দুঃখ নিয়েই সমর্থনের হাত
এ ছাড়া বিকল্প নেই, কবুল তৃণমূল নেত্রীর
দু’পা এগোনোর জন্য এক পা পিছিয়েই গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
যে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় মমতা ‘অনড়’ ছিলেন, মঙ্গলবার, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দু’দিন আগে তাঁকেই সমর্থনের কথা ঘোষণা করলেন তৃণমূল নেত্রী। জানালেন, জোট রাজনীতির ‘বাধ্যবাধকতা’য় এই সিদ্ধান্ত। বললেন, “হাসিখুশি ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেই ভাল হত। কিন্তু কোথাও যেন একটা দুঃখ কাজ করছে!” তাঁর আরও বক্তব্য, “এ ছাড়া আমাদের সামনে কোনও বিকল্প নেই।”
এত দিন ধরে প্রণববাবুর বিরোধিতায় ‘অনড়’ থেকে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলের পটভূমিকায় মমতাকে এ কথা বলতেই হত। কিন্তু তিনি যা-ই বলুন না কেন, হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন তৃণমূলের অধিকাংশ নেতা। এ দিন মহাকরণে মমতার ওই ঘোষণার পর দলের অন্দরে দৃশ্যতই স্বস্তি।
বস্তুত মমতা-ঘনিষ্ঠরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক কালের মধ্যে তৃণমূল নেত্রী এই প্রথম একটি পুরোদস্তুর ‘রাজনৈতিক’ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্বল্পমেয়াদি নয়, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দীর্ঘমেয়াদি রাজনীতির দিকে লক্ষ রেখে। এক দিকে যেমন তিনি প্রশাসনিক ভাবে রাজ্যচালনায় কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সহায়তা’ নিশ্চিত করতে পেরেছেন। তেমনই রাজনৈতিক ভাবে দুই শরিকের মধ্যে ঝগড়ার ‘সুযোগসন্ধানী’ সিপিএমকে ‘একঘরে’ করে দিতে পেরেছেন। এত দিন পর্যন্ত মমতা নিজে যে জায়গাটায় ছিলেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থনের সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সঙ্গে দলের নেতারা। মঙ্গলবার মহাকরণে। ছবি: সুদীপ আচার্য
দলের এক প্রথম সারির নেতাও বলেছেন, “আমরা জাতীয় রাজনীতিতে একেবারে একা হয়ে যাচ্ছিলাম। এই মুহূর্তে সেটা কাম্য ছিল না!”
রাষ্ট্রপতি ভোট ঘিরে জাতীয় রাজনীতিতে তৃণমূলের ‘একা’ হয়ে যাওয়ার এই দলীয় পর্যবেক্ষণ তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের উপান্তে এসে প্রণববাবু কার্যত ‘অসম্ভব’ একটি কাণ্ড ঘটিয়েছেন। তাঁকে একযোগে ভোট দিচ্ছে কংগ্রেস-তৃণমূল-সিপিএম!
তবে গোটা দেশেই পরস্পরের ঘোষিত ‘রাজনৈতিক শত্রু’ বলে পরিচিত দলগুলির অধিকাংশ এক সুরে প্রণববাবুকে সমর্থন করেছে। উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম-মায়া, বিহারে লালু-নীতীশ, জম্মু-কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্স-পিডিপি, অন্ধ্রে জগন্মোহন-চন্দ্রবাবু, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা-এনসিপির মতো দলও তাঁর পাশে। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-মমতায় সেই ‘বৃত্ত’ সম্পূর্ণ হল বলেই কংগ্রেসের একাংশের মত।
প্রণববাবুর বিরোধিতা নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের যে ‘তিক্ততা’ তৈরি হয়েছিল, তা নিরসনে তৃণমূল নেতাদেরই একাংশ সচেষ্ট ছিলেন গত কয়েক দিন। তাঁদের বক্তব্য ছিল খুব সরল কংগ্রেসের তথা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ঝগড়া করার সময় এটা নয়। তাতে এক দিকে যেমন রাজ্য চালাতে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতার যথেষ্ট অসুবিধা হবে, তেমনই ইউপিএ ভেঙে বেরিয়ে এলে রেলের মতো ‘গুরুত্বপূর্ণ ও জনমুখী’ দফতরও হারাতে হবে। দলের এই অংশের নেতারা মমতাকে এমনও বোঝাচ্ছিলেন যে, কংগ্রেসের সঙ্গে যদি সম্পর্ক ছিন্ন করতেই হয়, তা হলে তা করা উচিত লোকসভা ভোটের আগে আগে। কোনও ‘জনমুখী’ প্রশ্নে। প্রণব-বিরোধিতার মতো কোনও বিষয়ে নয়। দলের প্রথম সারির নেতাদের একাংশ নেত্রীকে এ-ও জানান, রাষ্ট্রপতি ভোটে ‘হুইপ’ জারি না-করতে পারার ফলে গোপন ব্যালটে ‘ক্রস-ভোটিং’য়ের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
প্রাথমিক ভাবে তাঁদের ‘পরামর্শ’ না-শুনে মমতা উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও কংগ্রেসের সঙ্গে ‘সংঘাতে’র রাস্তাতেই হাঁটতে চেয়েছিলেন। তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন ইউপিএ প্রার্থী হামিদ আনসারির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী অথবা দলের প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসুকে প্রার্থী করবেন। তার তোড়জোড়ও শুরু করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু জয় সম্পর্কে ‘নিশ্চিত’ না-হয়ে গোপালকৃষ্ণ লড়তে রাজি হননি। মমতার উত্তরবঙ্গ সফরের শেষ দিকে সে কথা তিনি তৃণমূল নেত্রীকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়েও দেন।
তখন থেকেই মমতার ‘পরিবর্তনে’র শুরু।
ইউপিএ-র বৈঠকে পাঠানোর আগে মুকুল রায়কে মমতা নির্দেশ দিয়েছিলেন, কোনও ‘তর্কাতর্কি’র মধ্যে না-যেতে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-সহ অন্যরা আনসারির নাম প্রস্তাব করলে ‘বিনীত’ ভাবে তৃণমূলের তরফে গোপালকৃষ্ণ এবং কৃষ্ণাদেবীর নাম প্রস্তাব করতে। কিন্তু আনসারির নাম তাঁরা মানছেন না, এমন কোনও ‘সংঘাতে’র বার্তা না-দিতে।
দিল্লিতে ইউপিএ-র বৈঠকের দিনই কলকাতায় ফেরেন মমতা। ফেরার পথেই তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে জানান, ‘ঝগড়াঝাটি’ করে লাভ নেই। তাঁরা ইউপিএ-তে আছেন, থাকবেন। কারণ, তত ক্ষণে মমতা ভোটে লড়তে গোপালকৃষ্ণের ‘অনীহা’র কথা জেনে গিয়েছেন। অন্য দিকে দলের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের একাংশ নেত্রীকে জানান, তাঁরা দিল্লির প্রশাসনিক মহলে শুনতে পাচ্ছেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে মতানৈক্যের জেরে পশ্চিমবঙ্গের প্রকল্পগুলির বিষয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতি নেওয়ার জোরালো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমন কথাও ছড়াতে থাকে যে, প্রণববাবুকে সমর্থনের ‘বিনিময়ে’ উত্তরপ্রদেশ বিশেষ আর্থিক ‘প্যাকেজ’ আদায় করে নিয়েছে।
সব বিবেচনা করেই মমতা প্রণববাবুকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেন।
দলের একাংশ ভেবেছিলেন, মমতা ভোটদানে ‘বিরত’ থাকার সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু অন্য অংশ মমতাকে বোঝান, ভোটদানে বিরত থাকলেও ‘ভুল বার্তা’ যাবে। কারণ, রাজ্যের ক্রমবর্ধমান সংখ্যালঘু ভোটের জন্য বিজেপি প্রার্থী পি এ সাংমাকে মমতার পক্ষে ভোট দেওয়া সম্ভব নয়। মমতার এ দিনের ঘোষণায় স্বভাবতই ‘হতাশ’ বিজেপি। তারা প্রকাশ্যেই সে কথা বলেছে। দলের মুখপাত্র নির্মলা সীতারমণ বলেছেন, মমতার এই সিদ্ধান্ত তাঁদের বোধগম্য হচ্ছে না। ‘পুনর্মূষিক ভব’ বলে টুইট করেছেন বিজেপি-র রাজ্য নেতা তথাগত রায়।
মহাকরণে দলের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর মমতা এ দিন বলেন, “ভোট না-দেওয়া মানে ভোট নষ্ট করা। গণতন্ত্রে ভোট না-দিলে পরে মানুষের কাছে কী করে ভোট দেওয়ার আবেদন জানাব? ভোট যে খুব মূল্যবান!” তিনি আরও বলেন, “বিকল্প কী হতে পারত? ভোটদানে বিরত থাকতে পারতাম। আবার ভোট দিলে কাকে দেব, এই প্রশ্নটাও ছিল। আমাদের কাউকে পছন্দ না-ও হতে পারে। কিন্তু আমরা ভোট না-দিলেও এমনিতেই ৫০ হাজার প্লাস হবে। আর সমর্থন করলে উনি এক লক্ষ ভোট পাবেন। তাই রাজ্যের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে, গণতন্ত্রের প্রয়োজনে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।”
তৃণমূল নেতাদের একাংশের মত, প্রণববাবুকে ভোট দেওয়ার কারণ ‘ব্যাখ্যা’ করতে গিয়ে যথেষ্ট ‘পরিণতি’ দেখিয়েছেন মমতা। পুরো পরিস্থিতির ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ দেখা নেতাদের আশা, এর পর কেন্দ্র ‘বিরূপ’ থাকবে না। বিশেষত যখন এ দিন মমতা বলেছেন (আদতে নকল করে দেখিয়েছেন) স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ কী ভাবে এ দিন তাঁকে ফোন করে রাষ্ট্রপতি ভোটে সমর্থন চেয়েছেন। মমতা জানিয়েছেন, সনিয়া গাঁধীর সঙ্গেও কথা হয়েছে তাঁর।
মমতা-ঘনিষ্ঠদের আরও বক্তব্য, জোট রাজনীতির ‘বাধ্যবাধকতা’র কথা বলে এই বার্তাও দলনেত্রী দিয়েছেন যে, তিনি জোট ভাঙতে চান না। দলের এক সাংসদের কথায়, “আমাদের আশা, কংগ্রেস নেতৃত্ব বিষয়টা বুঝবেন এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ করবেন।” মমতাও তো সেই আশাতেই এক পা পিছোলেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.