সংস্কার নিয়ে এ বার ভারতের সমালোচনায় মুখর হলেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। খুচরো ব্যবসা-সহ একাধিক ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির পথ আটকে দিয়ে ভারত বিনিয়োগের রাস্তায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে বলে আজ মন্তব্য করেছেন তিনি। তাঁর পরামর্শ, বৃদ্ধির গতি বজায় রাখতে কিছু ‘কঠিন’ সিদ্ধান্ত নিতে হলেও এখনই দ্রুত সংস্কারের পথে হাঁটুক দিল্লি। ওবামার এই সমালোচনায় যথেষ্ট অস্বস্তিতে পড়েছে দিল্লি। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, ভারতের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক না জেনেই এমন কথা বলেছেন ওবামা। ঘরের মাঠে বিরোধীরা বা শিল্পমহল মনমোহন সরকারের নীতি-পঙ্গুত্ব নিয়ে সরব হলেও আজ কিন্তু তারা সরকারের পাশেই দাঁড়িয়েছে। শিল্পমহলের বক্তব্য, দেশে সংস্কারের প্রয়োজন আছে ঠিকই। কিন্তু এ ব্যাপারে ভারতের সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। আর বিরোধীদের অভিযোগ, নির্বাচনের আগে নিজের দেশের বাণিজ্য মহলের মন পেতেই খুচরোয় বিদেশি লগ্নি-সহ নানা বিষয়ে সুর চড়িয়েছেন ওবামা।
রবিবার ওয়াশিংটনে সংবাদসংস্থা পিটিআইকে এক সাক্ষাৎকারে ওবামা বলেন, “মার্কিন বাণিজ্য মহল আমাকে বলেছে যে, ভারতে বিনিয়োগ করা এখনও খুব কঠিন। কারণ খুচরো ব্যবসা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সেখানে বাধা বিস্তর। কিন্তু ভারত-আমেরিকা দু’দেশেই আরও বেশি কর্মসংস্থানের জন্য ওই বাধা দূর করা জরুরি। আগামী দিনে নিজেদের আর্থিক বৃদ্ধির গতি বজায় রাখতেও এই রাস্তায় হাঁটা ছাড়া ভারতের উপায় নেই।” বস্তুত দেশের আর্থিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন ভারতীয় বাণিজ্য মহল দীর্ঘদিন ধরেই সংস্কার প্রশ্নে সরকারের উপরে চাপ বাড়াচ্ছে। গত আড়াই বছরে সংস্কার প্রশ্নে একাধিক বার এগিয়েও শরিকি বাধায় বারেবারে পিছিয়ে এসেছে সরকার। সরকারের এই নীতি-পঙ্গুত্ব নিয়ে বহু দিন ধরেই সরব শিল্পমহল। এই অবস্থায় অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব হাতে নিয়েই সংস্কারের পথে যাবতীয় বাধা কাটাতে কাটাতে উদ্যোগী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবং এ ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ হতে পারে খুচরো ব্যবসায় বিদেশ লগ্নিতে ছাড়পত্র দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী চাইছেন, গোড়ার দিকে এমন সব বিষয় নিয়ে এগোতে, যেগুলি রূপায়ণের জন্য সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। তার মধ্যেই আজ ওবামার সমালোচনা দিল্লির অস্বস্তি বাড়িয়েছে। দিল্লির তরফে বলা হচ্ছে, ভারতের মজবুত আর্থিক ভিত্তি সম্পর্কে ওবামাকে ঠিক মতো জানানো হয়নি। কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রী বীরাপ্পা মইলির আবার অভিযোগ, “ভোডাফোনের মতো কিছু আন্তর্জাতিক লবি ভারত সম্পর্কে গল্প ছড়াচ্ছে।”
ভারতের বিনিয়োগ-পরিবেশ নিয়ে সমালোচনা করলেও আগাগোড়াই যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন ওবামা। পিঠ বাঁচাতে গোটা বিষয়টিই তিনি ঠেলেছেন মার্কিন বাণিজ্য মহলের কোর্টে। যুক্তি দিয়েছেন, ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের অন্যতম কারিগর যারা, সেই মার্কিন বাণিজ্য মহলই এ দেশে লগ্নির গুমোট পরিবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ওবামার মতে, আরও এক দফা সংস্কারের ঢেউ তোলা উচিত দিল্লির। সমালোচনার পাশাপাশি বিশ্ব জোড়া আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেও ভারত যে ভাবে আকর্ষণীয় বৃদ্ধির হার ধরে রেখেছে, আজ তার প্রশংসা করেছেন ওবামা।
আজ যে মার্কিন বাণিজ্য মহলকে ওবামা ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন, কয়েক মাস আগে তারাই হোয়াইট হাউসকে একটি গোপন নোট পাঠায়। সেখানেই খুচরোয় বিদেশি লগ্নি-সহ সংস্কারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিল্লির মনোভাবের সমালোচনা করেছিল তারা। তার পর থেকেই সংস্কার নিয়ে চাপ বাড়িয়েছে ওয়াশিংটন। সম্প্রতি ভারত সফরে এসে মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনও মনমোহনকে সংস্কারের পথে ফেরার কথা বলেছিলেন। ওবামার আজকের সমালোচনা তারই অংশ বলে মনে করছে দিল্লি।
সংস্কারের দাবিতে দীর্ঘদিন সরব দেশের শিল্পমহল ওবামার বক্তব্যের পরে অন্তত প্রকাশ্যে দিল্লির পাশেই দাঁড়িয়েছে। বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের সেক্রেটারি জেনারেল ডি এস রাওয়াত বলেন, “আমেরিকা নিজের দেশের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাক। ভারত তার সমস্যা বুঝে নেবে। আমাদের চাহিদা ও বাধ্যবাধ্যকতা অনুযায়ী আমাদের সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। সংস্কারের প্রয়োজন আছে ঠিকই, কিন্তু ওবামা বা অন্য কেউ ভারত সরকার বা ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের কোনও নির্দেশ দিতে পারেন না।” সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, খুচরো ব্যবসা, বিমান পরিবহণ বা বিমা সব ক্ষেত্রেই সংস্কারের প্রয়োজন আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই লক্ষ্য পূরণও হবে। ভারতের আর্থিক পরিস্থিতি যে অন্য অনেকের থেকে ভাল, তা জানিয়ে ফিকির সেক্রেটারি জেনারেল রাজীব কুমার বলেন, “এমন বহু ইতিবাচক দিক রয়েছে, যা লগ্নি টানা ও জিডিপি-র হার বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট।”
ওবামার বক্তব্যের সমালোচনা করে সিপিএম নেতা নীলোৎপল বসু বলেন, “ওরা (আমেরিকা) চায়, ওদের শর্তে আমাদের দেশের অর্থনীতি এবং বাজার খুলে দেওয়া হোক। সেই জন্যই চাপ দিচ্ছে।” ওবামার বক্তব্য ‘হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করে বিজেপির মুখপাত্র মুখতার আব্বাস নকভি বলেছেন, লগ্নি নিয়ে সেই দেশ আমাদের সার্টিফিকেট দিচ্ছে, যারা নিজেরাই অর্থনৈতিক সমস্যায় ধুঁকছে! |