এবং আখাড়পুর গ্রাম থেকে এম ডি হোসেন নামে তিন জনকে ধরে পুলিশ।
এ দিন দুপুরে বসিরহাট জেলে পলাশ-সহ ধৃতদের শনাক্তকরণের জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল তরুণীটিকে। পলাশকে দেখে মাথা ঠিক থাকেনি তাঁর। পরে আত্মীয়দের সঙ্গে তিনি গ্রামের বাড়িতে ফিরে যান। অভিশাপের পথ পেরিয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টায়। |