প্রথম শ্রেণির কলেজগুলিতে দিল্লি বোর্ডের জয়জয়কার, রাজ্যের বোর্ড
থেকে উত্তীর্ণ
ছাত্রছাত্রীরা সেখানে প্রায় ব্রাত্য। কেন? বিশ্লেষণ করেছেন
অসীম চট্টোপাধ্যায় |
রাজ্যের প্রথম শ্রেণির কলেজগুলির, বিশেষ ভাবে প্রেসিডেন্সি কলেজের মানোন্নয়ন নিয়ে যখন পরিকাঠামো উন্নয়ন, মেন্টর গ্রুপ গঠনের মতো ভারী ভারী পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তখন ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের কৃতী পরীক্ষার্থীদের এই কলেজগুলিতে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো অকিঞ্চিৎকর বিষয় নিয়ে লেখায় অনেকে অবাক হতে পারেন। কিন্তু দিন কয়েক আগে ফল প্রকাশের পর পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্য যে-সব উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রী আনন্দে উদ্বেল ছিল, এখন ভর্তির ক্ষেত্রে তাদের মলিন, ম্লান মুখগুলি আমায় এই লেখার ক্ষেত্রে প্ররোচিত করেছে। ঘটনা হল, প্রেসিডেন্সি কলেজ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রথম শ্রেণির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভর্তির ক্ষেত্রে সি বি এস ই বা আই এস সি-র ছাত্রছাত্রীদের জয়জয়কার, বোর্ডের কৃতীরা সেখানে ব্রাত্যপ্রায়। উদাহরণ হিসেবে, এ বছর প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির জন্য যে প্রথম মেধা-তালিকা বেরিয়েছে, সেখানে এক নজরেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রেসিডেন্সি কলেজের উদাহরণ দিলেও অন্যান্য কলেজেও ছবিটি অভিন্ন।
এ বছর প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম মেধা-তালিকায় দেখা যাচ্ছে যে, ইতিহাসে ২৫ জনের মধ্যে ২ জন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ১৭ জনের মধ্যে ৫ জন, অর্থনীতিতে ২৯ জনের মধ্যে ৫ জন, ইংরেজিতে ২১ জনের মধ্যে ৪ জন বোর্ডের পরীক্ষার্থী স্থান পেয়েছে। সমাজবিজ্ঞানে ১৮ জনের মধ্যে ১ জনও বোর্ডের ছাত্রছাত্রী নেই। মেধা-তালিকার দ্বিতীয় কিস্তিতে ছবিটি অভিন্ন। সেখানে ৪১ জনের মধ্যে ১১ জন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৪০ জনের মধ্যে ১২ জন, সমাজবিজ্ঞানে ৪৪ জনের মধ্যে ৮ জন বোর্ডের পরীক্ষার্থী রয়েছে। বিজ্ঞানে অবস্থা সামান্য ভাল। পদার্থবিদ্যায় ২৯ জনের মধ্যে ১৪ জন, রসায়নে ৩০ জনের মধ্যে ১৪ জন। উপরের তথ্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এত ধুমধাম করে যে কলেজগুলির মানোন্নয়ন যজ্ঞ শুরু হয়েছে, সেখানে ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি নগণ্য। এই চালচিত্র আমাদের আমল অর্থাৎ ষাট-সত্তরের দশক থেকে একেবারে ভিন্ন। এমনকী এক দশক আগেও ছবিটি এমন উৎকট ছিল না। তা হলে কি হঠাৎ করে বোর্ডের কৃতীদের মেধা হ্রাস পেল আর অন্যান্য বোর্ডে মেধার বৃদ্ধি ঘটল? ঘটনা মোটেও তা নয়। |
পাওয়া-না-পাওয়া। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির জন্য। ছবি: রাজীব বসু |
আসলে, আই সি এস ই, সি বি এস ই-তে জ্ঞানচর্চা তথ্য-নির্ভর, প্রশ্নপত্র অবজেকটিভ প্রশ্নবহুল এবং উত্তরপত্রে দাগ দিয়ে নম্বর তোলার সুযোগ রয়েছে। অন্য দিকে, ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের ক্ষেত্রে জ্ঞানচর্চা বিশ্লেষণ-ভিত্তিক, অবজেকটিভ প্রশ্নের সংখ্যা নগণ্য, দাগ দিয়ে নম্বর তোলার সুযোগ নেই। তাই অন্যান্য বোর্ডের তুলনায় ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডে নম্বর তোলার সুযোগ সীমিত। অন্যান্য বোর্ডের ক্ষেত্রে যেখানে শতকরা ৮০, ৯০ এমনকী ১০০ ভাগ নম্বর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডে তা অকল্পনীয়। অথচ ভর্তির ক্ষেত্রে সমস্ত বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের জন্য তৈরি হয়েছে অভিন্ন তালিকা। নম্বর-ভিত্তিক এই নির্বাচনে বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যের সম্ভাবনা খুব কম, কারণ একই মাঠে খেলার সুযোগ তাদের নেই। ফলে বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরা এক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, যার প্রতিফলন ঘটে চলেছে প্রথম শ্রেণির কলেজগুলিতে ভর্তির জন্য মেধা-তালিকায় এবং বছরের পর বছর এই অনাচার সমানে চলেছে।
মজার কথা হল, বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলেই এই নতুন বৈষম্য আমদানি করা হয়েছে। আমাদের আমলে অন্যান্য বোর্ডের সঙ্গে ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের এই পার্থক্য মাথায় রেখেই অন্যান্য বোর্ডে প্রাপ্ত নম্বর থেকে শতকরা ১০ ভাগ কমিয়ে মেধা-তালিকা তৈরি হত। বৈষম্যের অভিযোগে আদালতের হস্তক্ষেপে নম্বর কমানোর ব্যাপারটি উঠে যায়। তখন ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড ও অন্য বোর্ডের জন্য স্বতন্ত্র তালিকা প্রণীত হত। এখানেও বৈষম্যের অভিযোগ ওঠায় আদালতের রায়ে অভিন্ন তালিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন থেকেই এই নয়া বৈষম্যের সূত্রপাত। ঘটনা হল, ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডে শতকরা ৮০ ভাগ নম্বর পাওয়া বিশেষ কৃতিত্বের ব্যাপার, অথচ অন্য বোর্ডে শতকরা ৮০ নম্বর বেশ খারাপ ফল বলেই বিবেচিত হয়ে থাকে। গত বছর এক ছাত্রী বোর্ডের পরীক্ষায় শতকরা ৭৫ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৮৫ পেয়েও প্রেসিডেন্সি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রত্যাখ্যাত হয়, কারণ তালিকায় প্রথম মেয়েটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শতকরা ১০০ নম্বর ছিল, অন্যদেরও ৯০-এর কাছাকাছি। কথা উঠতে পারে, প্রেসিডেন্সি কলেজে তো প্রবেশিকা পরীক্ষা রয়েছে, সেখানে ভাল করে মোট নম্বরে ঘাটতি পূরণের সুযোগ রয়েছে। এ কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা প্রেসিডেন্সি প্রবেশিকা পরীক্ষার সঙ্গে পরিচিত নন। ওই পরীক্ষা বেশ কঠিন, এখানে নম্বর তুলে ঘাটতিপূরণ দুঃসাধ্য।
এই অবস্থায় আমাদের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী এক নিদান হেঁকেছেন। তাঁর দাওয়াই হল, পরের বছর থেকে বোর্ডের প্রশ্নপত্রে শতকরা ৫০ ভাগ অবজেকটিভ প্রশ্ন থাকবে। এতে অবশ্যই নম্বর তোলার সুযোগ বাড়বে। কিন্তু ব্রাত্যবাবু একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝতেন যে, এর ফলে উচ্চশিক্ষার দিশাটাই বদলে যাবে। তবে তাঁকে ধন্যবাদ, তাঁর এই আলটপকা প্রস্তাবে ছাত্রভর্তির অকিঞ্চিৎকর বিষয়টি উচ্চশিক্ষার দিশা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে উন্মোচিত করেছে। অনিবার্য ভাবে উঠে এসেছে এই প্রশ্ন যে, আমাদের উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য কী, আমাদের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলি থেকে প্রত্যাশা কী, কোন ধরনের জ্ঞানচর্চায় উৎসাহিত করা হবে?
বিদ্যালয় স্তরে পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে জ্ঞানচর্চায় এখানে দু’টি ধারা বিদ্যমান। এক, তথ্য-নির্ভর জ্ঞানচর্চা, যেখানে শিক্ষার বিস্তার বেশি, গভীরতা কম জোর দেওয়া হয় তথ্য জানার ওপর, বিশ্লেষণের ওপরে নয়। ফলে ছাত্রছাত্রীদের তথ্যজ্ঞানের পরিধি বাড়ে, কিন্তু বিশ্লেষণী ক্ষমতার বিকাশ তেমন ঘটে না। এখান থেকেই দলে দলে দক্ষ প্রশাসক, সফল কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের যোগ্য নেতা-কর্মীরা বেরিয়ে আসেন। জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের জন্য গবেষকরা নন, ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য দক্ষ লোকজন সরবরাহ করে থাকে এই ধারা। দুই, বিশ্লেষণ-ভিত্তিক জ্ঞানচর্চা, যেখানে জ্ঞানের বিস্তারের চেয়ে জোর দেওয়া হয় গভীরতায়। এই ধারার ফসল যোগ্য শিক্ষক-অধ্যাপকরা এবং অবশ্যই গবেষকরা যাঁরা জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগে তেমন আগ্রহী না হলেও গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনকেই জীবনের লক্ষ্য করে নিতে চান। সি বি এস ই, আই এস সি-তে মূলত প্রথম ধারাটি এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডে দ্বিতীয় ধারাটি অনুসৃত হয়ে থাকে।
স্পষ্টত, এই দুই ধারার কোনটিতে জোর দিতে হবে, সেই সিদ্ধান্তের ওপরেই নির্ভর করবে উচ্চশিক্ষার দিশা। আমাদের উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর প্রস্তাব গ্রহণ করার সরল অর্থ হল, উচ্চশিক্ষার দিশা বদলে, গবেষণার বদলে ব্যবহারিক প্রয়োগে গুরুত্ব আরোপ করা। আর বিদ্যমান ভর্তি নীতি বজায় রাখার অর্থ হল, গবেষণার মননসম্পন্ন আমাদের উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীদের রাজ্যের প্রথম শ্রেণির শিক্ষাকেন্দ্রগুলি থেকে নির্বাসিত করা।
অন্য বোর্ডেও নিশ্চয়ই প্রচুর মেধাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীরা রয়েছে। তাদের অবমূল্যায়ন এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এখানে শুধু বলতে চাওয়া হচ্ছে যে, আম গাছে আম ফলে, নিম গাছে নিম। তথ্য-নির্ভর অথবা বিশ্লেষণ-নির্ভর প্রক্রিয়াজাত ফসল অনুশীলনের অনুসারী হবে। আজকাল প্রায়ই বিলাপ শোনা যায় যে, রাজ্যে আগের মতো গবেষণায় আগ্রহীদের পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনা হল, বোর্ড অনুসৃত প্রক্রিয়াতে গবেষণার উপাদান সৃষ্ট হয়। উচ্চশিক্ষার মেধাকেন্দ্র থেকে তাদের নির্বাসনে গবেষকদের সংখ্যাল্পতাকে অনিবার্য করে।
এ কথা ঠিক যে, শুধু এটুকুতেই উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাবে না, পরিকাঠামোর উন্নয়ন ছাড়াও সেখানে তিনটি বিষয়ে আশু উদ্যোগ প্রয়োজন। এক, যোগ্য শিক্ষকদের নির্বিচার বদলি নীতির, যা প্রেসিডেন্সির মতো মেধাকেন্দ্রগুলির সর্বনাশ করে দিয়েছে, পরিবর্তন। দুই, বিভিন্ন বিষয়ে সিলেবাসের আধুনিকীকরণ। সারা পৃথিবীতে সমস্ত বিষয়ে নিত্যনতুন ধারণার উদ্ভবে চিন্তার যে সমৃদ্ধি ঘটেছে, আমাদের পাঠ্যসূচিতে তার কোনও প্রতিফলন নেই, আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীতেই আটকে আছি। প্রেসিডেন্সি কলেজের এক অধ্যাপক দুঃখ করে বলছিলেন যে, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্ররা এই চর্বিতচর্বণ শোনার জন্য আর ক্লাসে আসার প্রয়োজন বোধ করে না। এই বন্ধ্যা পাঠ্যসূচি থেকে উচ্চশিক্ষার মুক্তি আবশ্যিক। তিন, অধ্যাপকরাই যদি ‘রিফ্রেশড’ না হন, তা হলে এ অনুশীলন আনুষ্ঠানিকতামাত্র। মনে পড়ল, আমাদের আমলে কলেজে ক্লাস শেষ হওয়ার পরেও ইংরাজি ক্লাসের ছাত্ররা অধ্যাপক তারকনাথ সেনের ক্লাস করার জন্য প্রতীক্ষারত থাকতেন। অর্থনীতিতে ভবতোষ দত্ত, পদার্থবিদ্যায় অমল রায়চৌধুরী, ইতিহাসে অমলেশ ত্রিপাঠীর মতো অধ্যাপকদের ক্লাস করার জন্য অন্য কলেজের ছেলেরা ভিড় জমাতেন। সময়ের কী আশ্চর্য বদল!
শেষ কথা একটাই। যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাগ্য নির্ধারণ করে ছাত্ররাই। তাই উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের কাজ শুরু করতে হবে সেখান থেকেই। ‘মেন্টর গ্রুপ’ গঠনে ভড়ং যত আছে, কার্যকারিতা তত নেই। আমাদের রাজ্য উপযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপকদের রত্নখনি। অথচ সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি কলেজে ২৯ জন অধ্যাপক নিয়োগের খবর দেখলাম। গর্বভরে ঘোষণা করা হয়েছে, সকলেই বিদেশের বা রাজ্যের বাইরের! বিদেশি ডিগ্রি ছাড়াও আমাদের অধ্যাপকরা এ-তাবৎ শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন সেখানে মেধার ঘাটতি নেই। বরং আশঙ্কা জাগে যে, বিদেশে ‘পরস্পর পিঠ চুলকানি’র সংস্কৃতিতে দক্ষ মানুষজন বিদেশি ডিগ্রি দেখিয়ে আমাদের উচ্চশিক্ষার মেধাকেন্দ্রগুলিকে মধ্য মেধার আড়ত না করে ফেলেন। |