এ পি জে আব্দুল কালামকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি রাজি হননি। উপরাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হিসেবে চেয়েছিলেন গোপালকৃষ্ণ গাঁধীকে। তিনিও শেষ পর্যন্ত নারাজ। কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের সঙ্গে মমতার যে প্রকাশ্য সংঘাত তৈরি হয়েছিল, উপরাষ্ট্রপতি ভোট নিয়ে তা সুকৌশলে এড়াতে চাইছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব আজ সকালেও মমতাকে প্রস্তাব দেন, কৃষ্ণা বসুকে প্রার্থী করে তৃণমূল সকলের কাছে ভোটের আবেদন জানালে তাঁরা সমর্থন করবেন। আগামিকাল প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য চূড়ান্ত বৈঠকে বসছে এনডিএ। তাই আজকের মধ্যে কৃষ্ণা বসুকে প্রার্থী করে মমতা প্রকাশ্য আবেদন জানালে আগামিকাল বিজেপি নেতৃত্ব তাঁকেই সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু মমতা ‘বিনীত ভাবে’ বিজেপির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন।
ফলে পরিস্থিতি যা দাঁড়াল, তাতে তৃণমূলের পক্ষ থেকে কৃষ্ণা বসুকে প্রার্থী করার সম্ভাবনা কম। কিন্তু কেন মমতা এই কৌশল নিচ্ছেন?
মমতার ঘনিষ্ঠমহল বলছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় মুলায়ম সিংহ যাদবকে বিশ্বাস করে তিনি ঠকেছিলেন। এ বার তাই কোনও ঝুঁকি নিতে চান না তিনি। বিজেপি বললেও নীতীশ কুমার যে শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণা বসুকে সমর্থন করবেন, এর কোনও নিশ্চয়তা মমতা দেখছেন না। যদিও অরুণ জেটলি আজ সকালে নীতীশের সঙ্গে কথা বলেন। বিজেপির দাবি, কৃষ্ণা বসুকে সমর্থন করতে তৈরি নীতীশ। কারণ, প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন করে বিজেপি শিবিরের আস্থা অনেকটাই হারিয়েছেন তিনি। নরেন্দ্র মোদী-বিরোধী অভিযানের ফলেও নীতীশের উপরে বিজেপি চটেছে। দলের অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন, ২০১৪ সালের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করতে চাইছেন নীতীশ। এ বার তাই হামিদ আনসারিকে সমর্থন না করে তিনি যে এনডিএ প্রার্থীকেই সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সে কথা বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু মমতার শিবিরের বক্তব্য, আমরা ঘরপোড়া গরু। মুলায়ম যা করেছেন, নীতীশও যে তা করবেন না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, উপরাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার তীব্র ইচ্ছা আছে দার্জিলিঙের সাংসদ যশোবন্ত সিংহের। এই ইচ্ছের কথা লালকৃষ্ণ আডবাণীকে জানান তিনি। আডবাণী দলে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সেই প্রস্তাবকে কার্যকর করতে চাইছেন। তাই গত কাল অনন্ত কুমারকে দিয়ে আডবাণী ঘোষণা করিয়ে দিয়েছেন, বিজেপি উপরাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী দেবে। নিতিন গডকড়ী, অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহরা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। যদিও সুষমা স্বরাজ এখনও আডবাণীর পক্ষে। অরুণ, নিতিন, রাজনাথের বক্তব্য, জেতা যখন সম্ভব নয়, তখন যশোবন্তকে প্রার্থী করাটা রাজনৈতিক আত্মহত্যার সামিল। অতীতে ভৈরোঁ সিংহ শেখাওয়াতের মনোবাসনা পূর্ণ করতে গিয়ে বিজেপি তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করেছিল। তাতে বিজেপির কী লাভ হয়েছে? বরং মমতা প্রার্থী দিলে তাঁকে সমর্থন করে কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারলে লোকসভা ভোটের আগে দলের ফায়দা হতে পারে। বিজেপির কেউ কেউ এ-ও বলছেন, যশোবন্তের বদলে শরদ যাদবকে প্রার্থী করা হোক। তা হলে নীতীশ আর আনসারিকে ভোট দিতে পারবেন না।
মমতা শিবিরের বক্তব্য, যখন বিজেপির একাংশ যশোবন্তকে প্রার্থী করতে সক্রিয়, আর এক পক্ষ শরদ যাদবের কথা ভাবছেন, তখন খামোখা এই ফাঁদে মমতা কেন পা দেবেন? তা ছাড়া মুকুল রায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তৃণমূল ইউপিএ-তে আছে। এনডিএ-র সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনাও নেই।
প্রণববাবু আজ শ্রীনগরে আশা প্রকাশ করেছেন, শেষ মুহূর্তে মমতা তাঁকেই ভোট দেবেন। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব মমতার সঙ্গে সংঘাতে যেতে চাইছেন না। সনিয়া গাঁধীর নৈশভোজে মমতা আসবেন না বলে জানিয়েছেন। তবু তাঁকে ফোন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেলও মমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন। তৃণমূলের প্রার্থীর প্রস্তাব মেনে না নিলেও কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব কোনও ভাবে চান না, মমতা ইউপিএ থেকে চলে যান। আহমেদ বলেন, “জোট চালাতে গেলে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য হয়। তার মানে এই নয়, ইউপিএ ভেঙে যাচ্ছে। মমতা আমাদের সঙ্গে আছেন এবং থাকবেন।”
মমতা শিবির অবশ্য কংগ্রেস নেতৃত্বের উপর যারপরনাই ক্ষুব্ধ। তাঁদের বক্তব্য, কংগ্রেস বারবারই নিজেদের প্রার্থী ঠিক করে তার পর আলোচনা করছে। আমাদের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত নয়। এটা জোটধর্ম নয়। তবে এই সংঘাতের আবহের মধ্যেও মমতা বুঝতে পারছেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁকে রাজপাট চালাতে গেলে পদে পদে কেন্দ্রের সঙ্গে ঝগড়া করে চলাটা সঠিক কৌশল নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আর্থিক ও অন্যান্য বিষয়ে কেন্দ্রের উপরে রাজ্যকে নির্ভরশীল থাকতে হয়। কেন্দ্র যদি ভাতে মারার কৌশল নেয়, সে ক্ষেত্রে রাজ্যই বিপদে পড়বে। ২০১৪ সালের ভোট হতে এখনও দু’বছর বাকি। সুতরাং এত তাড়াতাড়ি ইউপিএ-র সঙ্গে সংঘাতকে বিচ্ছেদের জায়গায় নিয়ে যাওয়াটা রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নয়। তাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের সময় মমতা যে ভাবে দিল্লি এসে মুলায়মকে নিয়ে অতিসক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন, এ বার তা করেননি। সে বার এর ফলেই সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ বার তেমন পরিস্থিতি এড়াতে সনিয়ার নৈশভোজে আসছেন না তিনি। তবে ইউপিএ-র বৈঠকে মুকুল রায়কে পাঠিয়েছেন। সেখানে তৃণমূলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলেও মুকুল কিন্তু ওয়াকআউট করেননি। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কোনও নেতিবাচক বিবৃতিও দেননি।
শেষ পর্যন্ত মমতা যাতে শুধু আনসারি নন, প্রণববাবুকেও ভোট দেন, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সনিয়া-মনমোহন। চেষ্টা সফল হবে কি না, তা এখনই বলা কঠিন। প্রণববাবুর বেলায় মমতা ভোটদানে বিরত থাকলেও তা কংগ্রেসের প্রাপ্তি। তবে আনসারিকে তৃণমূল যাতে ভোট দেয়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কংগ্রেস। এমনও হতে পারে, মমতা দু’টো ক্ষেত্রেই ভোটদানে বিরত রইলেন। কিন্তু কৃষ্ণা বসুকে প্রার্থী করে দিল্লির রাজনীতিতে কেন্দ্রের সঙ্গে প্রকাশ্য যুদ্ধে যাওয়ার কৌশল তিনি নিতে চাইছেন না। |