ফড়েদের ডানা ছাঁটতে রাজ্য সরকার নজরদারি শুরু করেছে, সপ্তাহ দুই হল। কিন্তু রাজ্য জুড়ে সব্জির বিপণনে ফড়েরা যে ভূমিকা পালন করেন, তার বিকল্প সরকারি ব্যবস্থা নেই। ফলে, বাজারে সব্জির দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ফড়েদের ‘অসহযোগিতা’য় চাষিদের দুর্গতি অব্যাহত।
সব্জির ‘ন্যায্য দাম’ না পেয়ে ইতিমধ্যেই বর্ধমান থেকে নদিয়ার নানা জায়গায় বিক্ষোভ দেখিয়েছেন চাষিরা। সোমবার উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ায় রামচন্দ্রপুরে ফড়েদের ঘিরে রাস্তা অবরোধ করেন শ’পাঁচেক চাষি। বনগাঁ-বাগদায় মাঠের বেগুন মাঠেই নষ্ট করছেন অনেকে। এলাকার বাজারে ৩ টাকা কিলোয় বেগুন বেচছেন চাষিরা। অথচ মাত্র ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে বারাসত বাজারে সেই বেগুন বিকোচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা কিলোয়। সল্টলেক দর উঠেছে ২০ থেকে ২২ টাকায়।
কেন এই অবস্থা? বনগাঁর ছয়ঘরিয়ার চাষি বিজয় দে-র ব্যাখ্যা, ফি বছরই ইছামতীর অববাহিকায় প্রচুর সব্জি ফলে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়েও প্রচুর উদ্বৃত্ত থাকে। ফড়ে তথা পাইকারেরাই সেই সব্জি কিনে অন্যত্র পাঠান। |
বাদুড়িয়ার তেঁতুলিয়া-মছলন্দপুর রোডে চাষিদের অবরোধ। ছবি: নির্মল বসু |
এ বারও যথেষ্ট উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু সরকার ‘কড়াকড়ি’ করছে জানিয়ে বহু ফড়েই হয় মাল কিনছেন না অথবা কিনছেন জলের দরে। মাধবপুরের চাষি রহমত আলির আক্ষেপ, “আমার বড় ছেলে ভ্যানরিকশায় সব্জি নিয়ে কিছুটা হাটে বিক্রি করে। বাকি বেশির ভাগটা চাঁদা বাজারে ফড়েদের কাছে বেচে। কিন্তু এখন ফড়েরা দামই দিচ্ছে না।”
ফড়েরা পাল্টা বলছেন, প্রশাসন বাজারে হানা দিয়ে ধরপাকড় করাতেই লোকসান এড়াতে তাঁরা কয়েক দিন চুপ করে বসে গিয়েছিলেন। তাতে চাষিরা সব্জি বিক্রি করতে পারেননি। সব্জি জমে পচতে শুরু করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বনগাঁর এক ফড়ে বলেন, “চাষিরা এখন আমাদের হাতে পায়ে ধরছে। আগের থেকে কম দামে যতটা পারছে সব্জি বিক্রি করে দিচ্ছে।” তবে তাঁর দাবি, “আমরা মোটেই বেশি লাভ করি না। ট্রাকে বেশি মাল তুললে পুলিশ অনেক বেশি ধরপাকড় করছে। যে বেগুন ৩ টাকা কিলোয় কিনেছি, তা খুব জোর ৬ টাকায় পরের জনকে বিক্রি করছি।”
বাগদার চাষির হাত থেকে কলকাতা বা অন্যত্র ক্রেতার হাতে পৌঁছতে অন্তত পাঁচ বার হাতবদল হয় সব্জি। প্রথম জন গ্রামের হাট থেকে ট্রাকে বা ম্যাটাডরে সব্জি নিয়ে যান বনগাঁ শহরে। সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে জড়ো হওয়া সব্জি কেনেন দ্বিতীয় ফড়ে। তাঁর কাছ থেকে কিনে কলকাতায় পাইকারি বাজারে নিয়ে যান তৃতীয় জন। কোলে মার্কেটের মতো বাজারে তা চতুর্থ পাইকারের হাতে যায়। তিনি আবার বিক্রি করেন খুচরো সব্জি বিক্রেতাকে। প্রতি ধাপে চড়তে থাকে দাম।
উত্তর ২৪ পরগনার কৃষি বিপণন আধিকারিক সুধন্য নস্কর মেনে নেন, “গ্রাম থেকে সব্জি কিনে কলকাতায় বিক্রি করার পরিকাঠামো আমাদের নেই। এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর উপরে চাষিদের নির্ভর করতেই হয়।” সে ক্ষেত্রে, ফড়েদের একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে বরং কোনও ধাপে যাতে বেশি দাম না চড়ে, সে দিকেই নজর দেওয়া উচিত ছিল না সরকারের? মন্ত্রী ও আমলারা কি আর একটু সতর্ক হতে পারতেন না? এ দিনই নদিয়ার তেহট্টে সিপিএমের জনসভায় বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অভিযোগ করেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ফড়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। মরছে চাষিরা।” তবে রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায়ের দাবি, “ফড়েরা বেচা-কেনা করতে পারবে না, এ কথা আমরা বলিনি। তবে ওরা যে ভাবে ৩ টাকায় মাল কিনে ২০ টাকায় বেচছে, তা মানা যায় না। চাষিদের দিকটাও আমরা ভাবছি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ফের বৈঠক করা হবে।”
বাজারদর নাগালে রাখাটা জরুরি। কিন্তু চাষিরা কবে স্বস্তি পাবেন? |