প্রবন্ধ...
সাধারণ স্বার্থ থেকে যৌথ কর্মসূচির খোঁজে
০১০ সাল থেকে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতি বছর ‘স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ’ অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিক নীতিকাঠামো সংক্রান্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন ডি সি-তে তৃতীয় বার্ষিক আলোচনা শেষ হল। এই বার্ষিক বৈঠক আরম্ভ হওয়ার পর থেকে এই দেশ দু’টির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যে ভাবে প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে, মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন ও ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ সে বিষয়ে কথা বললেন। কী ভাবে এই দুই দেশ সমৃদ্ধি, শান্তি এবং স্থিতি বজায় রেখে উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারে, তার রূপরেখা তৈরি হল। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহিলাদের ক্ষমতায়ন নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের যৌথ ভাবে কী কী করার সুযোগ রয়েছে, সে বিষয়ে একটি যৌথ বিবৃতি দিলেন তাঁরা।
এই বৈঠকের অব্যবহিত আগেই হিলারি ক্লিন্টন কলকাতা সফরে এসেছিলেন। গোটা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমে এই সফরটি যে পরিমাণ গুরুত্ব পেয়েছে, তাতে কলকাতার সম্ভাবনা বিষয়ে যে বিশ্ববাসীর ধারণা অনেক স্বচ্ছ হল, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। বিদেশসচিব স্বয়ং বলেছেন, তিনি ‘পশ্চিমবঙ্গের এবং কলকাতার প্রাণোচ্ছলতা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন।’
কলকাতা, আইজল, শিলং বা ইটানগর যেখানেই যাই না কেন, প্রায়শই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়: ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের এই নীতিকাঠামোগত অংশীদারি কেন ভারতের স্বার্থের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ?’ যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন। হিলারি ক্লিন্টন বলেছিলেন, ‘অসামরিক পারমাণবিক শক্তি বিষয়ে সহযোগিতা বা ভারতে আরও বেশি মার্কিন বিনিয়োগ নিয়ে আসার কথা বলাই যথেষ্ট নয়। সাধারণ মানুষ যাতে এই প্রচেষ্টার ফল দেখতে পান, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে... নীতিকাঠামোগত অংশীদারি মানে শুধু এক দেশ অপর দেশের নীতি বা প্রয়োজনকে সমর্থন জোগাবে, সেটুকুই নয়, এর অর্থ, একটা যৌথ লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য আমাদের এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। ছোটখাটো মতের অমিল যাতে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিকে নষ্ট করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।’ বিদেশসচিব ক্লিন্টন অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেন, দুই দেশের সাধারণ স্বার্থকে একটা যৌথ কর্মসূচিতে পরিণত করতে হবে।
দ্বিপাক্ষিক সাধারণ স্বার্থকে একটি যৌথ কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করার কাজটি পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে কী ভাবে সম্ভব, বিশেষত অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক জোটবন্ধনের মাধ্যমে, দেখা যাক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত কৃষিক্ষেত্রে যৌথ উদ্যোগে অনেক কিছু করেছে। তেমন সফল যৌথ উদ্যোগের একটি চমৎকার উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গেই আছে কলকাতার উপকণ্ঠে পেপসিকো সংস্থার ফ্রিটো-লে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র। ২০০৪ সালে পেপসিকো পশ্চিমবঙ্গে অংশীদারি ভিত্তিক চাষের ধারণাটি নিয়ে আসে। কৃষকদের সঙ্গে সংস্থাটির যে চুক্তি হয়, তাতে স্থির হয়, উৎপন্ন কৃষিপণ্য এই সংস্থাটি নিশ্চিত ভাবেই কিনে নেবে। কৃষকরা যাতে উন্নততর কৃষি-পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন, সংস্থাটি তার জন্য প্রভূত সাহায্য করতেও স্বীকৃত হল। সংস্থাটি এই অংশীদারি চাষ আরম্ভ করেছিল ১৪০ জন কৃষককে সঙ্গে নিয়ে। এখন নথিভুক্ত কৃষকের সংস্থা ১২,০০০-এর বেশি। তাঁরা বছরে ৩৫,০০০ টন আলু উৎপাদন করেন। গোটা দেশে যতগুলি রাজ্যে ফ্রিটো-লে এই অংশীদারি চাষ চালু করেছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের উৎপাদন একেবারে প্রথম সারিতে। ফ্রিটো-লের সঙ্গে যুক্ত আছেন বলেই এই কৃষকরা অনেক সহজে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পান। এই অংশীদারি চাষ কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, কৃষকরা এর মাধ্যমে আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন করেছেন। এই অংশীদারির ফলেই ফ্রিটো-লের পশ্চিমবঙ্গের কারখানাটি এশিয়ায় এই সংস্থার বৃহত্তম খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র।
বস্তুত, ভারত-মার্কিন যৌথ উদ্যোগগুলি উভয় দেশের পক্ষেই লাভজনক। ভারতের কোল ইন্ডিয়া সংস্থাটির উদাহরণ দিই। সংস্থাটির সদর দফতর কলকাতায়। ভারতে প্রতি বছর যত কয়লা উৎপন্ন হয়, তার ৮০ শতাংশই করে কোল ইন্ডিয়া। সংস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহু কোটি ডলার ব্যয় করে আধুনিকতম যন্ত্রপাতি কেনে, যাতে পরিবেশের যথাসাধ্য কম ক্ষতি করে কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ এবং কুশলতা বৃদ্ধি করা যায়। এই বাণিজ্যিক সম্পর্কের ফলে উভয় দেশেই প্রভূত কর্মসংস্থান হচ্ছে।
স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রের কথা ভাবুন। মুখ্যমন্ত্রী বিশেষত গরিব মানুষের জন্য কম খরচে উন্নত মানের স্বাস্থ্য পরিষেবার গুরুত্বের কথা জোর দিয়ে বলেন। একটি বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতে স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্রে প্রায় ১৫,০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হলে বহু স্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থা ভারতে আসতে আগ্রহী হবে। তাতে ভারতের স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার পরিকাঠামোর উন্নতি হবে। ভারতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থাগুলির পরিষেবাও ক্রমে বিশ্বমানের সঙ্গে তুলনীয় হবে। আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় সংস্থাগুলির যৌথ উদ্যোগ গড়ে উঠলে উভয় পক্ষেরই লাভ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের উন্নয়নের অংশীদার করে নিলে দেশের পরিকাঠামোর কী উন্নতি হতে পারে, হুগলি নদীর ওপর নিবেদিতা সেতু তার একটা চমৎকার প্রমাণ। এই সেতুটির নকশা তৈরি করেছিল সান দিয়েগো-র একটি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ব্রিজ টেকনোলজিস; আর সেতুটি তৈরি হয়েছিল অনেকগুলি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকাঠামো সংস্থা পার্সনস ব্রিঙ্কারহফ তার মধ্যে একটি। এই সেতুটি ২০০৭ সালে খুলে দেওয়া হয়। এত দিনে তার সাফল্য প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই সেতুটি প্রমাণ করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারিগরি দক্ষতাকে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে যথার্থ ভাবে ব্যবহার করলে তা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে।
ভারতের রেলপথ, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ইত্যাদির উন্নয়নে বা নতুন কেন্দ্র নির্মাণে মার্কিন সংস্থাগুলি পণ্য ও পরিষেবা, উভয় দিক থেকেই অংশীদার হতে চায়। ভারতে যে নানাবিধ উদ্ভাবন চলছে, এখান থেকেই যে দুনিয়ার পণ্য এবং পরিষেবা উৎপন্ন হবে, মার্কিন বাণিজ্যমহল তা বিলক্ষণ বোঝে। কলকাতা ঐতিহাসিক ভাবেই এশিয়ার প্রবেশপথ হিসেবে পরিচিত। ভারতীয় অর্থনীতির গবেষণাগারে ভবিষ্যতের যে পণ্য-পরিষেবা তৈরি হবে, তা কলকাতা হয়েই বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছবে। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক যত দৃঢ় হবে, মানুষে-মানুষে বন্ধন যত বাড়বে, এই দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কও ততই বিকশিত হবে, সমৃদ্ধ হবে।
রবীন্দ্রনাথের কথার প্রতিধ্বনি করে বলা যায়, সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে তার বিপুল জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকলেই সেই সমুদ্র পার হওয়া যায় না। আমাদের দু’দেশের মানুষ, আমাদের ব্যবসায়িক মহল, আমাদের বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে তার পরবর্তী স্তরে পৌঁছে দেবে। বিদেশসচিব ক্লিন্টনের ভারত সফর এবং সদ্য-সমাপ্ত ভারত-মার্কিন নীতিকাঠামো সংক্রান্ত আলোচনা আমাদের প্রত্যাশাকে শক্তিশালী করেছে। সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছে। দুই দেশকে নিয়েই আমাদের যে স্বপ্ন, তার বাস্তবায়নের সময় এসেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.