|
|
|
|
|
|
|
তার পর অন্ধকার |
জ্ঞান হারালেন জন জেফানিয়া হলওয়েল। ভোরবেলায় প্রহরীরা জামার হাতা দেখে কেল্লার
গভর্নরকে চিনতে পারল। বেশ কিছু উলঙ্গ মৃতদেহের নীচে চাপা পড়ে, তখনও প্রাণ আছে।
২০ জুন, ১৭৫৬। ব্ল্যাকহোল কেলেঙ্কারি, কলকাতা। ঘটনা? রটনা? গৌতম চক্রবর্তী |
এর নাম জি পি ও! গথিক থামওয়ালা সাদা বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করছে কয়েকশো মানুষ। খাম, পোস্টকার্ড, মানি ট্রান্সফার প্রতিটি কাউন্টারে ব্যস্ত লাইন। ফুটপাথেও দাঁড়ানোর জায়গা নেই, এ ওকে ধাক্কা মেরে ফেয়ারলি প্লেসের দিকে এগিয়ে চলেছে, কেউ বা উল্টো পথে রাজভবনের দিকে। জনতার গ্রহসমস্যা সমাধানের জন্য এক জন সিঁড়িতে বিভিন্ন গাছের মূল, তাবিজকবচ নিয়ে বসে পড়েছেন, পাশেই এক তরুণ এক গোছা লটারির টিকিট নিয়ে, ‘পাঁচ টাকায় দশ লাখ, বড় খেলা, শনিবার ড্র।’ কেউ সিঁড়িতে নানা দেশের ডাকটিকিটের পসরা সাজিয়ে। দশ টাকার কলম, ক্যালকুলেটর, হাঁপানির ওষুধ, প্লাস্টিকের খেলনা, ইডলি-দোসা, লস্যি... বিবাদীবাগগামী মিনিবাসগুলি কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উল্টো দিকে রাইটার্স বিল্ডিংস-এর রাস্তায় ঘুরে যাচ্ছে, কোনও কন্ডাক্টর আবার বাসের গায়ে থাবড়া মেরে লোক ডাকছেন, ‘হাওড়া হাওড়া’! দুপুবেলায় ডালহৌসি পাড়া এখন জমজমাট, ভিড় উথলে উঠছে।
জি পি ও-র সিঁড়িতে ওঠানামা ভিড়টা সিঁড়িতে মিশে থাকা পিতলের পাতের দিকে তাকিয়েও দেখছে না, অভ্যাসমত সেটি মাড়িয়ে জনসমুদ্রে মিশে যাচ্ছে। উঠতে গিয়ে তিন নম্বর ধাপের ধারে সেই পাতের শুরু, অনেকটাই কালচে, মলিন। তবু দু’এক জায়গায় এখনও চকচক করছে। সরকারি বাড়ির সিঁড়ি নিজস্ব যান্ত্রিক নিয়মে ধোয়ামোছা হয়, কিন্তু পিতলের পাতটি কেউ পরিষ্কারের চেষ্টা করে না। অনাদরে অবহেলায় পায়ের নীচে পড়ে থাকে।
মার্বেল পাথরের সিঁড়িতে পিতলের পাত কেন? উত্তরটা জি পি ও-র গায়ে এক পাথরের ফলকে লেখা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে ডান দিকে ইংরেজিতে ‘moneygram’ লেখা কাউন্টার। দরজায় পোস্টার, ‘ডাকব্যবস্থার বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সমস্ত মানুষ এক হও।’ এই দরজার ওপরে, অনেকটা উঁচুতে শ্বেতপাথরের ফলকে ইংরেজিতে যা লেখা তার মর্মার্থ, ‘সিঁড়ি ও সংলগ্ন ফুটপাথের এই পিতলের পাত পুরনো ‘ফোর্ট উইলিয়ম’-এর দক্ষিণ পূর্ব দিক নির্ধারণ করছে।’ আজ যেখানে জি পি ও, মাত্র ২৫৬ বছর আগে সেখানেই ছিল ফোর্ট উইলিয়ম। পলাশির যুদ্ধের আগের বছর, ১৭৫৬ সালে এখানেই বিজয়ীর বেশে দাঁড়িয়েছিলেন মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌল্লা। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। |
|
৪ ফুট চওড়া, ১৮ ফুট উঁচু ফোর্ট উইলিয়ম-এর চার কোণে সে দিন দশটা করে কামান। সদর দরজায় পাঁচটি। তবু ইংরেজরা পরাস্ত, পালানোর জন্য হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছে। ‘ডোডালি’ জাহাজে চেপে সঙ্গীদের নিয়ে ডায়মন্ড হারবারের কাছে ফলতায় পালিয়েছেন কেল্লার গভর্নর উইলিয়ম ড্রেক, কিছু পরে ‘প্রিন্স জর্জ’ নামে আর একটা জাহাজ আসবে। অবরুদ্ধ দুর্গের বাসিন্দারা তাতে চেপে বসবেন। কিন্তু বিপদ কি আর একা আসে! চড়ায় ঠেকে ‘প্রিন্স জর্জ’ সে দিন পৌঁছতে পারেনি। হুগলি নদীর চড়ায় জাহাজ আটকে যাওয়া আজকের কাহিনি নয়, ২৫৬ বছর ধরে চলছে।
জাহাজ এসে লাগত কেল্লার দোরগোড়ায়। নদী তখন স্ট্র্যান্ড রোডের ও পারে নয়, কেল্লার উত্তর দিকে ফেয়ারলি প্লেসের রাস্তায়। আজ যেখানে গাড়িঘোড়া, মানুষজনের ব্যস্তসমস্ত ভিড়, সেখান দিয়েই বয়ে যেত নদী। কেল্লার ঘাটে জাহাজ এসে ভিড়ত, জোয়ারের সময় নদীর জল ছুঁয়ে যেত কেল্লার দেওয়াল। সবই আজ স্মৃতি।
কিন্তু ইতিহাস তো নিছক স্মৃতি নয়, বছরের পর বছর জনজীবনে বিভিন্ন ভাবে মিশে থাকে। কখনও বিশ্বাসে, কখনও আচার-আচরণে, কখনও বা ভাষায়। মহানগরীর ভিড় খেয়াল করে না, ফেয়ারলি প্লেসের পাশে আজ যেখানে রেল রিজার্ভেশন কাউন্টারের উপচে পড়া ভিড়, ১৭৫৬’র ২০ জুন সেখানেই এসে নোঙর ফেলার কথা ছিল ‘প্রিন্স জর্জ’-এর। সে দিনের ‘কেল্লাঘাট’ লোকের মুখে মুখে আজ কয়লাঘাট!
|
১৭৫৬ |
পুরনো ফোর্ট উইলিয়মে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গুদাম, ফ্যাক্টরি, অফিসারদের থাকার বন্দোবস্ত, সেনাছাউনি সব কিছু। ফ্যাক্টরি মানে বাণিজ্যভবন। সেখানেই রেশম, নীল, লবণ ইত্যাদি জিনিস জড়ো হয়, পরে জাহাজে করে সেগুলি ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়।
এই ‘ফ্যাক্টরি’ বা কুঠি ব্যাপারটি ইউরোপীয় বণিকদের অবদান। ভারত বা চিনের মতো দেশগুলিতে বহু দিন ধরে বিদেশি বণিকরা যাতায়াত করে, স্থানীয়দের সঙ্গে বিভিন্ন জিনিস কেনাবেচা করে। কিন্তু পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, ইংরেজ প্রমুখ ইউরোপীয় বণিকরা এসে খেলার নিয়ম পাল্টে দেয়। তাদের আবদার, কুঠি তৈরি করতে দিতে হবে। সেখানে বাণিজ্যসম্ভার থাকবে, পাশ্বর্বর্তী এলাকায় স্থানীয় বণিক ও উৎপাদকরা থাকবেন। নবাবকে তারা প্রাপ্য নজরানা অবশ্যই দেবে, কিন্তু কুঠিতে তাদের নিজস্ব নিয়ম চলবে। আজকের ‘মুক্ত বাণিজ্য এলাকা’ বা ‘এস ই জেড’-এর পূর্বসূরি ইউরোপীয় বণিকদের এই কুঠি।
আর এই কুঠিগুলির সঙ্গে অবশ্যই থাকত কেল্লা বা দুর্গ। ভারত মহাসাগর বেয়ে দীর্ঘকাল বাণিজ্য চলছে, কিন্তু পর্তুগিজ বণিকরা নিয়ম পাল্টে দেয়। তাদের বাণিজ্যপোতের সঙ্গে তখন গানবোট, ভারতীয় জাহাজকেও তাদের থেকে ‘অনুমতিপত্র’ নিতে হবে। তার পর থেকে সব ইউরোপীয় বণিকরা একই নিয়মে বাণিজ্য চালিয়েছে। |
|
আর এই খেলায় নবাবকে কেউ পরোয়া করে না। সিরাজউদ্দৌল্লার দাদু আলিবর্দি খানের আমলেই ১৭৫৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকরা কলকাতার ফোর্ট উইলিয়মকে সুরক্ষিত করার জন্য লন্ডন থেকে ৫৯টি কামান পাঠান। সঙ্গে নির্দেশ, ‘বাণিজ্য সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা নাও, দরকারে নবাবের কর্মচারীদের ঘুষ দাও।’ ঘুষ আর দিতে হয়নি, ইংরেজরা নবাবকে না জানিয়ে গোপনে কেল্লার সুরক্ষা পাকা করে ফেলেছে।
এই রকম পরিস্থিতিতে ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে বাংলার নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসলেন তাঁর ২২ বছরের দৌহিত্র সিরাজ। মৃত্যুর সময় আলিবর্দির বয়স হয়েছিল ৮০, তার আগে এক মাস অসুস্থ ছিলেন। সেই সুযোগে মুর্শিদাবাদে ক্ষমতার অলিন্দে দুটো দল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সিরাজের বিরোধী লবির নেতৃত্বে ছিলেন তাঁর বড়মাসি, ঘসেটি বেগম। ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ সেন তাঁর ঘনিষ্ঠ। নতুন নবাব আবিষ্কার করলেন, টাকাপয়সার ব্যাপারে রাজবল্লভের বেশ কিছু হিসাবকিতাব মিলছে না। রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস ততক্ষণে পগার পার। তিনি কলকাতার কেল্লায় ইংরেজদের আশ্রয়ে। রেগে গিয়ে নবাব নারায়ণ সিংহ নামে এক পত্রবাহককে কেল্লার গভর্নর উইলিয়ম ড্রেক-এর কাছে পাঠালেন। চিঠিতে তাঁর নির্দেশ, কৃষ্ণদাসকে এখনই মুর্শিদাবাদ পাঠাতে হবে। আর কেল্লার কাজ বন্ধ রাখতে হবে।
নবাব বললেই বা ইংরেজরা শুনবে কেন? কলকাতা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোহিনুর। বাণিজ্যের পরিমাণে অন্যদের ছাপিয়ে গিয়েছে। সুতানুটি, কলকাতা, গোবিন্দপুর তিনটে গ্রাম বহু দিন ধরে কোম্পানির আওতায়। তার ওপর ১৭১৭ সাল থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বণিককুলে সবচেয়ে সুবিধাভোগী। মুঘল বাদশাহ ফারুখশিয়ার তখন ফরমান দিয়েছেন, কোম্পানিকে বাণিজ্য শুল্ক দিতে হবে না। ফরাসি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ দূর অস্ত্, দেশীয় বণিকদের কপালেও এমন সুবিধা জোটেনি।
নেট ফল, সেই ১৭৫৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতায় প্রায় এক লাখ মানুষের বাস। এঁদের মধ্যে মেরেকেটে ৪০০ ইংরেজ, বেশির ভাগই সৈন্য। শেঠ, বসাকরা কোম্পানির কুঠিতে নুন, রেশম, সুতিবস্ত্র সরবরাহ করেন। কেল্লার কাছে ‘হোয়াইট টাউন’-এ ইউরোপীয়রা ছাড়া আর কেউ থাকতে পারে না। তবে সেখানে অনেক বাড়ি এই শেঠ, বসাকদের তৈরি। তাঁরা সেগুলি সাহেবদের থাকার জন্য ভাড়া দেন। ভারতীয়রা থাকেন কেল্লার উত্তরে ‘ব্ল্যাক টাউন’-এ। সেখানে গড়ে উঠেছে দেশীয় ব্যবসায়ীদের বিশাল বাজার। নাম তার বড়বাজার। মুর্শিদাবাদের ‘হঠাৎ নবাব’কে ইংরেজরা এখানে কোন দুঃখে ছড়ি ঘোরাতে দেবে?
নবাবের দূত নারায়ণ সিংহকে প্রায় তাড়িয়ে দিলেন ড্রেক। ‘হিজ এক্সেলেন্সি নবাব নিশ্চয় জানেন, মাদ্রাজ আক্রমণ করে ফরাসিরা আমাদের কত ক্ষতি করেছে’, সিরাজকে লিখলেন তিনি। নারায়ণ সিংহ অবশ্য অপমান ভোলার পাত্র নন। তিনি নবাবকে বললেন, ‘‘কতকগুলি বুড়বক ফিরিঙ্গি, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে শৌচকর্ম করতেও শেখেনি, তারা যদি নবাবের দূতকে ভাগিয়ে দেয়, আমাদের সম্মান কথায় থাকল?’’
১৬ জুন, ১৭৫৬। ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে কলকাতায় পৌঁছলেন নবাব। নবাবের সেনাদের অগ্রগতি রুখতে ব্ল্যাক টাউনে খোড়ো চালার বাড়িগুলি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু লাভ হয়নি। কেল্লা এলাকা থেকে ভারতীয়রা পালিয়ে গিয়েছে, বড়বাজারে চলছে লুঠতরাজ। তিন দিন ধরে নবাবের সৈন্যদের গোলা আছড়ে পড়ল আজকের জি পি ও, লালদিঘির আশেপাশে। ১৯ জুন দুপুবেলায় কেল্লাঘাট থেকে জাহাজে চেপে পালিয়ে গেলেন গভর্নর ড্রেক।
নেতা পালিয়েছেন, দুর্গে অব্যবস্থার চূড়ান্ত। অবশিষ্ট কাউন্সিল সদস্যরা জন জেফানিয়া হলওয়েলকে গভর্নর নির্বাচিত করলেন। নতুন গভর্নর প্রথমেই সৈন্যদের প্রতিশ্রুতি দিলেন, কেল্লা বাঁচাতে পারলে কুঠির সম্পদ তাদের মধ্যে ভাগ করে দেবেন। কিন্তু বড় অফিসারেরা চম্পট দিয়েছেন, সাধারণ সৈন্যদের কী দায়? কেউ বেধড়ক মদ খেতে মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন, কেউ বা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলেন। ২০ জুন বিকেলে দেড়শো হতক্লান্ত সৈনিককে নিয়ে সন্ধির পতাকা ওড়ালেন হলওয়েল।
বন্দি হলওয়েলকে নিয়ে আসা হল নবাবের সামনে। নবাবের ধারণা, কুঠিতে অনেক টাকা। কিন্তু সৈন্যরা এসে জানাল, কোষাগারে আছে মাত্র পঞ্চাশ হাজার! হলওয়েল জানালেন, এর বেশি তিনি কিছু জানেন না। সবে গভর্নর হয়েছেন, কোষাগারের পুরো খবর তাঁর কাছে নেই। ‘এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই’-এর সেই বাজারে গভর্নর ড্রেক এবং তাঁর সঙ্গীরা টাকা সরিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন কি না, সেই ধন্দ আজও কাটেনি। হলওয়েল সহ ১৪৬ জনকে সেই রাতটা কয়েদ করে রাখার নির্দেশ দিলেন বিরক্ত নবাব। |
|
অন্ধকূপ |
কয়েদ তো করা হবে, কিন্তু কয়েদখানাটা কোথায়? নবাব ততক্ষণে বিচারসভা ছেড়ে উঠে গিয়েছেন। সিপাইসান্ত্রিরা খবর নিয়ে জানল, দুর্গে ‘ব্ল্যাক হোল’ নামে একটা জায়গা আছে। পলাতক গভর্নর ড্রেক দিন কয়েক আগে জালিয়াতির অভিযোগে সেখানেই উমিচাঁদ নামে এক বণিককে বন্দি করে রেখেছিলেন।
জুন মাসের ভ্যাপসা গরমে রাত আটটা নাগাদ হলওয়েল ও অন্যদের প্রহরীরা ঠেলে ঢুকিয়ে দিল ১৮ বাই ১৮ ফুটের সেই বর্গাকার খোপে। ঘরের উত্তর দিকে দরজা, পশ্চিমে লোহার গরাদ দেওয়া দু’টি ছোট জানলা। যে দিক দিয়ে হাওয়া বয়, সেই দক্ষিণ ও পূর্ব দিক পাঁচিল তুলে বন্ধ। ১৪৬ জনকে আলোবাতাসহীন এই অন্ধকূপে রাত কাটাতে হবে?
কিন্তু সিরাজ তো বন্দি হলওয়েলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁদের কোনও ক্ষতি করা হবে না! জানলা দিয়ে এক প্রহরীকে ডাকলেন হলওয়েল। এই অসহ্য গরমে অর্ধেক বন্দিকে অন্য ঘরে পাঠানো যাবে? তা হলে প্রহরীকে হাজার টাকা দেবেন তিনি। লোকটি কিছুক্ষণ বাদে এসে জানাল, নবাব ঘুমিয়ে পড়েছেন। যা ব্যবস্থা, সকালে হবে।
শুরু হল দুর্যোগের রাত। গাদাগাদিতে সকলে ঘেমেনেয়ে একাকার, ঠিকঠাক শ্বাস নেওয়াও যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে হলওয়েল দেখলেন, পাঁচ জন ছাড়া বাকিরা জামাপ্যান্ট খুলে ফেলেছে। সবাই একটু হাওয়ার জন্য জানলার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে, এ ওর ঘাড়ে ভর করে উঠছে, কেউ মেঝেতে বসে পড়ছে। তাদের মধ্যে দুর্বল লোকগুলি আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। এক প্রহরী দয়াপরবশ হয়ে জানলার কাছে জল নিয়ে এল, তৃষ্ণার্ত বন্দিরা সে দিকে ছুটল। যত বার জলপাত্র এগিয়ে দেওয়া হয়, বন্দিদের ঠেলাঠেলিতে ছিটকে যায়। কারও ঠোঁট অবধি জল পৌঁছয় না। সর্বনাশটা আঁচ করতে পারছিলেন হলওয়েল, জানলা ছেড়ে নড়লেন না তিনি। গা বেয়ে অঝোরে ঘাম ঝরছে, সেটিই চেটে নিচ্ছেন। আয়ারল্যান্ডের বণিক পরিবারের সন্তান হলওয়েল চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষিত। তিনি জানেন, শরীরে এই অবস্থায় নুনের প্রয়োজন।
অন্ধকারে ঘামে ভেজা জামার হাতা চিবোচ্ছেন হলওয়েল, অচিরে মুখটা অন্য কারও মুখে ঠেকে গেল। পাশের লোকটিও হলওয়েলের জামার হাতা চিবোচ্ছে। রাত সাড়ে এগারোটা। দেখা গেল, বেশির ভাগই ভুল বকছে, ঠেলাঠেলির চাপে চিরতরে নুয়ে পড়ছে। রাত দুটো অবধি কোনও ক্রমে গেল, হলওয়েল আর পারছেন না। শরীরের দু’পাশে, পিঠে ক্রমশ চাপ বাড়ছে। লোকগুলি যেন তাঁর ওপরেই শরীরের ভার চাপিয়ে দিচ্ছে। রাত দুটো নাগাদ পকেট থেকে ছোট ‘পেন নাইফ’টা বের করলেন হলওয়েল। এ ভাবে থাকার চেয়ে কব্জির শিরা কেটে আত্মহত্যা করা ভাল। কিন্তু মনে জোর এনে কাপুরুষের কাজটা আর করলেন না।
তার পরই অন্ধকার, জ্ঞান হারালেন হলওয়েল। ভোরবেলায় প্রহরীরা এসে জামার হাতা দেখে কেল্লার গভর্নরকে চিনতে পারল। বেশ কিছু উলঙ্গ মৃতদেহের নীচে চাপা পড়ে, তখনও প্রাণ অবশিষ্ট আছে। নবাব তাঁকে বন্দি অবস্থায় মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
১৭৫৮ সালের ইংল্যান্ডে হলওয়েলের এই অভিজ্ঞতা যখন বই হিসেবে বেরোচ্ছে, পাশার দান ঘুরে গিয়েছে। অনভিজ্ঞ তরুণ নবাবের ফৌজ ১৭৫৬’র জুন মাসে মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়েছিল। ফলতায় ব্রিটিশদের আর তাড়া করেনি। করলে কী হত, সেই প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসে নেই। ২ জানুয়ারি ১৭৫৭, মাদ্রাজের সেন্ট জর্জ দুর্গ থেকে রবার্ট ক্লাইভ এসে কলকাতা পুনরুদ্ধার করলেন, জুন মাসে পলাশির যুদ্ধ।
পুরনো ফোর্ট উইলিয়মের পাশে যেখান থেকে নদীখাতে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল অন্ধকূপে মৃত হতভাগ্যদের দেহ, ১৭৬০ সালে মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলওয়েল সেখানে তৈরি করেছিলেন এক স্তম্ভ। আজ আর জায়গাটি বোঝার উপায় নেই। জি পি ও-র পাশে যে ‘কালেক্টরেট বিল্ডিং’, সেখানেই ছিল শহিদস্তম্ভটি। বিবাদীবাগখ্যাত বিনয়, বাদল, দীনেশরা তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে।
ভবিষ্যৎ? মাত্র দুই বছরে সাম্রাজ্যবাদ ইতিহাসের বয়ান বদলে দিল! ১৭৫৮ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশিত বইয়ে হলওয়েল সিরাজকে অত্যাচারী বলেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, সিরাজ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তিনি অন্ধকূপে ব্রিটিশদের ঢোকানোর নির্দেশ দেননি। নিচু তলার প্রহরীরা তাঁদের সেখানে আটকে রেখেছিল। আর ১৭৬০ সালে তৈরি শহিদস্তম্ভে সেই হলওয়েলই খোদাই করে দিলেন, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার অত্যাচারে ব্ল্যাক হোল কারাগারে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জন মারা গিয়েছিল। কর্নেল ক্লাইভ ও ভাইস অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে হিজ ম্যাজেস্টির সেনাবাহিনী কড়ায়-গণ্ডায় সেই হিংস্রতার প্রতিশোধ নিয়েছিল।’
|
নতুন দুর্গ |
পলাশির যুদ্ধের পরই কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিল, পুরনো দুর্গ আর নয়। ক্লাইভের পরিকল্পনা, গোবিন্দপুর গ্রামের অধিবাসীদের হটিয়ে সেখানে নদীর ধারে হবে নতুন দুর্গ। সেই মতো গোবিন্দপুর হাট সরে গেল দক্ষিণে, চেতলা গ্রামে। আজকের চেতলাহাট। গ্রামের আড়াইশো পরিবারের বসতি উঠিয়ে তৈরি হল সবুজ ময়দান। আজ যাকে ‘কলকাতার ফুসফুস’ বলা হয়, সেই ময়দান ঠিক প্রকৃতির অবদান নয়। সেটি তৈরি হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পুনর্বাসন নীতিতেই।
পুনর্বাসন মানে? মিরজাফরকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল, সিরাজের হামলায় কলকাতা দুর্গ নষ্ট হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তাঁকে। সেই টাকাতেই হল পুনর্বাসন। ক্ষতিপূরণের টাকায় নবকৃষ্ণ দেব শোভাবাজারে তৈরি করলেন তাঁর বাড়ি। গোকুল ঘোষাল তাঁর ‘ভূকৈলাসের রাজবাড়ি’ নিয়ে গেলেন খিদিরপুরে। নীলমণি ঠাকুর চলে গেলেন পাথুরিয়াঘাটা। পরে তাঁর বংশেরই একটি শাখা চলে যাবে জোড়াসাঁকোয়। নতুন দুর্গের জন্য গোবিন্দপুর গ্রামের পুনর্বাসন পরিকল্পনাই বদলে দিল কলকাতাকে, তৈরি হল আজকের সিটিস্কেপ! দুর্গ তৈরি করতে অনেক কুলি, রাজমিস্ত্রি দরকার। পলাশির দু’বছর পরে ১৭৫৯ সালে কোম্পানির নির্দেশ, দুর্গ তৈরির জন্য ধরেবেঁধে আট হাজার কুলি নিয়ে আসতে হবে। দরকারে গ্রামের চাষিদের এনে কাজে লাগাতে হবে। শোভাবাজার, পাথুরিয়াঘাটার দৌলতে শহরে তখন ‘রিয়াল এস্টেট বুম’, রাজমিস্ত্রি পাওয়া যায় না। ব্রিটেন থেকে একশো রাজমিস্ত্রি পাঠানো হয়েছিল, তারাও টাকার লোভে কোম্পানি থেকে পালিয়ে কলকাতার বাবুদের কাছে কাজ নিল। প্রায় ২৫ বছর ধরে এত সব ঝক্কি পেরিয়ে ১৭৮১ সালে পাকাপাকি ভাবে তৈরি হল আজকের ফোর্ট উইলিয়ম। খরচ পড়েছিল ২০ লক্ষ পাউন্ড। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নতুন দুর্গ তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিল আঁতোয়ান লুই হেনরি পলিয়ের নামে এক সুইস ইঞ্জিনিয়ারকে। তিনিই আজকের ফোর্ট উইলিয়মের প্রধান কারিগর। অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ড নৌ বাণিজ্যে তুখড়। কিন্তু দুর্গ তৈরি ও স্থলযুদ্ধের আয়োজনে ইউরোপের অন্য দেশগুলি এগিয়ে। সে কারণেই সুইস ইঞ্জিনিয়ার।
|
বিবেকানন্দ |
সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দ্য ব্ল্যাকহোল অব এম্পায়ার’ বইয়ে এই ভাবেই সার্চলাইট ফেলেছেন। কলকাতা শহরের ছোট ইতিহাস আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বড় ইতিহাসকে পাশাপাশি বুনতে বুনতে নিয়ে এসেছেন নতুন চিন্তার খোরাক। সেই নিয়েই নানা প্রশ্ন।
প্রশ্ন: গম্ভীরানন্দ ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’ বইয়ে দেখিয়েছিলেন, নতুন কেল্লা তৈরির সময় রামজীবন ও রামসুন্দর দত্ত গড় গোবিন্দপুর ছেড়ে উত্তর কলকাতার শিমলে পাড়ায় চলে যান। বিবেকানন্দের পূর্বপুরুষরাও মিরজাফরের কোষাগার থেকে পাওয়া ক্ষতিপূরণের টাকায় বাড়ি করেছিলেন?
পার্থ: অন্য তথ্য যখন নেই, ধরে নেওয়া যেতে পারে। গোবিন্দপুর গ্রামই এই শহরের প্রথম বড়সড় পুনর্বাসন প্রকল্প। বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ সকলের পূর্বসূরিরাই সেই প্রকল্পের আওতায় ছিলেন।
প্রশ্ন: ব্ল্যাকহোলে ঠিক ক’জন মারা গিয়েছিলেন? তখনকার ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা ১২৩ থেকে ১৪৬ নানা সংখ্যা বলছেন। পরে দেশীয় ঐতিহাসিকরা আদৌ ঘটনাটা ঘটেছিল কি না, তা নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেন। যদুনাথ সরকার লিখেছিলেন, বড়জোর ৬০ জন মারা যান...
পার্থ: ঘটনাটা হলওয়েল প্রথম লেখেন। অন্ধকার গাদাগাদিতে তিনি ঘড়ি কী ভাবে দেখলেন, রাত আটটায় এই ঘটল, সাড়ে এগারোটায় ওই... সেটা বড় প্রশ্ন। এখনকার ঠিক হিসেব, ৬৪ জনকে সেই রাতে অন্ধকূপে ঢোকানো হয়েছিল। ২১ জন বেঁচে যান, ৪৩ জন মারা যান। এই ৪৩-এর অনেকে আবার যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে সব যুদ্ধ হত, তাতে ৪৩ জনের মৃত্যু কোনও ঘটনা নয়। আধুনিক ইতিহাসে তাই ঘটনাটার গুরুত্ব থাকল না।
প্রশ্ন: কোল্যাটারাল ড্যামেজ?
পার্থ: বলতে পারেন। আজ যাকে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বলছি, সেটি নতুন ঘটনা নয়। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকেই তার বীজ পোঁতা হয়ে গিয়েছে।
|
(চলবে)
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|