রাজ্য প্রশাসনের চাপে সব্জির দাম কমায় সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে। কিন্তু যে ফড়েদের ডানা ছেঁটে বাজারদর নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তাঁদের একাংশ সাময়িক ভাবে হাত গুটিয়ে নিয়ে লোকসানের বোঝা উল্টে চাষিদের ঘাড়েই চাপিয়ে দিচ্ছেন। বিপণনের বিকল্প সরকারি ব্যবস্থা না থাকায় দ্রুত পচনশীল সব্জি নিয়ে আতান্তরে পড়েছেন বহু চাষি।
উত্তরবঙ্গে ফড়েদের দাপট এখনও অনেকটাই অব্যাহত। কিন্তু সরকারি কড়াকড়িতে বহু জায়গায় পাইকারেরা বসে যাওয়ায় দক্ষিণবঙ্গের নানা এলাকায় ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন চাষিরা। শুক্রবার বর্ধমানের পূর্বস্থলী ২-এর যুগ্ম বিডিও পুলিশ নিয়ে কালেখাঁতলা পাইকারি বাজারে গেলে চাষিরা খেপে ওঠেন। তাঁদের বক্তব্য, পুলিশ দেখেই আসানসোল, দুর্গাপুর, হাওড়া, শিয়ালদহ থেকে আসা ফড়েরা চলে গিয়েছেন। তাঁরা কিছু বলতে গেলেও পুলিশ লাঠি নিয়ে তেড়ে এসেছে। এই অবস্থায় সব্জি বিক্রির ব্যবস্থা প্রশাসনকেই করতে হবে দাবি তুলে পটল-ঝিঙে ছড়িয়ে পথ অবরোধ করা হয়। দুপুর ১২টা থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা অবরুদ্ধ হয়ে থাকে কাটোয়া থেকে কালনা হয়ে হুগলির ত্রিবেণী যাওয়ার এসটিকেকে রোড।
সব্জির আকাশছোঁয়া দাম হওয়ার পিছনে ফড়ে তথা পাইকারদের যে একটা ভূমিকা আছে, তা নিয়ে কোনও মহলেই সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজ্য জুড়ে বিপণনের কাজটাও মূলত এঁরাই করেন। ফড়েরা হাত গুটিয়ে নিলে স্থানীয় বাজারে সব্জি বিক্রি করতে চাষিদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্ধমান, হুগলি, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দুই মেদিনীপুরে যে বিপুল পরিমাণ সব্জি উৎপন্ন হয়, স্থানীয় বাজারের চাহিদার তুলনায় তা অনেক গুণ বেশি। ফড়েরাই পাইকারি বাজার থেকে সেই সব্জি কিনে কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে চালান দেন। কিন্তু এ সপ্তাহের গোড়ায় সরকার দাম কমাতে বলা ইস্তক তাঁদের একটা বড় অংশ হয় সব্জি কিনছেন না অথবা কম দামে সব্জি বিক্রির জন্য চাষিদের চাপ দিচ্ছেন। |
নদিয়ার ঘূর্ণি পাইকারি বাজার, পাত্রবাজার, বেলডাঙা বাজারে ইতিমধ্যেই হানা দিয়েছে প্রশাসন। স্থানীয় চাষি অলোক বিশ্বাস, সনাতন মণ্ডলেরা বলেন, “ফড়েরা এখন বাজারে আগের মতো বেশি দামে সব্জি বিক্রি করতে পারছেন না। কিন্তু নিজেদের মুনাফা ধরে রাখতে আমাদের আরও কম দামে সব্জি বিক্রির জন্য চাপ দিচ্ছেন। না দিলে কিনছেন না। সব্জি বিক্রি না হলে কয়েক দিনে পচে যায়। বাধ্য হয়েই কম দামে ফড়েদের দিতে হচ্ছে।” ঘূর্ণি পাইকারি বাজারের আড়তদার প্রাণেশ পালের মতে, “জেলাস্তরে সব্জি মজুত রাখার পরিকাঠামো না থাকায় যে দাম পাওয়া যাচ্ছে তা নিয়েই চাষিদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।” বৃহস্পতিবার পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরেও ‘টাস্ক ফোর্স’ গেলে স্থানীয় চাষিরা রুখে দাঁড়ান। তাঁদের উৎপাদন ব্যয় উঠছে না দাবি করে ঘাটাল-পাঁশকুড়া সড়ক অবরোধ করা হয়।
বর্ধমানের কালনা-কাটোয়া থেকে শুরু করে হুগলির হরিপাল, নালিকুল, পর্যন্ত সব্জির বিপুল উৎপাদন হয়। তারকেশ্বরের মাদপুরের চাষি রফিকুল হক সরকারের আক্ষেপ, “খুব সকালে ২ টাকা কেজি দরে কিছু বরবটি বেচেছি। ফড়েরা এর বেশি দিচ্ছে না। পরে আর তা-ও হয়নি। চাষিদের সব্জি ফেলে দিতে হচ্ছে।” সব্জির দাম চেয়ে ইতিমধ্যেই কালনার নান্দাই পঞ্চায়েত অফিসে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন চাষিরা। স্থানীয় ধাত্রীগ্রাম বাজার কমিটির সহ-সম্পাদক বাবলু ঘোষও বলেন, “বহু ফড়ে না আসায় চাষিদের সব্জি এনেও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে।” বর্ধমান জেলা তৃণমূল সভাপতি (গ্রামীণ) তথা বিধায়ক স্বপন দেবনাথও স্বীকার করেন, “কলকাতার পাইকারেরা সব্জি কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। কেন ওঁরা এটা করছেন, খোঁজ নিচ্ছি।”
এই ‘কেন’র উত্তর অবশ্য ফড়েদের কথাতেই রয়েছে। হাওড়া থেকে ধাত্রীগ্রামে আসা আব্বাস শেখ নামে এক ফড়ের বক্তব্য, “কলকাতা এবং লাগোয়া বাজারে সব্জির দাম কমতে থাকায় বেশি মাল কিনতে পারছি না।” শ্যামল সাহা নামে এক ফড়ে বলেন, “বাজারে সব সময় সরকারি লোক ঘুরছে। বেশি দামে সব্জি কিনলেই বিপদ।” সিপিএম প্রভাবিত কৃষক সভার বর্ধমান জেলা সম্পাদক আব্দুল রাজ্জাক মণ্ডলের টিপ্পনী, “চাষিদের নিয়ে যে দল এত কাঁদে তারা কেন চাষিদের সমস্যা বুঝতে পারছে না?”
এ দিন রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “নজরদারির ফলে ফড়েরা যে বিভিন্ন এলাকায় হাত গুটিয়ে নিয়েছেন এবং চাষিরা সব্জি বিক্রি করতে পারছেন না, সে খবর বৃহস্পতিবারই আমাদের কাছে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে কী করণীয়, তার দিশা খুঁজে বের করতে দফতরের সচিবকে রিপোর্ট তৈরি করতে বলেছি। দফায় দফায় আলোচনা চলছে।”
চাষিদের ভাতে না মেরেও বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারাটাই বোধহয় এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। |