টিউনিসিয়া কিংবা মিশরের পথে লিবিয়া সম্ভবত হাঁটিতেছে না। আরব বসন্তের দক্ষিণা বাতাস উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে কর্নেল মুয়াম্মর গদ্দাফির স্বৈরাচারের অবসান ঘটিলেও গণতন্ত্রের আবাহন বোধ হয় রাজনৈতিক ইসলামের হাত ধরিয়া ঘটিতেছে না। উদারনৈতিক রাজনীতিকরাই লিবিয়ার সদ্য-সমাপ্ত নির্বাচনে অধিকসংখ্যক আসন পাইতে চলিয়াছেন। অন্তত প্রাথমিক গণনা-ফলে তেমনটাই প্রতিভাত। জাতীয় আইনসভার দুই শত আসনের নির্বাচনে কট্টর ইসলামপন্থীরা নয়, মাহমুদ জিব্রিল-এর মধ্যপন্থী রাজনৈতিক জোটই জয়ী হইতে চলিয়াছে। আরব বসন্ত মানেই যে পুনরুজ্জীবিত ইসলাম নয়, লিবিয়ার ভোটদাতারা চল্লিশ বছরের গদ্দাফি জমানার অবসানে তাহা স্মরণ করাইয়া দিতেছেন।
অথচ উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য প্রতিবেশীদের তুলনায় লিবিয়ায় গদ্দাফি-উত্তর পর্বে রাজনৈতিক শূন্যতা অনেক বিপজ্জনক হইয়া উঠিয়াছিল। গদ্দাফি জমানার অবসান মসৃণ বা অহিংস হয় নাই, বরং কার্যত বিদ্রোহী সেনানায়ক ও গোষ্ঠীপতিদের সশস্ত্র প্রতিরোধে গৃহযুদ্ধের চেহারা লইয়াছিল। কিন্তু গদ্দাফিকে অপসারিত করার পরেও বেনগাজির ক্ষমতাদখল লইয়া দেশে যে তীব্র হানাহানি ও রক্তক্ষয় ঘনাইয়া ওঠে নাই, বরং একটা অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি তিলে-তিলে সাঙ্গ হইয়াছে, ইহা লিবিয়ার জনসাধারণের আন্তরিক গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষারই পরিচয়বাহী। সেই সঙ্গে সম্ভবত লিবিয়ার জনজাতীয় গোষ্ঠীগুলির অভ্যন্তরীণ সংহতিও ক্রিয়াশীল থাকিয়াছে। মরুপ্রধান এই দেশটির বিভিন্ন উপজাতির বেদুইন আনুগত্য সর্বদাই গোষ্ঠী-নেতাদের প্রতি। সেই নেতাদের যদি রাজনৈতিক ভাবে একটি গণতান্ত্রিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক বন্দোবস্তের অঙ্গ করিয়া তোলা যায়, তবে ইসলামি উম্মার অবিভাজ্যতার আকর্ষণ অপেক্ষাও তাহা অধিক প্রাসঙ্গিক হইয়া উঠিতে পারে। ইসলামপন্থীরা লিবিয়ায় আপন তৎপরতা বৃদ্ধিতে কম সচেষ্ট হয় নাই। দেশের সম্ভাব্য ভাবী প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিব্রিল নিজেও নিষ্ঠাবান মুসলমান বলিয়াই পরিচিত। কিন্তু লিবিয়ায় শরিয়তি শাসন চালু করিতে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ নহেন।
স্বৈরাচারীর পতনের পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তাহা ভরাট করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও দেখা দিবে বিলক্ষণ। কিন্তু সে সমস্যা সাদ্দাম হুসেন-মুক্ত ইরাকের মতো হইবে না। কারণ সংগ্রামের অন্তিম পর্বে নেটো’র সামরিক সহায়তা পাইলেও লিবিয়ায় গদ্দাফি-বিরোধী লড়াই একান্ত ভাবেই দেশের গণতন্ত্রকামী জনসাধারণেরই লড়াই ছিল, বাহির হইতে আমদানি করা পাশ্চাত্য বন্দোবস্ত গায়ের জোরে চাপাইয়া দিবার পরীক্ষানিরীক্ষা ছিল না। তাই মার্কিন আগ্রাসন-পরবর্তী ইরাক সুন্নি-শিয়া-কুর্দ জনজাতির ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ে যে ভাবে আপনাকে নিয়ত শক্তিহীন করিয়া তুলিতেছে, গদ্দাফি-উত্তর লিবিয়ায় উপজাতীয় দ্বন্দ্ব তেমন কোনও আত্মনাশের সঙ্কট ঘনাইয়া তোলে নাই। লিবিয়ায় গণতন্ত্রের আবাহনের প্রক্রিয়ায় যাঁহারা জনপ্রতিনিধিত্বের দাবিদার, সেই রাজনীতিকরা ইসলামের সহিত কোনও প্রকাশ্য বিরোধে লিপ্ত হন নাই। আবার ইসলামকে বিশেষত শরিয়তকে শাসনপ্রণালীর একমাত্র উপাদান করিয়া তোলার ক্ষেত্রেও তাঁহাদের কোনও পূর্ব-পরিকল্পনা নাই। লিবিয়ার নিরীক্ষার দিকে তাই অবশিষ্ট আরব দুনিয়ার নজর থাকিবে। আরব ভূমির অন্যত্র, সিরিয়ায় বাশার-আল-আসাদের স্বৈরাচার এখনও বহাল। তাঁহার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও ক্রমে গৃহযুদ্ধে পরিণত হইতেছে। সেখানেও ইসলামপন্থীরা বিদ্রোহের সংগঠক নহেন। |