কলকাতা থেকে ঠিক কত দূরে তাঁদের গ্রাম, মানচিত্রে তার একটা হিসেব আছে নিশ্চয়ই। সড়কপথে, বা রেলপথে কত কিলোমিটার যেতে হবে, তা-ও জেনে নেওয়া বিশেষ কঠিন হবে না। কিন্তু, সেই রাস্তাই একমাত্র হিসেব নয়। এমনকী, এই বিশ্বায়নের যুগেও কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের কোনও প্রত্যন্ত, সীমান্তবর্তী এলাকা ঠিক কতটা দূর, তা সেই সব অঞ্চলে গিয়ে দাঁড়ালে বোঝা যায়। ধরা যাক, যখন মেঘের পরে মেঘ জমে, বাতাস দাপিয়ে বেড়ায় দিগন্ত পর্যন্ত, কোথাও কোনও যানবাহনের দেখা নেই, আচমকা বিদ্যুৎ ফালাফালা করে দেয় বিস্মৃতির মতো কালো আকাশ, তখন সেই সব নিঝুম গ্রাম কী ভাবে ঝড়ের প্রহর গোনে, বা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নেমে আসে বীজতলায়, তা কলকাতার রাজপথে দাঁড়িয়ে বোঝা কঠিন। সে সব যেন অন্য কোনও পৃথিবী।
সেই ‘অন্য’ পৃথিবী থেকেই কলকাতায় এসে দাঁড়ালেন তাঁরা। বেশ কিছু পড়ুয়া। প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁদের বাস। অথচ, তাঁদের স্বপ্ন মোটেই প্রত্যন্তে পড়ে নেই। বরং, স্বপ্নেরা এসে দাঁড়িয়েছে সরাসরি রাজ-পথে। তাঁরা এখনও পড়াশোনা করেন। নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার কথা জানালেন সাবলীল ভাবে।
ইংরেজি ভাষায়।
কারণ, সেই ভাষাই তাঁদের দিয়েছে শক্তি। বাইরের বিরাট পৃথিবীতে নেমে আসার, তার মোকাবিলা করার, মহানগরে দাঁড়িয়ে আরও অনেকের পাশাপাশি নিজের কথাটুকুও স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়ার।
ফলে, কলকাতায় আমেরিকান সেন্টার-এর ‘লিঙ্কন রুম’ তার অনুপম গাম্ভীর্য এবং ‘হাই-টেক’ মার্কিন মুখচ্ছবি সত্ত্বেও তাঁদের মনে অকারণ ভয় জাগাল না।
যেমন, ইসমাইল সরকার খুব প্রত্যয়ী ভাবে জানালেন, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট করতে চান। |
কোন বিষয়ে?
ইংরেজি, জানাচ্ছেন ইসমাইল।
ইসমাইল পরে সত্যিই কী করবেন, তা ভবিষ্যতের বিষয়, কিন্তু এই বক্তব্যই প্রমাণ যে, স্বপ্নেরা ডানা মেলছে। যেখানে জন্মেছি, সেই পরিধটুকুই অনিবার্য নিবাস এবং নিয়তি, সেই মেঠো সমীকরণে তাঁদের বিশ্বাস নেই আর। তাঁরা চান ঊর্ধ্বগতি। অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে।
সেই রকম একটা ভাবনা থেকেই ‘অ্যাকসেস’ প্রোগ্রাম, জানালেন কলকাতায় ‘আমেরিকান সেন্টার’-এর অধিকর্তা
জেফ্রি কে রেনো। ‘অ্যাকসেস’ বলতে আসলে ‘ইংলিশ অ্যাকসেস মাইক্রোস্কলারশিপ প্রোগ্রাম’। প্রত্যন্ত সব এলাকায় যাঁরা বসবাস করেন, শহুরে সমস্ত সুযোগসুবিধা থেকে দূরে, সেই অর্থে যাঁদের জীবনযাপন বেশ খানিকটা পিছিয়ে-পড়া, তাঁদের ক্ষমতায়নের জন্যই এই কর্মসূচি।
কী ধরনের ক্ষমতায়ন?
রেনো বললেন, ক্ষমতায়ন বলতে তাঁদের সামনে যথাসাধ্য বিভিন্ন ‘অপশন’ এনে হাজির করা। যাতে তাঁরা বেছে নিতে পারেন। যাঁর সামনে যত বেশি ‘অপশন’ আছে, যাঁর বেছে নেওয়ার অধিকার আছে, সুযোগ আছে, তাঁর ‘ক্ষমতা’ তত বেশি।
সেই ‘ক্ষমতা’ নিয়ে আসছে তাঁদের যোগাযোগের ভাষা। ইংরেজি। তাঁরা বুঝতে পারছেন, বড় একটা দুনিয়ার সামনে তাঁরা নিজের কথা জানাতে পারেন। পরস্মৈপদী হওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজের কথা নিজের স্বরেই পৌঁছে যাবে বৃহত্তর জগতে।
অমর্ত্য সেন-এর ভাষা ধার করে বললে, উন্নয়ন এবং স্ব-ক্ষমতা।
এই স্ব-ক্ষমতার ব্যাপারটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তা ধরা যাবে ওই সব প্রত্যন্ত এলাকার ছবিটি গভীর ভাবে দেখলে।
ছায়াময় সেই সব অঞ্চল। আসলে, সংসার সীমান্তের মতো। সেখানে মাটির উপরে দাগ কেটেছে দু’দেশের ভাগাভাগি। জনশ্রুতি, সেখানে নাকি ছায়ামূর্তিরা ঘুরে বেড়ায়। কিছু অর্থ খরচ করলেই নাকি দিব্যি মাথা নুইয়ে দেয় সীমান্তের কাঁটাতার। এ পারের লোক ছায়ামানুষ হয়ে চলে যায় ও পারে। ও পার থেকেও নাকি চলে আসে লোকজন, আইনকানুনের ফাঁকে যে সব আবছায়া অঞ্চল, তার কিনারা ঘেঁষে। সেখানে রোজকার জীবনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে বিশ্বায়নের ছোঁয়া এত স্পষ্ট নয়। সেখানে অনেকটাই জল, মাটি আর আকাশকে জড়ো করে জীবনযাপন।
না হলে কি আর তরুণ ইসমাইল বলে ফেলেন, কলকাতায় এসে তেমন সবুজ দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের ওখানে চারিদিকে এত গাছপালা!
অনেকেরই এই প্রথম কলকাতা আগমন। ফলে, মহানগর তার যাবতীয় শব্দ আর দৃশ্য নিয়ে আশ্চর্য ভাবে ধরা দেবেই তাঁদের সামনে। অবশ্য, টেলিভিশনের দৌলতে অনেকেই কলকাতার সঙ্গে পরিচিত। অনেকে আমেরিকার সঙ্গেও পরিচিত।
আমেরিকার কোনও সিনেমা দেখেছেন?
দেখেছি।
কী সিনেমা?
কেউ বললেন, অবতার। কারও মুখে আর্নল্ড সোয়্যারজেনেগার। কেউ বললেন র্যাম্বো।
এই সব হলিউড ছবি, পণ্ডিতেরা বলবেন, রোজকার জীবন থেকে অনেক দূরে। বেভারলি হিলস তো জীবনের চেয়ে বড়, পরিভাষায় ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়েই বাঁচতে ভালবাসে। কিন্তু, সেই শেষ গ্রীষ্মে ‘আমেরিকান সেন্টার’-এর কয়েকটি ঘণ্টা দেখাল, আমেরিকা নামে অনেক দূরের এবং অনেক বড় একটা দুনিয়াকে পশ্চিমবঙ্গের কিছু গ্রামের ছেলেমেয়ে মোটেই আর দূর হিসেবে ভাবছে না। অসম্ভব কোনও গন্তব্য হিসেবে ভাবছে না।
এটাই আমরা চাই। ওদের সামনে সুযোগগুলো আরও খুলে যাক। ওরা দেখতে পাক, কত দিকে কত ভাবে জীবনটাকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তা হলেই এই কর্মসূচি সার্থক। মৃদু হেসে বললেন জেফ্রি কে রেনো।
দৃশ্যত, এই ছেলেমেয়েগুলির মুখে কোথাও জেগে উঠেছে একটা সাহস। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাওয়ার একটা সাহস।
সাহস, নাকি ক্ষমতা?
স্ব-ক্ষমতা! |