তিস্তা ক্যানেলের বাঁধে বসে সুজন মণ্ডল। ফুলবাড়ি ক্যানেল লাগোয়া পশ্চিম ধনতলার বাসিন্দা সুজনবাবুর মুরগির খামার জলের তলায়। রাতে মহানন্দার জলে বাড়ির জানলা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছে। হাজার মুরগি মারা গিয়েছে। মহানন্দার জলে প্লাবিত হয়েছে গোটা এলাকা। এলাকার প্রায় ১০০ পরিবার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। চম্পাসারির মিলনমোড় এলাকায় বাসিন্দা মিঠু দেবী রবিবার ভোরে গরু মাঠে বেঁধে ঘরে এসেছিলেন। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে বেরিয়ে দেখেন মহানন্দা বাঁধ ভেঙে হু-হু করে জল ছুটে আসছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে এক তলায় জল দাঁড়িয়ে যায়। রবিবার সকালে মহানন্দার বাঁধ ভেঙে ওই এলাকার মাজুয়া, মিলনমোড়, দাগাপুর, পলাশ, কড়াইবাড়ি এলাকার কয়েক হাজার বাসিন্দা জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। মহানন্দার ধারে শিলিগুড়ি পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডগুলিতে বাড়িতে জল ঢুকে পড়ে বিপাকে বাসিন্দারা। রবিবার রাত আড়াইটার পর থেকে মহানন্দার জল বাড়তে থাকে। বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হতে শুরু করলে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। রাতে বারবার ডাকাডাকি করা হলেও ব্যারেজের লোকজনদের পাওয়া যায়নি। সকালে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব পশ্চিম ধনতলা গেলে তাঁর কাছে এ ব্যাপারে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। রাস্তা অবরোধ করেও বিক্ষোভ দেখান বাসিন্দারা। মন্ত্রী যখন এলাকায় যান তখনও কলার ভেলায় বা টায়ার ভাসিয়ে জলমগ্ন এলাকা থেকে বাসিন্দাদের এবং বাড়ির জিনিসপত্র উদ্ধার করছেন লোকজন। পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত জলমগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন তিনি। মহানন্দা ব্যারেজে গিয়ে দফতরের বাস্তুকারদের নিয়ে জল ছাড়ার কাজের তদ্বির করেন। পশ্চিম ধনতলা থেকে মন্ত্রী যান পোড়াঝাড়ে, সেখানে থেকে মিলনমোড় এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ দেখতে। পোড়াঝাড়ের বাসিন্দা বাসুদেব সরকার পুকুরে লক্ষাধিক টাকার মাছের পোনা ছেড়েছিলেন ৮/৯ মাস আগে। তিনি বলেন, “পুকুরের সব মাছ নষ্ট হল। আমার সর্বনাশ হল।” এলাকার কার্তিক মণ্ডল, মইনুল ইসলামরা জানান, এলাকার প্রায় ২০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মিলন মোড়ের মিঠু দেবী বলেন, “বাঁধ ভেঙে জল ঢোকা শুরু কয়েক মিনিটের মধ্যে আমার বাড়ির নিচতলার গোয়ালঘরে জল দাঁড়িয়ে যায়। ছাগলগুলোকে দোতালায় আমাদের ঘরে তুলে আনলাম। ততক্ষণে দেখি বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে প্রবল বেগে নদী বইছে। বাড়িতে হাঁটু জল।” চম্পাসারি মেন রোড ধরে কড়াইবাড়ি বস্তিতে যাওয়ার রাস্তাটাই জলের তোড়ে উঠে গিয়েছে। কড়াইবাড়ির কয়েকশো বাসিন্দা জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। গরু, ছাগল নিয়ে ঘরে দিন কাটাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা গোবিন্দ ছেত্রী বলেন, “গ্রাম থেকে বার হওয়ার উপায় নেই। কবে রাস্তা তৈরি হবে কে জানে?” বাড়ির দিকে নদীর জল ছুটে আসতে দেখে ঘর ছেড়ে চম্পাসারি মেন রোডে পালিয়ে যান কৃষ্ণবাহাদুর রাই। তাঁর স্ত্রী মনোমায়া দেবী বলেন, “ঘরে জল ঢুকে গিয়েছে। জল বার না-হলে ভিতরে ঢোকার উপায় নেই। কোথায় রাত কাটাব জানি না।” শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য বাসিন্দাদের সবাইকে দ্রুত ত্রাণের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সমস্ত ঘটনা জানানো হচ্ছে। নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।” মহানন্দার জল এলাকায় হুহু করে ঢুকছে টের পেয়ে রাত ৩ টার সময় এলাকার কাউন্সিলর অমরনাথ সিংহর বাড়িতে গিয়ে তাকে ডেকে তোলেন গণেশ সাহানি। শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। জল ক্রমশ বাড়তে থাকে। শিলিগুড়ি পুরসভার ওই ৫ নম্বর ওয়ার্ড তো বটেই লাগোয়া ৪, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েন। ভিতের মাটি আলগা হয়ে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা পরেশ সরকারের বাড়ি ভেঙে পড়ে। তা ছাড়া ১-৩, ৪২-৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের নদীর ধারে থাকা এলাকাগুলি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত জানান, প্রায় ৫০ হাজার মানুষ জলবন্দি হয়ে বিপাকে পড়েছেন। তাদের ত্রাণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। |