কালনার ধাত্রীগ্রাম মোড়ে এসটিকেকে রোডের দু’পাশে সবে ভোরের পাইকারি বাজার বসছে।
সাইকেলের হ্যান্ডেল আর কেরিয়ারে সব্জির বড়-বড় ব্যাগ ঝুলিয়ে এলাকার চাষিরা হাজির। ফড়েদের কাছে বিক্রির জন্য জমা হচ্ছে সব্জি।
বাজারে সব্জির দাম নিম্নমুখী হওয়ায় চাষিদের মুখ শুকনো। ক্যামেরা বের করতেই রে-রে করে তেড়ে এলেন কয়েক জন চাষি। ‘আপনি কে? কেন ছবি তুলছেন? আর কত কামাবেন? আপনাদের জন্যই তো এই অবস্থা!’ তির ধেয়ে আসছে চারদিক থেকে। সাংবাদিক পরিচয় দিতে অবশ্য ভুল ভাঙল। কয়েক জন জানালেন, সরকারি কর্মচারী ভেবেই তাঁরা তেড়ে এসেছিলেন।
খোলা বাজারে সব্জির দাম কমায় যে সাধারণ মানুষ খুশি, তা অস্বীকার করতে পারছেন না কেউই। সরকারের যে দামের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখা কাজ, তা নিয়েও কেউ আপত্তি তুলছেন না। কিন্তু তার পরেও চাষিদের মরিয়া কথা, “আমরা যে মরছি! বাইরের ফড়েরা ক’দিন ধরে বাজারে আসছে না। পাঁচ দিনের মধ্যেই সব্জির দাম প্রায় তিন গুণ নেমে গিয়েছে। সব্জি পচতে শুরু করেছে। এত লোকসানে আর ধৈর্য ধরতে পারছি না।” |
বছরের যে কোনও সময়ে ভোর থেকে সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত এই পাইকারি বাজার চত্বর সব্জির দরাদরিতে সরগরম হয়ে থাকে। হাওড়া, শিয়ালদহ, শ্যাওড়াফুলি থেকে বর্ধমানের বুলবুলিতলা, সাতগাছিয়া, হাটগোবিন্দপুর-সহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা সব্জি কিনতে আসেন। স্থানীয়দের তুলনায় বাইরের ফড়েরাই বেশি সব্জি কিনে নেন। ফড়েদের মধ্যে দর হাঁকা নিয়ে চলে রেষারেষি। দর চড়লেই লাভবান হন চাষিরা। ধাত্রীগ্রাম মোড় থেকে স্টেশন পর্যন্ত ভ্যান, তার পরে ট্রেনে কলকাতা এবং লাগোয়া বাজারগুলিতে পাড়ি দেয় সব্জি।
এখন অন্য ছবি। সব্জি নিয়ে চাষিদের চেনা ভিড়টা রয়েছে। কিন্তু ফড়েদের ভিড় কম। চাষিরা আফশোস করছিলেন, গত পাঁচ-ছ’দিন ধরে ক্রমশ কমছে বাইরের ফড়েদের সংখ্যা। ফলে বাজারে ভাল দামও মিলছে না। আর স্থানীয় বিক্রেতারা যে দাম দিচ্ছেন, তাতে সব্জি ফলানোর খরচ উঠছে না। ভবানীপুরের উচ্ছে চাষি পুলক মাঝি বলেন, “সার, কীটনাশকের দাম সবই বেড়েছে। এখন জলের দরে উচ্ছে বিক্রি করতে হলে দেনার দায়ে সর্বস্ব হারাব।” ফড়িংগাছির পরিতোষ মজুমদার, ভবানীপুরের বিশ্বনাথ গড়াইদের মতো অনেক চাষিরই আশঙ্কা, বর্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। জল পেয়ে সব্জির উৎপাদনও বাড়বে। ফলে বাইরের ফড়েরা এমন মুখ ঘুরিয়ে থাকলে দাম কমে যেতে পারে আরও।
চাষিরা এই পরিস্থিতির জন্য সরকারি পর্যবেক্ষকদেরই দায়ী করছেন। তাঁদের বক্তব্য, সরকারি পর্যবেক্ষকেরা বাজারে বাজারে ঘোরায় ফড়েদের উপরে চাপ তৈরি হয়েছে। সে কারণেই তাঁদের বেশির ভাগ এখন বাজারে আসছেন না। স্থানীয় নান্দাই পঞ্চায়েতের প্রধান ঈদের আলি মোল্লা বলেন, “বিক্রি করতে না পেরে অনেক চাষিই সব্জি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ফড়েরা না এলে লোকসান চলবেই।”
বেলা বাড়ছে। সব্জি নিয়ে আরও কিছু ক্ষণ ফড়েদের অপেক্ষায় বসে রইলেন চাষিরা। কিন্তু কারও দেখা নেই। সব্জির দরও ক্রমশ নিম্নমুখী। ফের ব্যাগে সব্জি ভরে চাষিদের সাইকেল গুলো গ্রামের পথ ধরে।
কালনা শহর ঘেঁষা হিডধরা এলাকায় নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির কমপ্লেক্সের মধ্যেই রয়েছে একটি পাইকারি বাজার। ধাত্রীগ্রামের মতোই ভাটার টান এখানেও। দুর্গাপুর, আসানসোল, হাওড়া, শিয়ালদহ থেকে আসা ফড়েরা এখানেও আসছেন না। বাসিন্দারা জানালেন, শুধু এই জেলারই নয়, অন্য জেলা থেকেও এখানে সব্জি বিক্রি করতে চাষিরা আসেন। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ও অন্য জেলা থেকে প্রতি দিন কয়েক হাজার কুইন্ট্যাল শশা আসে এখানে। নদিয়ার চাষি প্রশান্ত মল্লিক বলেন, “চারদিন আগেও চারশো টাকা মণ শশা বিক্রি হয়েছে। এখন তা অর্ধেকে নেমেছে।” তাঁর মতে, মালের জোগান তেমন বাড়েনি। ফড়েরা না আসাতেই দাম পড়ছে।
শুক্রবার পূর্বস্থলীর কালেখাঁতলায় দু’টি পাইকারি বাজারে পুলিশ-প্রশাসনের পরিদর্শনে গেলে চাষিরা খেপে উঠে পাঁচ ঘণ্টা পথ অবরোধ করেন। তবে জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনার দাবি, “ওই অবরোধ পরিকল্পিত। ফড়েদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” এমনিতে রোজ গড়ে ১০০ ট্রাক সব্জি বিক্রি হয় কালেখাঁতলার বাজার থেকে। কালেখাঁতলা ১, কালেখাঁতলা ২, মেড়তলা, মুখসিনপাড়া, মাজিদা, নিমদহ, পাটুলি, পিলা, ঝাউডাঙা, দোগাছিয়া-সহ ১৫টি পঞ্চায়েত এলাকার চাষিরা এই বাজারে সব্জি বিক্রি করতে আসেন। পূর্বস্থলী-২ ব্লকের বিডিও মোদাস্সর মোল্লা গেলে তাঁকে ঘিরে ধরে চাষিরা দাবি করেন, সরকারকেই বিক্রি না হওয়া মাল বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। আর পরিদর্শনে দল পাঠানো চলবে না। ফড়েরা পালিয়ে গেলে লোকসান হচ্ছে চাষিদেরই। সারের কালোবাজারি বন্ধ করারও দাবি তোলেন তাঁরা। বিক্ষোভ চলতে থাকায় বিকেলে কালনার মহকুমাশাসক সুমিতা বাগচি সেখানে যান। পুলিশও যায়। বৈঠক করে স্থির হয়, কালনার নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির মাধ্যমে সব্জি বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। যদিও ক’জন চাষি সব্জি নিয়ে সেখানে পৌঁছতে পারবেন, সে প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। |