পৃথিবীর কোমরবন্ধ বিষুবরেখা
জ লিখতে বসেছি পৃথিবীর মাঝখানটা নিয়ে। মাঝখান বলতে তার হৃৎপিণ্ড নয়, নয় ছেলেবেলার ভূগোল বইতে পড়া নিদারুণ আঁচের গনগনে কেন্দ্রস্থলটি। মানে, এও ভূগোলেরই ব্যাপার, তবে কিনা এতে কল্পনারও চমৎকার একটা মিশেল আছে। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত ছড়ানো আমাদের যে এই গোলপানা বসুন্ধরা বনবন করে ঘুরে চলেছে নিজেরই মেরুদণ্ডের ওপর, আবার একটা নিতান্ত নির্দিষ্ট রুটে একই সঙ্গে সূর্যটাকেও ঘুরে আসছে বছরভর এমনতর চনমনে চঞ্চল বাউন্ডুলে গোলগাপ্পাকে কোন দড়িতে বাঁধবেন বলুন তো? যশোদা মা, গোপাল বদমায়েশি করছিল বলে দড়ি দিয়ে বেঁধেছিলেন তার কোথায়, না পেটে (তাতেই নাম হয়েছিল দামোদর)। তাঁরই রেকমন্ডেশনে কিনা জানা নেই, তবে এই চরকির মতো পাক-খাওয়া পৃথিবীটাকেও, কল্পনা করুন, একটা রেখা দিয়ে বাঁধা হল ঠিক পেট বরাবর, মাঝখানটা, ৩৬০ ডিগ্রি। মিলল কিছু? আজ্ঞে হ্যাঁ, ভূগোল বইয়ের পাতায় পড়া বিষুবরেখা বা নিরক্ষরেখা। উত্তর আর দক্ষিণ। জুড়ে থাকা বইয়ের পাতা ছাড়াতে যেমন পেপার-নাইফ দিয়ে সমতল বরাবর কাটেন, ঠিক তেমনি এই বিষুবরেখা বা নিরক্ষরেখা বরাবর যদি গোটা পৃথিবীটাকে দু’ভাগে কেটে ফেলেন (থ্রি ডাইমেনশনে ভাবুন) তা হলে যে তলটি পাবেন, ওটাই নিরক্ষীয় তল, ওরই একেবারে মাঝখানে দেখতে পাবেন পৃথিবীর গনগনে হৃদয়টিকেও।
কে আবিষ্কার করেছিলেন এই কল্পনা-রেখা? উত্তর, একক কেউ নন। ইতিহাস ঘাঁটলে নাম উঠে আসবে অনেক। দর্শন-বিজ্ঞান-সাহিত্যে দড় গ্রিকরা অবশ্যই অগ্রগণ্য এ ক্ষেত্রেও। নাম পাই হিপারকাস-এর, যিশুর জন্মেরও দু’শো বছর আগে আকাশ-নক্ষত্র-সূর্য পর্যবেক্ষণে যিনি বুঝেছিলেন অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের রহস্য। বা টলেমি, যাঁর স্ফেরিক্যাল ট্রিগোনোমেট্রি-র জোরে বিষুবরেখার কল্পিত কিন্তু অমোঘ অবস্থান নির্ণয় কোনও ব্যাপারই ছিল না। ভাবনার অবদান আছে বহুবন্দিত পিথাগোরাসেরও। চার হাজার বছর আগে চিনারা (যাঁরা বিশ্বাস করতেন পৃথিবী গোল নয়, চ্যাপ্টা) পর্যন্ত বিষুবরেখার মোটামুটি ঠিকঠাক অবস্থান কল্পনা করেছিলেন। পৃথিবী-বিশারদদের বক্তব্য, এ এমন বিরাট কিছু ব্যাপার নয়, বিশেষত মানুষ যখন ‘by birth a natural star-gazer’. দিন পেরিয়ে রাত আসা, আবার রাত কেটে দিন, বা আকাশপথে সূর্যের পরিভ্রমণ, ঋতুতে ঋতুতে ভ্রমণপথের ভোলবদল, সমুদ্রযাত্রায় নাবিকের মাথার ওপর জেগে থাকা এক-আকাশ তারার অবস্থান আর রকমফের এই সমস্ত কিছু দিয়েই মানবমন বুঝে নিয়েছিল বিষুবরেখার উপস্থিতি। কী সহজ, স্বাভাবিক এই আবিষ্কার, অথচ কী বিস্ময়কর!
এত ক্ষণে পরিষ্কার, এত বকবকানির মধ্যমণি যে বিষুবরেখা, সে যখন গোল পৃথিবীটাকে চার দিকে ঘিরে রয়েছে, তখন সে নিজেও আসলে একটি বৃত্ত। পৃথিবীর গোটা পরিধি জুড়ে তার ব্যাপ্তি, আর তাই তার নাম ‘মহাবৃত্ত’ও বটে (great circle)। সহজেই অনুমেয়, যাত্রাপথে বিষুবরেখা ছুঁয়েছে কত না সাগর-মহাসাগরের জলরাশি, বনরাজি, জনপদ আর উদ্ধত শাখার শিখর। ম্যাপ ঘেঁটে দেখা গেল, অন্তত চোদ্দোটি দেশের স্থলভাগ বা জলভাগের ওপর দিয়ে তার রথের রশি ছুঁয়ে গেছে। আটলান্টিক, প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগর এই তিন প্রতাপী মহাসমুদ্রের বুকে পড়েছে তার পা। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা হয়ে আমাদের এশিয়াও দেখে গেছে সে, এক দিকে যেমন শুনেছে ব্রাজিলে অ্যামাজন নদীর বিশাল কলরোল, অন্য দিকে পা ভিজিয়েছে ভিক্টোরিয়া লেকের জলে, দেখেছে মালদ্বীপের প্রান্তে ভারত মহাসাগরের ফেনিল জলোচ্ছ্বাস। আফ্রিকা থেকে এশিয়া পর্যন্ত তার পথে একে একে এসেছে নানা দেশের মাইলস্টোন সো তোমে অ্যান্ড প্রিন্সিপে, গ্যাবনিজ রিপাবলিক (এই দু’টি দেশের নাম আমিও প্রথম শুনলুম), কঙ্গো রিপাবলিক, ডিমক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, উগান্ডা, কেনিয়া, সোমালিয়া, কিরিবাতি, কলম্বিয়া আর ব্রাজিল (দক্ষিণ আমেরিকায়), এমন কী মালদ্বীপ আর ইন্দোনেশিয়া। আর ইকোয়েডর দেশটার নাম তো সবাই জানেন, খোদ বিষুবরেখার ইংরেজি নাম ‘ইকোয়েটর’-এর সঙ্গে তার সম্পর্ক মাখোমাখো।
ভৌগোলিক অবস্থানই বিষুবরেখা আর তার ওপর গুটিসুটি মেরে থাকা দেশ বা জায়গাগুলোকে দিয়েছে চমৎকার কিছু বিশিষ্টতা। ২১ মার্চ আর ২৩ সেপ্টেম্বরের কথা (যথাক্রমে মহাবিষুব ও জলবিষুব) তো ছেলেবেলায় পড়েছি, হয়তো ভুলেও গিয়েছি। এই দু’টো দিনে সূর্যকিরণ লম্বভাবে পড়ে পৃথিবীর ওপর। দিন ও রাত্রি (১২ ঘণ্টা করে) সমান হয়। সে তো গেল দু’টো দিনের কথা, কিন্তু জেনে রাখুন, বিষুবরেখায় শুয়ে থাকা জায়গাগুলো পৃথিবীর সবার মধ্যে ‘quickest rates of sunrise and sunset’ দেখতে পায়। আকাশে সূর্যের গতিপথ এখানে সোজা, vertical। তত্ত্বগত ভাবে বিষুবরেখায় বছরভরই বারো ঘণ্টার দিন আর বারো ঘণ্টার রাত্তির থাকে (অবশ্যই প্রাকৃতিক নিয়মে মিনিট কয়েকের এ দিক-ও দিক বাদে)। বিষুবরেখার বা তার কাছাকাছি জায়গাগুলোতে, বোঝাই যাচ্ছে; পৃথিবার বনবনানিটা খুব বেশি (আর আর জায়গার থেকে); তাই এই জায়গাগুলো, বিজ্ঞানীদের ভাষায়, স্পেসস্পোর্টস-এর জন্য দারুণ। মহাকাশযানে চড়ে সুদূর, বিপুল সুদূরে পাড়ি দিতে চান? বিষুবরেখার ওপর কোনও জায়গা থেকে চড়ুন। ফুয়েল কম লাগবে। এই আষাঢ়ে আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদছি না মোটেও, সত্যি কথা, অঙ্কের হিসেব।
সূর্য আর পৃথিবীর বছরভর-চলা খেলার দানে বিষুবরেখা আর তার কাছাকাছি ১০ ডিগ্রি উত্তর-দক্ষিণের জায়গাগুলো (পরিভাষায় যার নাম নিরক্ষীয় অঞ্চল) জল-হাওয়া আর প্রকৃতির এক অসামান্য ‘ইউনিফর্মিটি’র সাক্ষী। এখানে দিনের কমা-বাড়া নেই, নেই আমাদের মতো ক্রান্তীয় অঞ্চলের ঋতুরঙ্গলীলা, নেই ঘুরেফিরে নিদারুণ নিদাঘ, বর্ষা-প্লাবন, ফুরফুরে শরৎ, কী শীতের দৈন্য। এখানে আছে একটাই সময়, ঋতু, কাল একটানা গ্রীষ্ম। দিনে বা রাতে, বচ্ছরভর, তাপমাত্রার বার্ষিক তারতম্য যৎসামান্যসবচেয়ে ওপরে হলে ৩০ সেলসিয়াস, সবচেয়ে কম হলে ২৭। আর যেটা সত্যিই অ-সাধারণ, সেটা হল নিত্য দিনের রুটিনমাফিক বৃষ্টি। শক্তি চাটুজ্যের কবিতা এখানে হয়ে উঠেছে বাস্তব বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস/ এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে...। ভোর এখানে রৌদ্রকরোজ্জ্বল, স্নিগ্ধ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্য সোজা উঠে যায় ওপরে, প্রকৃতি হয় তাপিত। শেষ বিকেলে নিয়ম করে বৃষ্টি নামে, সঙ্গে বজ্র-বিদ্যুতের লুকোচুরি। বাতাসে আর্দ্রতা, সারা দিনের তাপ বৃষ্টির পরেও রাতে পুরোটা বিকিরিত হতে পারে না। সন্ধে, রাত এখানে শিশিরে ভেজা, নরম। জলকণার উবে যাওয়া আর ঘনীভূত হওয়ার দ্বৈরথে চার দিক নিয়ত থাকে যুগপৎ তপ্ত ও আর্দ্র। সরাসরি উত্তুরে হাওয়া, কী দখিনা বাতাসের ছোঁয়া এখানে পাবেন না বাতাস এখানে তেরছা করে বয়। গোধূলি এখানে নিতান্ত ক্ষণিকের অতিথি, সূর্য সন্ধেবেলা সোজাসুজি চুপ করে নেমে লুকিয়ে পড়ে দিগন্তরেখার তলায়। বলবার মতো ব্যাপার যেটা, তা হল ‘হরাইজন্টাল শ্যাডো’ বা অনুভূমিক ছায়ার এখানে প্রায় দেখাই মেলে না। সূর্য সব সময় একদম ওপরে থাকে বলে উল্লম্ব যে কোনও জিনিসের ছায়া পড়ে এই একটুখানি, ছোট্ট করে।
তাপমাত্রা আর আর্দ্রতার যুগলবন্দিতে পোয়াবারো এই অঞ্চলের অরণ্য আর গাছপালার। কে না জানে, আমাজনের নিশ্ছিদ্র, দুর্ভেদ্য চিরহরিৎ বন এই বিষুবরেখারই দান! প্রাণধারা সতত সঞ্চরমাণ, চিরসবুজ এবনি, মেহগনি, রোজউড, রাবার, সিঙ্কোনা আর গ্রিনহার্ট-এর শাখা পল্লবিত-মুকুলিত-শিহরিত একে অন্যকে জড়িয়ে। ঘন বনে প্রবেশ দুঃসাধ্য, আর্দ্র অন্ধকারে যুগযুগান্ত ধরে বসবাস কত না বুনো জীবজন্তু, পোকামাকড়, সরীসৃপের। বড় বড় পাতার গাছগুলো সূর্যালোকের প্রত্যাশায় কেবল ওপরে উঠতে থাকে, একেবারে ওপরে কিছু গাছ, তার তলায় আর কিছু, নীচে আরও কিছু। স্তরে স্তরে জন্ম-নেওয়া আর বেড়ে-ওঠা এই অরণ্যকে আকাশ থেকে টপ অ্যাঙ্গল-এ দেখলে মনে হয়, কে যেন এক বিরাট গাঢ় সবুজ গালিচা পেতে রেখেছে বসবে বলে। সমুদ্রের কাছে, নদীর খাঁড়িতে জন্ম নেয় সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ। বিষুবরেখার বদান্যতায় নিরবচ্ছিন্ন এক প্রাণস্পন্দন ধ্বনিত হতে থাকে পৃথিবীর মধ্যিখানের এই জায়গাটায়।
তবে বলে রাখা ভাল, ঘন বন, চরম আর্দ্রতা আর প্রবল বৃষ্টিপাতের প্রাবল্য এখানে মানুষের দেহে আনে রোগবিকার। যে জাতি বা জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষ এই অঞ্চলে থাকেন, তাঁদের প্রায়ই ভুগতে হয় ম্যালেরিয়া, ইয়েলো ফিভার আর স্লিপিং সিকনেস-এর প্রকোপে, যুঝতে হয় হিংস্র বুনোজন্তুর সঙ্গে। কিছু কিছু চাষবাস করেন এঁরা (‘শিফটিং কালটিভেশন’ পদ্ধতিতে), নয়তো উপায় সেই শিকার আর ফলপাকুড়-লতাপাতা কুড়োনো। এখন অরণ্য নিধনের কোপ পড়েছে এই বনজঙ্গলেও। বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা, নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চল জুড়ে যে অরণ্য-প্রলেপ ছিল, তার পঞ্চাশ শতাংশ এরই মধ্যে উধাও। মাটি হারাচ্ছে তার উর্বরতার উপাদান, প্রতি দিন হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় সত্তরটি প্রজাতির প্রাণ। অশনি সংকেত দোরগোড়ায়।
আমার কথা ফুরোনোর সময় হল। কিন্তু পৃথিবীর মাঝ-বরাবর এই রেখাটির নরম-গরম বুকে জেগে থাকা ছোট্ট নটেগাছটিও কিন্তু অত সহজে মুড়োয় না। কী ভাবছেন, এ বারের পুজোর ছুটিতে বিষুবরেখা বরাবর ট্যুরটা সেরে ফেলবেন? মন্দ নয়। পকেটে ইউরো-রেস্ত, আর তেমন কোনও ঠিকঠাক ইয়ার-দোস্ত থাকলে বেরিয়ে পড়ুন কোমর বেঁধে, পৃথিবীর কোমরবন্ধ বিষুবরেখা চক্করে!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.