সম্পাদক সমীপেষু ...
স্রেফ অর্থনীতির জোরেই বিশ্বে চিনা শিল্পের রমরমা নয়
পিকাসোকে হারাল ৬০০ কোটির চিৎকার’ (৪-৫) শিরোনামে একটি আকর্ষণীয় প্রতিবেদন চোখে পড়ল। নরওয়েজিয়ান শিল্পী এডভার্ড ম্যুনখের ‘চিৎকার’ ছবিটি সদবির নিলামে ৬০০ কোটিতে বিক্রি হওয়া তাৎপর্যপূর্ণ সন্দেহ নেই। অবশ্য ‘স্ক্রিম’-কে চিৎকার বলা যায় কি না, সে প্রশ্ন আলাদা। (৬ মে-র সম্পাদকীয় শিরোনামের ‘আর্তনাদ’ অপেক্ষাকৃত সঠিক)।
লেখাটি পড়তে গিয়ে বিশেষ ভাবে একটি অংশ নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও তথ্য মনে আসছে। ইউরো-আমেরিকান আধুনিক শিল্পকলার নামী ব্যক্তিত্বদের সৃজনকর্মের দাম বরাবরই আকাশচুম্বী। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, পশ্চিমি সভ্যতার সমাজ, অর্থনৈতিক বিকাশের প্রাবল্য ও তার বিশ্বব্যাপী প্রভাব শিল্পকর্মে যে অমূল্য ভূমিকা পালন করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঔপনিবেশিকতায় ক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি যে সেই মূল্যমানের শিল্পকর্মকে ছুঁতে পারবে তার কল্পনাও বাতুলতা। প্রশ্ন উঠেছে, ভারতীয় আধুনিক শিল্পকলা ইউরো-আমেরিকার নিরিখে না-হলেও অন্তত বিশ্ববাজারে আরও দামি হতে পারে কি না, তা নিয়ে। বাংলা মিডিয়ার গতানুগতিক প্রথা অনুযায়ী এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রবীণ শিল্পী যোগেন চৌধুরী। শ্রীচৌধুরী জানিয়েছেন, ভারতীয় অর্থনীতি দুনিয়াতে গুরুত্বপূর্ণ না-হয়ে ওঠা পর্যন্ত তা অসম্ভব। কথাটি পুরো না-হলেও আংশিক সত্যি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আজ বিশ্ববাজারে চিনা শিল্পের কদরের সঙ্গে চিনা অথর্নীতির রমরমার একটা সম্পর্ক আছে। এ কথাটিও সঠিক। যদি শুধু ১৯৮৯ সালে থিয়েনানমিন ছাত্র আন্দোলন ও খাই ফাং বা বাজার অর্থনীতির ব্যাপকতার প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা বিশ্ববাজার দখল করা শিল্পকেই আধুনিক চিনা শিল্প ধরে নিই। ব্যক্তিগত ভাবে, চিনদেশের আধুনিক শিল্পের নানা সংলাপ ও তার বাজারের উত্থান নিয়ে কিঞ্চিৎ ধারণা আমার হয়েছে বিভিন্ন সময়ে এ দেশে থাকার সুবাদে।
যত হাসি...। ‘হোল্ডিং হেড’। শিল্পী: উয়ে মিনজুন
চিনা আধুনিক শিল্প বিশ্ববাজারে বরাবরই অনেক বেশি অর্থমূল্য উপভোগ করে এসেছে। শুধু ভারত নয়, জাপানকে বাদ দিলে এশিয়ার সমস্ত দেশের থেকেই। তখন এই রমরমা তো ছিলই না, বরং দারিদ্র ও সামাজিক নিষ্পেষণও ছিল চরম। এ দেশের সুং, য়ুয়ান, মিং, ছিং যুগের ধুরন্ধর শিল্পীদের ছবির কথা বাদ দিই, আধুনিক শিল্পের গোড়ার পর্যায়েও আধুনিক গুরুদের ছবি আমাদের আধুনিক গুরুদের চেয়েও বহু গুণ দামে সংগৃহীত হয়ে এসেছে পশ্চিমের বাজার, তাইওয়ান ও জাপানে। চিনের ছি পাই র্শি, রনপা নিয়ান, সুপই হুং, ছাংতা ছিয়ন, উতাও উ এবং অন্যদের ছবির বিশ্ববাজারে চাহিদা ও বিক্রয়মূল্য এবং আমাদের তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাট দশকের আধুনিক গুরুদের ছবির চাহিদা ও বিক্রয়মূল্য নিয়ে একটা তুলনামূলক গবেষণা হতে পারে। বিষয়টি তাই বাজার অর্থনীতির ফাটকা খেলায় আমরা কেন দাম পাচ্ছি না, তা নিয়ে হা-হুতাশ নয়, বরং সামগ্রিক ভাবে এশিয়ান আর্টের চাহিদা ও সংগ্রহের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্তরে আমাদের অবস্থানটা ঠিক কোথায় ছিল ও আছে, সে-বিষয়ে একটু খোলা মনে ভাবার প্রয়োজন আছে।
চিনকে ছাড়ই দিই। জাপানের আধুনিক পর্বের গোড়ার শিল্পীরা পরবর্তী কালে হাসিমাতা গাহা, মুনাকাটা, গুটাই ও বাকুসা ঘরানার শিল্পী দল, কোরিয়ার পাক সাবা, কিমকি ছাং, ইন্দোনেশিয়ার আফান্দির শিল্পকর্ম, যা সংগ্রহের চাহিদা সৃষ্টি ও বিক্রয় মূল্য তৈরি করতে পেরেছে, আমরা আমাদের প্রতিভাবান শিল্পীদের সেই ভাবে তুলে আনতে পেরেছি কি না, ভেবে দেখা দরকার। এমন নয় যে, চিনা শিল্পীরা দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলেন যতক্ষণ না তং শিয়াও ফিং বলছেন যে, শিল্পকর্মও প্রোডাক্ট বা বিক্রয়যোগ্য হতে পারে। তথ্য দিয়ে বলতে পারি, বহির্বিশ্বেই নয়, চিনের অভ্যন্তরীণ বাজারে শিল্পবস্তুর আদান-প্রদানে যে অর্থ চলাচল করে তাতেও আমাদের চোখ টাটাতে পারে। চিনের পঞ্চাশ শতাংশ শিল্পবস্তুর কেনাবেচায় দীর্ঘ দিন ধরে যত অর্থ আদান-প্রদান হয়েছে তা কিন্তু রি-সেল ভ্যালুর জন্য নয়। নিছক একে অপরকে উপহার দেওয়ার জন্য। উপহার দ্রব্য হিসাবে ছবি কেনার ব্যাপারটা চিনে অষ্টম শতাব্দীর থাং যুগেও ছিল।
এ বার আসি, কেন চিনা ছবির দাম পশ্চিমদেশে এত দামি হয়ে উঠতে পারছে, সে প্রশ্নে। গুণগত মান ছাড়াও বহু কাল ধরে পশ্চিমে নিজেদের শিল্প সংস্কৃতিকে ক্রমাগত পৃষ্ঠপোষণা করছেন প্রবাসী চিনা ধনকুবের ও তাত্ত্বিক শিক্ষাজগতের ব্যক্তিরা। সেই নেটওয়ার্কের ধারেকাছে আমরা আসতে পারব কি না, সন্দেহ। প্রবল জাতীয়তাবাদী চিনারা নিজেদের ঢাক পেটাতে সিদ্ধহস্ত। এ ছাড়া, বিপ্লবোত্তর চিনা পার্টির অধীনে সরকারি শিল্পকলার আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে গোপন ও প্রান্তিক শিল্পকলার প্রতি পশ্চিম দুনিয়ার কিউরেটর, কালেক্টর ও সমালোচকদের উৎসাহ বরাবরই বেশি। তা ছাড়া, পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলোতে বসবাসকারী দেশত্যাগী শিল্পীদের একটা বড় ভূমিকাও কাজ করছে চিনা আধুনিক শিল্পের প্রসারে। এঁদের সংখ্যাটাও প্রবাসী ভারতীয় শিল্পীদের চেয়ে বহুগুণ বেশি। চিনা আধুনিক শিল্পের চূড়ান্ত রমরমা মূলত ১৯৯০-এ ভেনিস বিয়ানালের পর থেকেই। এর পরই পশ্চিমি কিউরেটর কালেক্টরদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সেই দাম আমাদের কল্পনার অতীত।
চিনা আধুনিক শিল্পকলায় আর একটা ব্যাপার লক্ষণীয় তা হল তারুণ্যের প্রভাব। সেটা কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক রমরমার জন্য নয়। আবহমান কাল ধরে চিনা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, আমাদের যেমন সেই থোড়বড়িখাড়ার মতো সত্তর ছুঁইছুঁই তরুণ শিল্পীরা সব কর্মকাণ্ডে আসন আলো করে বসে থাকেন, সেটি এখানে সচরাচর দেখিনি। এ দেশে আর্ট কলেজের সংখ্যাও যেমন বেশি, প্রতিযোগী শিল্পীর সংখ্যাও ততোধিক। তাও কিন্তু অর্থর রমরমার সময় নয়। পঞ্চাশের দশক থেকেই এদের শিল্পশিক্ষার পরিকাঠামো ও পরিবেশনকে আমরা ছুঁতে পারিনি। আমাদের দেশের মতো না-হলেও এখানে যে প্রাদেশিক প্রতিযোগিতা নেই, তা নয়। কিন্তু চুংকুও মইসু বা চাইনিজ আর্টকে সামগ্রিক ভাবে বিদেশে প্রোজেক্ট করার একটা নেটওয়ার্ক কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকেই নিটোল ভাবে দানা বাঁধে এক নির্দিষ্ট স্লোগানে ‘চৌসিয়াং শির্চিয়’ বা আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছনোকে মাথায় রেখে। যার ফলে, পইচিং শহরের ৭৯৮ শিল্পজলা বা সাংহাই, গুয়ানচৌ বা বড় শহরগুলির তাকলাগানো প্রদর্শশালার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমি এই মুহূর্তে পইচিং শহরের প্রায় উত্তর সীমান্তে সুংচুয়াং নামে যে শিল্পী-গ্রামে অতিথি হয়ে ক’দিন রয়েছি, সেখানেই প্রায় সাত হাজার তরুণ শিল্পী বাস করেন। চিনা আভা-গার্দ শিল্পের আঁতুড়ঘর এই গ্রামের মিউজিয়াম, গ্যালারি ও স্টুডিয়োগুলো আমাদের শহরের যে-কোনও গ্যালারিকে ম্লান করে দিতে পারে। তাই ছ’শো কোটি বা পঞ্চাশ কোটির বিষয় নয়। একদা আমাদের থেকে পৃথক গরিব এই দেশটি কী ভাবে এ সব পারছে ভাবতে বসে শুধুই ‘অর্থনৈতিক রমরমা’ বলে পাশ না-কাটিয়ে একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে না কি? শুধু চিৎকার বা ‘স্ক্রিম’ না করে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.