চুঁয়াতোড়ে অরন্ধন
নিরীহ সোমনাথের খুনে শোক গ্রামে
ছোট ছেলের যে বড় ধরনের বিপদ হয়েছে, ভরতপুর থানার চুঁয়াতোড় গ্রামের বাড়িতে বসে সোমবার সকাল থেকেই তার আঁচ পেয়েছিলেন বৃদ্ধ বাবা-মা। সন্ধ্যায় যখন ছেলের নিথর দেহ নিয়ে বাড়িতে পৌঁছলেন দুই দাদা, তখনও তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেননি, সোমনাথ নেই। কিছুক্ষণের স্তব্ধতার পরেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন কিরীটীভূষণ কর্মকার ও তাঁর স্ত্রী আরতিদেবী।
ততক্ষণে গোটা চুঁয়াতোড় জেনে গিয়েছে, তাদের প্রিয় সোমনাথকে বোলপুরে গুলি করে খুন করেছে ডাকাতদল। সোমবার বিকেল পর্যন্তও প্রাক্তন পঞ্চায়েত কর্মী কিরীটীভূষণবাবু ছেলের মৃত্যু সংবাদ পাননি। মা আরতিদেবীও জানতেন ছেলের বড় একটা বিপদ হয়েছে। এ দিন সন্ধ্যায় ছেলের মরদেহ দেখে উঠোনেই মাথা ঘুরে পড়ে যান কিরীটীবাবু। কান্নায় ভেঙে পড়েন আরতিদেবী। বছর চুয়াত্তরের কিরীটীবাবু বারবার বলছিলেন, “ছেলে বাড়ি ছেড়ে বাইরে থাকুক, আমি চাইনি। কী করে কী হল, তা বুঝতে পারছি না।”
সোমনাথের বাড়িতে পড়শিদের ভিড়। —নিজস্ব চিত্র।
রবিবার রাতে বোলপুর শহরের প্রফেসর্স কলোনিতে দীপঙ্কর হালদারের বাড়িতে হানা দেয় তিন ডাকাত। তাতে বাধা দিতে গিয়েই গুলিতে খুন হন সাতাশ বছরের তরতাজা যুবক সোমনাথ কর্মকার। সদ্য পাওয়া চাকরির পাশাপাশি তিনি দীপঙ্করবাবুর বাড়িতে একটি আর্ট স্কুলেও প্রশিক্ষণ দিতেন। সেই সূত্রেই শনি ও রবিবার সোমনাথবাবু দীপঙ্করবাবুর বাড়ির নীচের একটি ঘরে থাকতেন। ঘটনার সময় ডাকাতদল তাঁকে ওই ঘরেই আটকে রেখেছিল।
পরে তাঁকে ওই ঘর থেকে কেউ বা কারা বের করে। আর সেই বের করাটাই বোধহয় কাল হল! ছুটে দোতলায় গিয়ে এক ডাকাতকে জাপ্টে ধরেছিলেন সোমনাথ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, নব বিশ্বাস নামে বোলপুরের ওই দাগি দুষ্কৃতী নিজেকে ছাড়াতে সোমনাথের পেটে গুলি করে। নবকে অবশ্য জনতা ছাড়েনি। পিটিয়ে মেরেছে তাকে। এ দিন দুপুরে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন রাজ্য পুলিশের ডিআইজি (বর্ধমান রেঞ্জ) বাসব তালুকদার। নব’র সঙ্গে অন্য যে দুই ডাকাত ছিল, তাদের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। বস্তুত, এই ঘটনায় বোলপুরের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় মানুষ। কিন্তু কে এই নব বিশ্বাস? বীরভূম জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রথম দিকে বোলপুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আশপাশে নেশা করার জন্য কাশির সিরাপ ও ট্যাবলেট বিক্রি করত এই নব। পরে হার ছিনতাইয়ে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে। সেই সময় পুলিশের হাতে সে ধরাও পড়ে। ধীরে ধীরে লুঠপাটের ঘটনায় তার নাম জড়ায়। এক সময় জেলা পুলিশের কিছু অফিসার তাকে ‘সোর্স’ হিসাবেও ব্যবহার করেছেন। একাধিক বার নবকে মূলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টা করেছে পুলিশ। তাকে পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানও করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার অপরাধ প্রবণতা যে বিন্দুমাত্র কমেনি, তা রবিবার রাতের ঘটনা থেকেই স্পষ্ট বলে পুলিশের একাংশের মত। মাস ছয়েক আগেই নব বিয়ে করেছিল।
বোলপুরে তদন্তে ডিআইজি বাসব তালুকদার। সোমবার ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
বোলপুরের স্কুলবাগান এলাকার বাড়িতে মা ও স্ত্রী আছেন। এ হেন নব’র হাতে সোমনাথের খুন হওয়া এখনও যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না চুঁয়াতোড় গ্রামের মানুষ। সোমনাথের বন্ধু গৌতম নন্দী বললেন, “ও একেবারেই নিরীহ ধরনের ছেলে। ওর সঙ্গে এই ঘটনা কী করে ঘটল, তা বুঝতে পারছি না।” সোমনাথের মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া গোটা গ্রামে। সকাল থেকে গ্রামের কোনও বাড়িতে উনুন ধরেনি। গ্রামবাসী সুদেব কর্মকার, উৎপল নন্দীদের কথায়, “ছেলেটার মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকত। ওকে যে এ ভাবে মরতে হবে কে জানত? আমাদের গোটা গ্রামে আজ অরন্ধন। ছেলেটার মুখ সারাটা দিন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এই অবস্থায় কি খাবার মুখে তোলা যায়?” এক মাসও হয়নি মুর্শিদাবাদের বড়ঞার একটি বেসরকারি স্কুলে আঁকার শিক্ষকের কাজ পেয়েছিলেন সোমনাথ। তাঁর বন্ধু দীনবন্ধু পাল বলেন, “বোলপুরের প্রতি টান কিন্তু ওর কাটেনি। প্রতি শনিবার ও স্কুল থেকে সোজা চলে যেত সেখানে। থাকত দীপঙ্কর হালদারের বাড়িতেই। ও মনে করত, বোলপুরে থাকতে পারলে আরও অনেক দূর এগোতে পারবে।” বোলপুর থেকে প্রতি সোমবার সোমনাথ ফিরে আসতেন মুর্শিদাবাদের গ্রামের বাড়িতে। সোমনাথ যে স্কুলে চাকরি পেয়েছিলেন, তার ডিরেক্টর শবনম রামস্বামীর কথায়, “ও তো শনিবারও স্কুলে এসেছিল! এই খবর বিশ্বাস করতে পারছি না। খুব বেশি দিন ও এখানে ছিল না। কিন্তু সোমনাথ খুবই ভাল ছেলে ছিল। কাজের প্রতি ওর মনোযোগ আমরা সকলেই দেখেছি। শিক্ষক-ছাত্রছাত্রী নির্বিশেষে সকলেই ওকে খুব পছন্দ করত।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.