ব্যাগ গুছিয়ে...
হে সুন্দর, হে ভয়ঙ্কর...
“নমো গঙ্গে তরঙ্গে মা
পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম...”

গাড়ি ছুটছে নীলকণ্ঠ পর্বতচূড়াকে পিছনে ফেলে। দূরে ঠেলতে ঠেলতে বহু দূরে। কুয়াশায় ভর্তি থমথমে দুপুরের আকাশ, মনও ভারী পর্যটক দলের। বদ্রিনারায়ণের স্বর্গীয় সৌন্দর্য ছেড়ে যেতে তখনও যেন প্রস্তুত নয় কেউই।
কিছু দূর গিয়ে বিষ্ণুপ্রয়াগের কাছে আসতেই রাস্তার পাশে পাশে এঁকেবেঁকে চলা গঙ্গা সঙ্গ নিল গাড়ির। চালক বীর সিংহ ধরলেন গঙ্গা-স্মরণের এই গাড়োয়ালি গান,
“... গোমুখ সে তু নিকলি মা...।”
পাশে বসা সওয়ারকে বলে উঠলেন, “সাহাব গঙ্গা মাইয়া যেখানে আছে, সেই জায়গাই খুব সুন্দর হয়।” মন থেকে মেঘ সরতে শুরু করেছে বাকি সওয়ারদেরও। অলকানন্দা, সরস্বতীকে ছাড়িয়ে নতুন উদ্যমে মন ছুটে যায় মন্দাকিনীর তীরে।
গঙ্গার হাওয়া, সঙ্গে আঁকাবাঁকা পথে গাড়োয়ালি সুরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে চলতে অপছন্দ করেন না কোনও শহুরে মানুষই। এই দলটিও ব্যতিক্রম নয়। জানে, বদ্রিনারায়ণ থেকে সিয়ালসোর পৌঁছতে সময় লাগবে ঢের। প্রত্যাশামতোই স্বর্গীয় সুন্দর পথেই দুপুর পেরিয়ে বিকেল হল, বিকেল পড়ল সন্ধ্যায়, সন্ধ্যাও প্রায় গড়াল রাতে।
‘আর কত দূর বীর সিংহ?’
‘বেশিক্ষণ লাগবে না সাহাব। আর কিছুটা গিয়েই চন্দ্রপুরী। সেখানে জিজ্ঞেস করে নেব কাউকে।’
‘জিজ্ঞেস করবে কি গো! চেনো না তুমি?’
‘আগে কখনও আসিনি সাহাব। এখানে বেশি ট্যুরিস্ট আসেন না।’
অন্ধকারে জনমানবহীন ভাঙাচোরা পাহাড়ি পথে হঠাৎ যেন থমথমে হাওয়া। কিছু বন্ধ দোকানের সামনে এসে থামল গাড়ি। ‘এটাই বোধহয় চন্দ্রপুরী। কাউকে পাওয়া যায় কি না, দেখি।’
ঠিক যেমন সিনেমায় হয়, এ ক্ষেত্রেও চন্দ্রপুরীর পথ ভুল করেছিলেন চালক। উৎসাহী বাঙালি পর্যটকদের গাড়ি একটু একটু করে থমথমে। শুধু কোনও রোমাঞ্চকর গল্পের নায়িকা হয়ে ওঠার সুপ্ত আনন্দে শিহরণ তখন ক্লাস সেভেনের রুপাইয়ের মনে। সে উচ্ছ্বাসও চেপে রাখতে হচ্ছে অতি সাবধানে। বড়রা বুঝতে পারলেই যে বকুনি জুটবে ওই অসময়ে!
এ ছাড়া এক জনই ‘বেফিকর’ ছিলেন ওই দলে। গাড়িচালক নিজে। ঠিক পথ অবশ্য তখনও জেনে আসতে পারেননি তিনি। তবে গন্তব্য যে এ দিকে নয়, তা নিশ্চিত করা গিয়েছে অন্তত। অগত্যা ঘুরল গাড়ি। আর কোনও গাড়ি কখন আসবে, তার অপেক্ষা। এই নির্জন পাহাড়ে পথহারাদের ভরসার একমাত্র উপায় সেটিই। মিনিট কুড়ি অপেক্ষার পরে গাড়ি ছুটতে শুরু করল নতুন উদ্যমে।
সওয়াররা সকলেই জানেন, রাতের পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো কত বিপজ্জনক। গাড়ি তখন সরু রাস্তা ধরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। আশপাশে আর কোনও একটা গাড়ি দেখতে পেলেই যেন আশ্বাস মেলে। কিন্তু কারও দেখা নাই!
সামনে তাকালে শুধুই ভাঙাচোরা সরু পাহাড়ি পথ। কোথাও রাখা রাস্তা সারাইয়ের যন্ত্রপাতি, মানুষ নেই। এক পাশে ঘন জঙ্গলে ঢাকা উঁচু পাহাড়চূড়া। অন্য দিকে খাদ। দূরে, বহু নীচে নজরে পড়ে শান্ত নদী। সেই রাতে পর্যটকদলের একমাত্র এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণাও বলা যায়।
রাত ন’টা নাগাদ গাড়ি পৌঁছল আসল চন্দ্রপুরীর কাছে। জায়গা যে ঠিক, তা বলে দেওয়ার জন্য অবশ্য কাউকে মেলেনি। এলাকায় যে দু’চারটি বাড়ি দেখা যাচ্ছে, তার সবই ঘুমন্ত। তবু হৃৎকম্পন খানিক কমেছে সওয়ারদের। এ বার নিশ্চয়ই সন্ধান মিলবে সিয়ালসোরের!
নির্বিকার বীর সিংহ লোকালয় দেখেও আর গাড়ি থামালেন না। আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করতে হবে না। রাত ঢের হয়েছে। পেট্রল পাম্প, বন্ধ দোকানপাট, ছোট ছোট ধাবা ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটল অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে।
হঠাৎ গাড়ি থামল সওয়ারদের আর্তিতে। রাস্তার মাইলফলকে কোথাও নেই সিয়ালসোরের নাম। বড় রাস্তা থেকে নেমে গিয়েছে খাড়া পথ। বড় বোর্ডে তিলওয়ারা লজের দিকনির্দেশ।
তবে কি আরও দূর সিয়ালসোর? জেনে নেওয়ার উপায় নেই। বেশ কিছু ক্ষণ ধরে ম্যাপ ঘেঁটে বোঝা গেল গাড়ি আসলে গন্তব্য ছাড়িয়ে বেশ কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গিয়েছে। আরও কিছু ক্ষণ এ দিক-সে দিক হাতড়ে গাড়ি যখন ঘন অরণ্যের মাঝে গন্তব্য খুঁজে পেল, তত ক্ষণে চাঁদ প্রায় মধ্যগগনে। যাত্রীরা
বেশির ভাগই ক্লান্ত, কনিষ্ঠ দু’জন বেশ রোমাঞ্চিত। অতি চিন্তিত বছর তেরোর বাবান প্রথম গাড়ি থেকে নামল রবি ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ বলতে বলতে।
চাঁদের আলোয় চকচকে মন্দাকিনী থেকে আসা শিরশিরে হাওয়া এক ঝাপটায় ক্লান্তির ঘোর কেড়েছে সকলের। সিয়ালসোর গ্রাম থেকে এই আস্তানাটি বেশ খানিক দূরে, নদী এবং অরণ্যের কোলে। এ জায়গার স্বাদও তাই কিছুটা জংলি। মোবাইল আর অটোমোবাইলের সভ্যতা থেকে দিন দুয়েক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঠিক ঠিকানা।
ঘন সবুজ পাহাড়ে ঘেরা এই জায়গায় মন্দাকিনী খুবই শান্ত। তাই প্রকৃতি বেশ থমথমে। আসার পথের ভয় যেন বয়েই চলে শিরায় শিরায়। ভয় আরও বাড়িয়ে দেয় রিসর্টের তৎপর কর্মীদের সতর্কবাণী। ‘একেবারে একা কেউ বাইরে থাকবেন না। কটেজের সামনের আলো নেভাবেন না। দরজার বাইরে কোনও খাবারের থালা রাখবেন না। তেন্দুয়া আসতে পারে।’
‘তেন্দুয়া আবার কী?’ বলে ওঠে রুপাই।
তৎপর উত্তর, ‘তেন্দুয়া মানে বাঘ, বেটি।’
‘বাঘ কোথায়?’
‘ওই যে, নদীর ও পার থেকে আসে। সামনের জঙ্গল থেকে।’
তবু দু’পা গেলেই নদী। ঝকঝকে জল হাতছানি দেয় পর্যটকদের। ভয়কে বয়ে নিয়ে কাঁটাতারে হেলান দিয়ে চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করা মন্দাকিনীর দিকে চাওয়া রাতটি মনে করলে বাড়ি ফিরে শহুরে বাঙালির হিংসে হয় নিজেকেই। দূর থেকে উঁকি দেয় বরফে ঢাকা কিছু পাহাড়। ভোর হলে জানা যায়, তাদের মধ্যে এক জন স্বয়ং কেদারচূড়া। দিনের সঙ্গে আলো বাড়ে, ভয় কাটে, তবু গা ছমছম। তত ক্ষণে শোনা হয়ে গিয়েছে, আগের দুপুরেই গেটের সামনে থেকে রিসর্টের পোষ্যের আধখাওয়া দেহ উদ্ধার হয়েছে।
ভয় বাড়তে থাকে। আরও আকৃষ্ট করে লাল-নীল-সবুজ-হলুদের গা ছমছমে আশপাশ। শহর থেকে আরও সরে অরণ্যের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগায় সেই ভয়।
কিন্তু ভয়ঙ্কর সুন্দর সিয়ালসোরের নদী আর অরণ্য শুধু যত্নে কোলে নেয়, হুল্লোড়ে মিলেমিশে যায় না। অতৃপ্ত পর্যটক তাই পাহাড়ি গ্রামটাকে আরও কাছে পাওয়ার ইচ্ছে নিয়েই পরবর্তী গন্তব্যের পথ দেখে।

কী ভাবে যাবেন
সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশন হরিদ্বার। সেখান থেকে সিয়ালসোর প্রায় ১৬০ কিমি।
গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় স্টেশন চত্বর থেকে। গ্রামটা কেদারনাথ যাওয়ার রাস্তাতেই
পড়ে। সেখান থেকে ফেরার পথে দু’এক দিন বিশ্রাম নেওয়া যায় সিয়ালসৌরে।
তুঙ্গনাথ এবং চোপতা যাওয়ার পথেও থামা যায় এখানে।
কোথায় থাকবেন
সরকারি রিসর্ট রয়েছে। তবে থাকার জায়গা একটিই।
তাই আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়াই ভাল।
সঙ্গে রাখুন
নির্জন জায়গা, আশপাশে দোকান-বাজার নেই।
প্রয়োজনীয় ওষুধ নিয়ে যেতে হবে। সঙ্গে টর্চ রাখাও জরুরি।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.