গ্রামে ছোটবেলায় ডাকা হত ‘গীতা পহেলওয়ান’ বলে। হাফ প্যান্ট পরে কুস্তির আখড়ায় কিশোরী মেয়ের দাপাদাপি সহ্য হত না গ্রামের লোকের। হরিয়ানার গ্রামের খাপ পঞ্চায়েত বাবা মহাবীর সিংহকে ডেকে বলে দিয়েছিল, “হাফ প্যান্ট পরা মেয়েকে আখড়ায় পাঠাবেন না।” এই নিয়ে পঞ্চায়েতের সভাও বসেছিল।
কিন্তু গ্রামের মোড়লদের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেননি বাবা মহাবীর সিংহ। ভাগ্যিস করেননি। নইলে আমরা লন্ডন অলিম্পিকে গীতা ফোগতকে পেতাম না। ৫৫ কেজি বিভাগে যোগ্যতা অর্জন করে লন্ডন অলিম্পিকের টিকিট হরিয়ানার অখ্যাত গ্রাম বালালির মেয়ে গীতার পকেটে। প্রথম ভারতীয় মহিলা কুস্তিগির হিসেবে ইতিহাস গড়ে অলিম্পিকে। গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্প্রিং থেকে ফিরেছেন ‘হাই অলটিউড’ ট্রেনিং সেরে। কমনওয়েলথ গেমসের সোনা জয়ী মেয়ে আবার শুক্রবার চলে যাচ্ছেন বেলারুশ। মাঝে দু’দিনের জন্য দেশে ফেরা। দিল্লি থেকে গাড়িতে নিজের গ্রামে ফেরার পথে মঙ্গলবার গীতার গলায় ধরা পড়ে আত্মবিশ্বাস, “কলোরাডো স্প্রিংয়ে দারুণ হয়েছে আমার ট্রেনিং। একেকজন প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে ধরে ভিডিওতে তাদের দুর্বলতা দেখে তৈরি হয়েছি। এরপর বেলারুশ যাচ্ছি। ওখানেও সেরাদের সঙ্গে লড়তে পারব। তারপর ৪ অগস্ট লন্ডন যাওয়ার কথা।”
কিন্তু কতটা থাকছে পদক সম্ভাবনা? ব্যাখ্যা করছেন মেয়েদের কুস্তির জাতীয় কোচ ও পি যাদব। এ দিন ফোনে বললেন, “ওর ইভেন্ট ৯ তারিখ। সব কিছু নির্ভর করছে লটারিতে ওর ড্রটা ঠিকঠাক হবে কি না। যদি প্রথম আটে থাকতে পারে, তা হলে পদক এলেও আসতে পারে। মনে রাখবেন, গীতা ছাড়া ওই ইভেন্টে আরও ১৮ জন মেয়ে থাকবে।” জানাচ্ছেন, কলোরাডো স্প্রিংয়ে বেজিং অলিম্পিকে রুপোজয়ী কুস্তিগিরকে হারিয়েছেন ২৩ বছরের গীতা। যা নিয়ে স্বয়ং গীতা বলছেন, “লন্ডনের আবহাওয়া আর বেলারুশের আবহাওয়ার মধ্যে খুব একটা তফাত নেই। সময়েরও খুব বেশি তারতম্য হবে না। বেলারুশেই আমার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। এটা বলতে পারি, কলোরাডোর ট্রেনিংয়ের পর আগের তুলনায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী আমি।” |
গত এপ্রিলে কাজাখস্তানের আসতানায় কোরীয় মেয়েকে হারিয়ে এসেছিল গীতার অলিম্পিক টিকিট। ওই টুর্নামেন্টেই হেরে একটুর জন্য টিকিট পাননি বোন ববিতা। যা নিয়ে আক্ষেপ এখনও যাচ্ছে না গীতার। “ববিতাও আমার সঙ্গে লন্ডনে গেলে দারুণ হত। অবশ্যই বোনকে মিস করব।” শুধু ববিতা নন, ছোট বোন রীতুও দিদিদের হাত ধরে কুস্তিতে। এমনকী কাকার দুই মেয়ে প্রিয়ঙ্কা আর নীতাও তাই। যৌথ পরিবারের মেয়ে গীতার কুস্তিতে ঢুকে পড়ার গল্পে রয়ে গিয়েছে সংকল্প আর মরিয়া জেদের মিশেল। টিভিতে কর্ণম মালেশ্বরীকে ভারোত্তোলনে অলিম্পিক পদক জিততে দেখে প্রথমবার কিশোরী গীতার মনে কুস্তির কথা এসেছিল। বলছিলেন, “বাবা কুস্তিগির ছিলেন। বাবার উৎসাহেই খেলাটায় আসা। কিন্তু উঠতি বয়সে আমরা বোনেরা যখন আখড়ায় যেতাম, হাফ প্যান্ট পরে কুস্তি লড়তাম, গ্রামের লোকেরা আপত্তি করেছিল। ছেলেরা টিটকিরি দিত। কিন্তু আমরা এসবে কান দিতাম না। প্র্যাক্টিসে ফাঁকি দিলেই বাবার হাতে চড়চাপড় খেতে হত।” তার চেয়েও বড় সমস্যা ছিল, বাবাকে ডেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, এভাবে চললে মেয়েদের কারও বিয়ে হবে না।
আর আজ সেই গ্রামেই আশ্চর্য পরিবর্তন! কমনওয়েলথে সোনা জয়ের পরে এখন গীতার পরিবার আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল, গ্রামে বর্ধিষ্ণু জাঠ পরিবার হিসেবে ধরা হয়। রাতারাতি গ্রামের মেয়েদের স্বপ্নটাই বদলে গিয়েছে। গীতার কথায়, “জানেন, গ্রামের মেয়েরা এখন অনেকেই কুস্তিতে আসছে। কেউ আর আখড়ায় মেয়েদের আসা নিয়ে বালালিতে কথা বলে না। বরং সবাই আমার জন্য প্রার্থনা করছে। যদি লন্ডন থেকে পদক পেতে পারি..।”
বিজেন্দ্র সিংহের সৌজন্যে এ দেশের খেলাধুলোর ম্যাপে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছে হরিয়ানার ভিওয়ানি। গীতার সৌজন্যে সেই সরণি বেয়ে হাঁটার স্বপ্ন এখন বালালিরও। |