|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
বেঁচে থাকার বিষ |
পরমব্রত অসামান্য।
আছে জীবনের উদযাপন।
লিখছেন সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
কিছু কিছু পরিচালকের ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে পথে নিষ্ক্রান্ত হয়ে হলমুখী হতে হতে, টিকিট কেটে স্ক্রিনিং রুমের সামনে অগুনতি দর্শকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছবি শুরু হওয়ার অপেক্ষা করতে করতে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ হয়। রোমাঞ্চ হয় এই ভেবে যে পরবর্তী তিন ঘণ্টা আমরা না জানি কী দেখব, কী বুঝব, কী ভাবার অবকাশ পাব। রোমাঞ্চ হয় এই ভেবে যে অতঃপর সেই উৎকট জয়রাইডারটায় চড়ে বসব আমরা এবং আত্মবিস্মৃত হওয়ার সুযোগ পাব!
সৃজিত মুখোপাধ্যায় ঠিক এই সংজ্ঞার পরিচালক। আর তাঁর ‘অটোগ্রাফ’, ‘২২শে শ্রাবণ’-দুটো দু’ধরনের রোম্যান্টিক ছবি। (‘২২শে শ্রাবণ’-এ কবিতা আর ক্রাইমকে মিশিয়ে দেওয়ার রোম্যান্টিসিজমের কথা বলছি অবশ্যই), যে ছবি বাঙালি দর্শককে এই আত্মবিস্মৃত হওয়ার সুযোগটা দিয়েছিল। এবং ছবি দেখার ঘোরের মধ্যে আমাদের আচমকা জেগে উঠে ভাবতে হয়নি, “এ তো আমার জীবনেও ঘটেছে।” ইত্যাদি! এই সর্বক্ষণ শিল্প, সাহিত্য, সিনেমার সঙ্গে একাত্ম হতে পারার ক্লান্তি থেকে সৃজিত আমাদের মুক্তি দিয়েছিলেন। তৃতীয় ছবি ‘হেমলক সোসাইটি’র ক্ষেত্রে অবশ্য বাস্তবতার সান্নিধ্যটা অনুযাত্রিক। কিন্তু তার সঙ্গে যোগ করলেন এমন এক দর্শনকে যা বুঝতে দেরিদা বা ফুকোর শরণাপন্ন হতে হয় না। বেঁচে থাকাকে সে দর্শন নিরঙ্কুশ কৃতজ্ঞতা জানায়।
আমাদের বেঁচে থাকাটা এই সময় একটা সারাক্ষণের শিরে সংক্রান্তি দশা হয়ে উঠেছে। সারাক্ষণই আমরা জীবনের সঙ্গে একটা এসপার ওসপার টার্মসে আসার চেষ্টা করছি। নিজেকে সুযোগ দিতে গিয়ে জীবনের অর্গলহীন বহমানতাকে সুযোগ দিচ্ছি কম। আর হতাশার মুহূর্তে বারবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আত্মহত্যার। সে হতাশার কারণ যতই দীনহীন হোক না কেন সেই মুহূর্তে লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে উবে যাওয়াই যথেষ্ট কারণ আত্মধ্বংসের! |
|
হেমলক সোসাইটি
পরমব্রত, কোয়েল |
ছবিতে ‘হেমলক সোসাইটি’ যার ট্যাগলাইন ‘মরবে মরো, ছড়িও না’ এমন এক সংস্থা যার কাজ হচ্ছে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছুককে একটা আত্মহত্যার ক্র্যাশ কোর্স করিয়ে সফল ভাবে আত্মহত্যা করতে সাহায্য করা। আর সেই প্রক্রিয়ার আড়ালে তলে তলে একজনের বেঁচে ওঠার চেতনাকে জাগরিত করে তোলা। এরকম একটা বিষয়কে আয়ত্তে আনার পর, সম্পূর্ণ কমেডির বাতাবরণে গেঁথে ফেলার পর বলতেই হয় যে সৃজিতের উদ্ভাবনী ক্ষমতার কোনও তুলনা নেই। সেই সঙ্গে সংলাপের মেধাবী সমন্বয়ে ‘হেমলক সোসাইটি’ হয়ে ওঠে চূড়ান্ত এক নাটক যা মননশীল দর্শককে হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে বিষণ্ণ
করে তুলবে। আসলে সংলাপের কারণেই পর্দার অন্তরালবর্তী নায়ক এই ছবিতে সৃজিত নিজেই।
যদিও মূলত ছবিটির সার্থকতার আবর্তনটা হেমলক সোসাইটি অর্থাৎ আত্মহত্যার কর্মশালার অংশটুকুতেই আবদ্ধ।
ইন্টারভ্যালের আগের একটি দৃশ্যের প্রখরতা ছবিটাকে তুলে নিয়ে যায় একটা বিমূর্ততায়। আর বোঝা যায় সৃজিতের দক্ষতা। এই দৃশ্যে প্রিয়াঙ্কা অভিনীত চরিত্রটার মুখোমুখি হয় কোয়েল অভিনীত মেঘনা চরিত্রটি। সেই দৃশ্যে দেওয়াল জোড়া গ্র্যাফিটি, ক্যামেরার ঘূর্ণন, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর আত্মহত্যাকামী দুটি মেয়ের সামাজিক অবস্থান আর আত্মহত্যার কারণের আপাদমস্তক ভিন্নতা দর্শককে একদম মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। প্রিয়াঙ্কার অভিনয় তাড়িত করে বহু দূর অবধি। সৃজিতের এই ছবিতে প্রসেনজিৎ নেই, নেই কমার্শিয়াল ছবির মালমশলা। আপাত ভাবে কোয়েল মল্লিকের মতো একজন মেনস্ট্রিম ছবির নায়িকা সৃজিতের মেঘনা
হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে সম্ভবত এই কারণেই যে কোয়েলের মধ্যে
সেই বাঙালি ভাবমূর্তি রয়েছে সামান্য আঘাতেই জর্জরিত হয়ে ওঠে যে, আর বাইরের আঘাত সামলে উঠতে না পারলেই যে নিজেকেই আঘাত করতে উদ্যত হয়। মেঘনার চরিত্রে কোয়েলের মনোনিবেশ বোঝা যায়।
সৃজিত যে চিত্রনাট্য লিখেছেন, যে ছবি বানিয়েছেন, যে সংলাপ লিখেছেন তার সদ্ব্যবহার করেছেন ছবিতে উপস্থিত প্রতিজন অভিনেতা। আদ্যন্ত বাঙালি, বিবেকবান, রোম্যান্টিক, বাকচাতুর্যে ভরপুর ছবির নায়ক আনন্দ করের চরিত্রে পরমব্রত নিজেকে ছাপিয়ে গিয়ে অভিনয় করেছেন। একের পর এক ছবিতে আমরা যে পরমব্রতকে দেখতে পাচ্ছি তাতে তাঁর ওপর আমাদের উচ্চাশা বেড়েই চলেছে।
সব্যসাচী চক্রবর্তী, ব্রাত্য বসু, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের হেমলক সোসাইটিতে ক্লাস নেওয়ার দৃশ্যগুলো কুর্নিশযোগ্য, উপভোগ্য। তীব্র আয়রনি আর কমেডি সেখানে মিলেমিশে গেছে বারবার। একটি বিশেষ ভূমিকায় পাওয়া যায় শিলাজিৎকে। তাঁর চরিত্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছবিতে তিনি একজন গায়ক এবং তাঁর নিজের গলায় একটি গানও আছে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি চরিত্রটি বাস্তবায়িত করেছেন।
কিন্তু কোনও কারণে মেঘনার আর সাহেবের ব্রেক-আপের দৃশ্যটা সেই ভাবে দাঁড়ায়নি। যেমন দাঁড়ায়নি সৎমা রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেঘনার সম্পর্কের সমীকরণটা। যদিও রূপার অভিনয় সৎ-মেয়ের প্রতি তাঁর আত্মনিবেদনে এক ধরনের ঔদার্য ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়। ছবিতে মেঘনার বাবা-মা দু’জনেই বড় বেশি ভাল। বড় বেশি আন্ডারস্ট্যানডিং। একজন স্নেহপ্রবণ, আধুনিকমনস্ক পিতা ঠিক যেমন হওয়া উচিত, ছবিতে দীপঙ্কর দে ঠিক সে রকমই একজন বাবা। এত অগুনতি ছবিতে অভিনয়ের পরও এখনও তাঁর উপস্থিতি টাটকা বাতাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
অথচ চিত্রনাট্যের মধ্যে যে দুর্বলতা আছে, তা এই জায়গাগুলোতেই। কারণ শেষমেশ মেঘনা দুঃখবিলাসী, আধুনিক প্রজন্মের প্রতিভূ হয়ে ওঠে মাত্র। তার তত দূর বিষণ্ণ হয়ে ওঠার পেছনে কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না ছবিতে। সৃজিত কি সেটাই চেয়েছিলেন? অবশ্য পুরো ছবিটা যে বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল সেটা হল আত্মহত্যা করব করব ভাব দেওয়া আর আত্মহত্যা করে ফেলা এক ব্যাপার নয়।
অতএব বলা যায় ‘হেমলক সোসাইটি’-তে অংশত দুর্বলতার শিকার এবং অংশত ছবিটিতে প্রগাঢ় চিন্তাশীল আবেগের প্রকাশ দেখা যায়। আনন্দ আঢ্যের শিল্পনির্দেশনা আর ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের আবহ অতি উচ্চমানের হয়েছে।
‘মরবে মরো, ছড়িও না’- এটাই ছিল ‘হেমলক সোসাইটি’র ট্যাগলাইন। সৃজিত মুখোপাধ্যায় অবশ্য শেষ বিচারে ছড়াননি। |
|
|
|
|
|