অত্যাচার নিয়ে সরব আবাসিকেরা
গুড়াপ-কাণ্ডে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
গুড়াপের বেসরকারি হোমে আবাসিক মহিলার মৃত্যু-রহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিল চুঁচুড়া জেলা আদালত। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনও রাজ্য সরকারকে এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই ওই হোমের লাইসেন্স বাতিল করেছে।
বুধবার দুপুরে ‘দুলাল স্মৃতি সংসদ’ নামে ওই হোমের পাঁচিলের পাশের একটি পুকুরের ধারের মাটি খুঁড়ে গুড়িয়া (৩২) নামে এক আবাসিক মহিলার দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, মৃত্যুর আগে গুড়িয়াকে ‘ধর্ষণ’ও করা হয়েছিল বলে তাদের জানিয়েছেন ওই হোমের এক আবাসিক। পুলিশ সূত্রের খবর, গত ২১ মে রাতে বাঁকুড়া শহরের গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন এই যুবতীকে উদ্ধার করা হয়। কিছু যুবক তাঁকে উত্ত্যক্ত করছিল। সেই সময়ে অবশ্য গুড়িয়া তাঁর নাম-ঠিকানা কিছুই বলতে পারেননি। সেখান থেকেই তাঁকে গুড়াপের হোমে পাঠানো হয়।
গুড়িয়া। বাঁকুড়ায় উদ্ধারের দিন। —নিজস্ব চিত্র
গুড়িয়াকে খুনের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় হোমের সম্পাদক উদয়চাঁদ কুমার এবং সানি ও রঞ্জিত নামে আরও দু’জনকে। তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ খুন, তথ্য-প্রমাণ লোপাট এবং ধারাবাহিক ভাবে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা রুজু করেছে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের সন্দেহ, গুড়িয়াকে আগেও ওই হোমে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার দিন তিনি বাধা দেওয়ায় তাঁকে বেধড়ক পেটানো হয়। তার ফলেই তাঁর মৃত্যু হয়। কবে এই ঘটনা ঘটেছে, সে ব্যাপারে অবশ্য পুলিশ এখনও অন্ধকারে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ খুনের প্রকৃত কারণ নিয়ে আরও নিশ্চিত হতে চাইছে। তিন জনকে বৃহস্পতিবার চুঁচুড়ার মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) মঞ্জুশ্রী মণ্ডলের এজলাসে তোলা হয়। বিচারক ধৃতদের ১০ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দি দেন হোমের সুপার বুলবুল চৌধুরী।
পুলিশের পক্ষ থেকে সিজেএমের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবেদন জানানো হলে তিনি সেই আবেদন ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ রাই চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন। ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। এ দিনই বিকেলে ওই ঘটনায় তরুমল দাস এবং প্রফুল্ল মালিক নামে আরও দু’জনকে গুড়াপ থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এই দু’জন কবরের মাটি খোঁড়ার কাজ করেছিল বলে পুলিশের দাবি। উদয়চাঁদের ‘ডান হাত’ এবং এই ঘটনায় অভিযুক্ত শ্যামল ঘোষ ও সঞ্জীব দাস এখনও পলাতক। তাদের খোঁজে তল্লাশি চলছে বলে জানিয়েছেন হুগলির পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী। এই দু’জনকে ধরা গেলে গুড়িয়া হত্যা-রহস্যের জট অনেকটাই খুলবে বলেও তদন্তকারী অফিসারদের ধারণা। পুলিশ জেনেছে, হোমের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও স্থানীয় খাজুরদহ এলাকার বাসিন্দা শ্যামলের ওই হোমে অবাধ যাতায়াত ছিল। আবাসিকদের ঘরেও সে যেত।
এই ঘটনায় কেন বিচার বিভাগীয় তদন্তের আবেদন জানাল পুলিশ?
পুলিশের দাবি, হোমের হেফাজতে থাকা কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে বিচারবিভাগীয় তদন্ত হওয়াটাই নিয়ম। তা ছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে ওই হোমে মাত্রাছাড়া অনিয়ম হয়েছে। আবাসিক মহিলাদের উপরে ধারাবাহিক ভাবে শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছিল বলেও পুলিশের দাবি। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সামনেই এ দিন হোমের অব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন কয়েক জন আবাসিক মহিলা। মুর্শিদাবাদের কিশোরী দুই বোন বলে, “সৎমা আমাদের তাড়িয়ে দেয়। বছর দুয়েক ধরে এখানে রয়েছি। ঠিকমতো খেতে পাই না। স্নান করার জন্য সাবান বা তেল পাই না। আমরা বাড়ি ফিরতে চাই। কিন্তু হোমের লোকজন সে কথায় কান দেন না।” স্বামী-বিচ্ছিন্না এক মহিলা বলেন, “আমি এ বছরের গোড়ায় এখানে আসি। ইতিমধ্যে চার বার আমার উপরে অত্যাচার চালানো হয়েছে। প্রথম দিকে রাজি না হওয়ায় সিগারেটের ছ্যাঁকাও দেওয়া হয়েছে।” একই রকম অত্যাচারের কাহিনি শুনিয়েছেন আরও কয়েক জন। পুলিশ জেনেছে, মাস কয়েক আগে এক আবাসিক পঞ্জাবি মহিলা হোম থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু সে তথ্য পুলিশকে জানানো হয়নি। তা ছাড়া, যাঁদের বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে হোমের নথিতে রয়েছে, তা যথাযথ কিনা, তা-ও তদন্ত সাপেক্ষ। তদন্তকারীদের অনুমান, গুড়িয়ার মতো আরও কয়েক জনের দেহ মাটিতে পোঁতা থাকতে পারে। এ সব কারণেই বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।
রাজ্যের নারী ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র এ দিন মহাকরণে জানিয়েছেন, গুড়াপের ওই বেসরকারি হোমের লাইসেন্স ইতিমধ্যেই বাতিল করা হয়েছে। ওই হোমের ৭১ জন আবাসিককে বিভিন্ন হোমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে (দু’জনকে এ দিনই সরানো হয়েছে)। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় সমাজকল্যাণ দফতরের অধিকর্তাকে ব্যক্তিগত ভাবে তদন্ত করে ২১ দিনের মধ্যে রিপোর্ট কমিশনে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি, এ দিন থেকে ওই হোমে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্লক সমাজকল্যাণ আধিকারিককে ‘প্রশাসক’ হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। রান্না করে খাবার বিলি করা হয়েছে আবাসিকদের মধ্যে। বসেছে পুলিশ ক্যাম্প। পুলিশের পক্ষ থেকে হোমে বাড়তি আলোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। গুড়িয়ার দেহ এ দিন ময়না-তদন্তের জন্য কলকাতার এনআরএস হাসপাতালে পাঠানো হয়।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, হোমটি চালু হয় ১৯৬৪ সালে। সমাজকল্যাণ দফতরের তরফে ২০০৯ সালে শেষ বার হোমের পরিস্থিতি, সরকারি-বেসরকারি অনুদান, খরচ-সহ যাবতীয় বিষয় খতিয়ে দেখা হয়। তার পর থেকে ওই হোমে আর সরকারি কর্তাদের পা পড়েনি। কেন? জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক রমা সামন্ত এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি। প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে জেলাশাসক শ্রীপ্রিয়া রঙ্গরাজন বলেন, “যাবতীয় বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে। আবাসিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থাও হচ্ছে। ধীরে ধীরে আবাসিকদের অন্য হোমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।”
এ দিন সকালে ধৃতদের আদালতে তোলার সময়ে বিজেপি-র পক্ষ থেকে ঝাঁটা নিয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়। একই দাবিতে আদালত চত্বরে বিক্ষোভ দেখিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দেয় বামফ্রন্ট ও সিপিআইএমএল (লিবারেশন)। পুলিশ কোনও মতে ধৃতদের কোর্ট লক-আপে ঢুকিয়ে দেয়। জেলাশাসকের দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখায় মহিলা কংগ্রেস।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.