|
|
|
|
মাঝে তা হলে কী? মরীচিকা? |
পিথাগোরাস ও তাঁর শিষ্যদের বোকা প্রতিপন্ন করতে গ্রিসের আর এক পণ্ডিত
জেনো
শোনালেন
আর এক গল্প। বুঝিয়ে দিলেন, ‘মিড্ল’ বা মাঝামাঝি জিনিসটা কত রহস্যময়।
পথিক গুহ |
এ কাহিনির নায়ক অ্যাকিলিস। গ্রিক মহাবলী। দেবতার বরে ‘প্রায়’ অবধ্য। হ্যাঁ, সম্পূর্ণ নয়, প্রায়। পূর্ণ অমরত্বের বর কখনও মেলে কি? এ ক্ষেত্রে মহাবীর, বলা যায়, নাইনটি-নাইন পারসেন্ট অবধ্য। কেন? সে আর এক গল্প। সন্তান প্রসবের পর মা ছেলের জন্য অমরত্বের বর প্রার্থনা করেছিলেন দেবতার কাছে। তথাস্তু, বলেছিলেন দেবতা, নদীর জলে চুবিয়ে নিয়ে আয় বাচ্চাকে, তা হলে শত আঘাতেও অক্ষত থাকবে তার দেহ। মা সন্তানকোলে দৌড়োলেন নদীপানে। পৌঁছে জলে চোবালেন বাচ্চাকে। কেমন করে? বাচ্চার এক পায়ের গোড়ালি মুঠো করে ধরলেন নিজের হাতে। তার পর হেঁটমুণ্ডে সন্তানকে ডোবালেন জলে। আর তৎক্ষণাৎ তুলে নিলেন জল থেকে। মনে ভয়। নাকে-মুখে জল ঢুকে মারা যায় যদি সদ্যোজাত শিশু! হায়, মায়ের উৎকণ্ঠায় হল কাল। সন্তানের পুরো দেহ ডুবল না তো জলে। মায়ের মুঠো হাতে গোড়ালি যে রইল উপরে। ফলে দেহের বাকি সবটা দুর্ভেদ্য হলেও ওই গোড়ালি হয়ে থাকল দুর্বল। যে অ্যাকিলিস মহাবীর, ট্রয়-এর যুদ্ধে একাই বধ করেন শত শত সেনা, বীর হেক্টর পর্যন্ত যার সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারান, তিনিই কি-না নিজে মারা যান সেই হেক্টরের ভাই প্যারিস-এর শরাঘাতে। যাবেনই তো, তির যে গিয়ে বেঁধে তার গোড়ালিতে!
নাহ্, আমাদের কাহিনি ট্রয়-এর যুদ্ধ নয়। সে গল্প তো শুনিয়েছেন হোমার। আমাদের কাহিনি শোনাচ্ছেন গ্রিসের আর এক পণ্ডিত। নাম তাঁর জেনো। নিবাস এলিয়া নামে একটা শহরে। তিনি তর্কযোদ্ধা। মানে, যুক্তি দিয়ে নস্যাৎ করেন মহা মহা দার্শনিকদের দাবি। জেনোর গুরু দার্শনিক পারমেনিদিস। পাণ্ডিত্যে যিনি আর এক দার্শনিকের প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি পিথাগোরাস। যিনি বিশ্বাস করেন, এক নয়, একাধিক দশা কিংবা অবস্থা এবং পরিবর্তন হল জগতের মূল সত্য। বিরোধী বক্তব্য পারমেনিদিসের। তাঁর দাবি, পরিবর্তন হল মায়া। আসলে এ জগতে কিছুই পাল্টায় না।
কে ঠিক বলছেন? পিথাগোরাস, না পারমেনিদিস? গুরুকে জেতাতে ময়দানে নামলেন জেনো। তর্কে খণ্ডন করলেন পিথাগোরাসের দাবি। কী ভাবে? অ্যাকিলিসের গল্প বানিয়ে। কী গল্প? |
|
এক দিন অ্যাকিলিস দৌড় প্র্যাকটিস করছেন ময়দানে। পথের পাশে দাঁড়িয়ে এক কচ্ছপ। সে বলল, ‘জানি আপনি মহাবীর। কিন্তু, পারবেন কি আমার সঙ্গে দৌড়ে?’ কচ্ছপের প্রস্তাবে অ্যাকিলিসের অট্টহাসি। বলে কী অবোধ জীব? দৌড়ে হারাতে চায় তাঁকে! ছোঃ! অ্যাকিলিস কচ্ছপকে বোঝাতে চাইলেন তার মূর্খামি। কিন্তু সে নাছোড়। দৌড়োবেই মহাবীরের সঙ্গে। অগত্যা অ্যাকিলিস রাজি। আর তক্ষুণি কচ্ছপের নতুন আব্দার। অ্যাকিলিস যেন তা মঞ্জুর করেন। কী আব্দার? সে তুচ্ছ জীব। দৌড়োবে মহাবীরের সঙ্গে। তাই রেস শুরু হওয়ার আগে অ্যাকিলিস যেন দয়া করে তাকে একটু এগিয়ে থাকতে দেন। বেশি নয়, সামান্য একটু এগিয়ে শুরু হবে রেস। বেশ। অবজ্ঞাভরে কচ্ছপের এই দাবিও মেনে নিলেন অ্যাকিলিস। শুরু হল দৌড়।
হায়, জেনো কহে, শুন জ্ঞানবান। জেনো বলছেন, কী মূর্খ ওই অ্যাকিলিস! হবেনই তো মূর্খ। শরীরচর্চার জন্য চিরটা কালই তো কাটালেন জিমন্যাসিয়ামে। কখনও যে ভর্তি হলেন না কোনও দার্শনিক গুরুর অ্যাকাডেমিতে। হতেন যদি, ঢাল-বল্লমের বদলে যদি শান দিতেন মগজাস্ত্রে, তা হলে কক্ষণও তাচ্ছিল্যভরে রাজি হতেন না কচ্ছপের শেষ আব্দারে। ওতেই হল কাল। কচ্ছপের কাছে হারলেন অ্যাকিলিস। কেন?
কেন আবার, জেনো বলছেন, শুরু হল দৌড়। এ বার অ্যাকিলিসের কী কাজ? কচ্ছপ যতখানি এগিয়ে থেকে দৌড়েছে, সেই ব্যবধান ঘোচানো। বেশ, খানিকটা সময় দৌড়েই তা ঘোচালেন তিনি। কিন্তু সেই সময়টায় কচ্ছপ তো বসে নেই। সেও দৌড়েছে। ফলে, এখনও কচ্ছপ অ্যাকিলিসের চেয়ে এগিয়ে। এই ব্যবধান ঘোচানোর জন্যও দৌড়োলেন অ্যাকিলিস। যত ক্ষণ দৌড়ে ঘোচালেন ব্যবধান, তত ক্ষণ দৌড়ে আবার নতুন ব্যবধান রচনা করল কচ্ছপ। ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত মহাবীর এক সময় ভঙ্গ দিলেন রণে। ধূর্ত কচ্ছপ তখন পেছনে ফিরে তাকিয়ে পরাজিত প্রতিযোগীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। জেনো কহে, শুন জ্ঞানবান, এ জগতে দৌড় অসার, গতি অলীক।
গতি যে অসম্ভব, তা প্রমাণ করে পিথাগোরাস ও তাঁর শিষ্যদের বোকা প্রতিপন্ন করতে জেনো শোনালেন আর এক গল্প। আর, সে গল্পের সাহায্যে বুঝিয়ে দিলেন, ‘মিড্ল’ বা মাঝামাঝি জিনিসটা কত রহস্যময়। কী গল্প? জেনো বললেন, ধরা যাক, একটা পিঁপড়ে ঠিক করল, সে যাবে ঘরের এক দেওয়াল থেকে উল্টো দিকের দেওয়ালে। তো অনন্তকাল চললেও পূর্ণ হবে না তার সাধ। কেন?
উল্টো দিকের দেওয়ালে পৌঁছতে হলে, পিঁপড়েকে আগে পৌঁছতে হবে দুই দেওয়ালের মাঝখানে। মানে, অতিক্রম করতে হবে অর্ধেক দূরত্ব। তা সে করল। তখন বাকি আছে অর্ধেক দূরত্ব। এ বার যেতে হবে এর মাঝখানে। মানে, অর্ধেকের অর্ধেক দূরত্বে। তা সে গেল। এখনও বাকি দুই দেওয়ালের চার ভাগের এক ভাগ দূরত্ব। এ বার যেতে হবে তার মাঝখানে। তার পর বাকিটুকুর মাঝখানে। তার পর...। তার পর...। অর্থাৎ, জেনো বলছেন, পিঁপড়েকে অতিক্রম করতে হবে অসংখ্য অগণিত পরিমাণ দূরত্ব। অনন্ত কাল চললেও যা ডিঙোনো অসম্ভব। পিঁপড়ে পারবে না এক দেওয়াল থেকে উল্টো দিকে পৌঁছতে। এর পরেও মানতে হবে গতি জিনিসটা বাস্তব?
শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী পারমেনিদিস-এর কাছে নয়, নিজের শিষ্যের কাছেও আক্রমণের শিকার হয়েছিল পিথাগোরাস-এর দর্শন। জগতের মূল নির্যাস কী? দার্শনিক থেলস বলেছিলেন, তা হল জল। ওই তরল পদার্থ দিয়ে সব কিছু গড়া। কোনও দার্শনিক বললেন, জল নয়, বাতাস হল সব কিছুর উপাদান। কেউ বললেন, বাতাস নয়, মূল বস্তু হল আগুন। পিথাগোরাস বিমূর্তের পূজারি। বললেন, ও সব নয়, সংখ্যা হল সব কিছুর নির্যাস। সংখ্যা শাসন করছে জগৎ। সংখ্যা দিয়ে সব কিছু মাপা যায়। সংখ্যা সর্বশক্তিমান। সবাই পূজা করুক সংখ্যাকে। |
|
পিথাগোরাস-শিষ্য হিপ্পাসাস প্রমাণ করে দিলেন সংখ্যা সর্বশক্তিমান নয়। তা সব কিছু মাপতে পারে না। যেমন? সামান্য একটা বর্গক্ষেত্রের কর্ণের দৈর্ঘই সংখ্যায় মাপা যায় না।
ব্যাখ্যা করা যাক ব্যাপারটা। ধরা যাক একটা বর্গক্ষেত্র। যার প্রত্যেকটা বাহুর দৈর্ঘ ১ মিটার। তা হলে তার কর্ণের দৈর্ঘ কত?
পিথাগোরাসের নিজের আবিষ্কৃত ফরমুলা অনুযায়ী,
(কর্ণের দৈর্ঘ)২ = (১ মি)২ + (১ মি)২
= ২ মি২
সুতরাং, কর্ণের দৈর্ঘ= Ö২ মি২
= Ö২ মি
Ö২ মিটার মানে কত? ব্যস, এখানেই ঝামেলা। দেখা যায় তা ১ মিটারের বেশি, কিন্তু ২ মিটারের কম। ১.৪ মিটারের বেশি, ১.৫ মিটারের কম। ১.৪১ মিটারের বেশি, ১.৪২ মিটারের কম। ১.৪১৪ মিটারের বেশি, ১.৪১৫ মিটারের কম। ১.৪১৪২ এবং ১.৪১৪৩ মিটারের মাঝে কোনও একটা দৈর্ঘ। ১.৪১৪২১ এবং ১.৪১৪২২ মিটারের মাঝে। ১.৪১৪২১৩ এবং ১.৪১৪২১৪ মিটারের মাঝে। এ ভাবে ক্রমশ সূক্ষ থেকে সূক্ষতর মাপে পৌঁছলেও কখনও ঠিক নির্ভুল নির্ধারণ করা যাবে না বর্গক্ষেত্রের কর্ণের দৈর্ঘ। তা হবেই দুই মাপের মাঝে কিছু একটা। হাজারও কাজ করলেও, বাস্তব জগতের বিপুল জটিলতার সামনে সংখ্যা অসহায়।
শোনা যায়, গুরু-বাক্য খণ্ডনের শাস্তি পেয়েছিলেন হিপ্পাসাস। পিথাগোরাস-এর নির্দেশ শিরোধার্য করে অন্য শিষ্যরা ফুসলিয়ে হিপ্পাসাসকে নিয়ে গিয়েছিল নৌকাবিহারে। তার পর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল উত্তাল সমুদ্রে। হিপ্পাসাস নাকি বিজ্ঞানের প্রথম শহিদ।
তা হতে পারেন। আমাদের ভাবনা ওই পরিমাপ নিয়ে। দুই সংখ্যার মাঝে তা হলে কী? মরীচিকা? |
|
|
|
|
|