ব্যাগ গুছিয়ে...
প্রকৃতির গ্যালারিতে
বোড্ডাভারা স্টেশন ছেড়ে খানিকটা যাওয়ার পর ‘কিরান্দুল প্যাসেঞ্জার’ ট্রেনটা আচমকাই যেন হারিয়ে গেল নিকষ কালো অন্ধকারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার আলোর ঝলমলানি। কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার সেঁধিয়ে যাওয়া গহন অন্ধকারের গহ্বরে। এ বার সম্বিত ফিরে পেয়ে কামরার সব যাত্রীই এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “টানেল, টানেল...ওই আসছে আর একটা।”
বিশাখাপত্তনম থেকে চলেছি বোরাগুহালু। রেলপথে দূরত্ব পুরোপুরি ১০০ কিলোমিটার। সেখান থেকে যাব প্রকৃতির দান ‘অত্যাশ্চর্য বোরাগুহা’ দেখতে।
যত এগোচ্ছি, পাহাড়ের বুকে রেলপথের চড়াই যেমন উপলব্ধি করা যাচ্ছে, তেমনই পরতে পরতে প্রকৃতি মেলে ধরছে তার সৌন্দর্যের ভাণ্ডার। প্রায় রেলপথের গা ঘেঁষেই কোথাও হাড়হিম করা গভীর খাদ, তো কোথাও পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট দৃষ্টিনন্দন সবুজ উপত্যকায় ধাপচাষের হালকা সবুজ খেত।
কোথাও ঘন জঙ্গল ভেদ করে এক চিলতে ঝর্নাধারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচে, তো কোথাও আবার দুই পাহাড়ের পাদদেশে বহু নীচে ভয়ঙ্কর গিরিখাত ধরে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী কোনও নদী। আর সেই নদীর বুকেই সুউচ্চ স্তম্ভ গড়ে তার উপরে রেলসেতু নির্মিত হয়েছে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য। কোথাও বা রেলপথের বাঁক এতটাই বেশি যে রেলের কামরায় বসে খোলা জানালা পথেই দিব্বি দেখা যায় ইঞ্জিন-সহ ট্রেনের সামান্য অংশ, আর সর্পিল পথে অনবরত তার ডাইনে বাঁয়ে বাঁক নিয়ে হঠাৎ করে সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ার দৃশ্য। নিদারুণ দৃষ্টিসুখের এ এক ব্যতিক্রমী রেলসফর।
বোরাগুহালু পর্যন্ত যেতে দীর্ঘতম সুড়ঙ্গটি পেলাম টাইডা এবং চিমিডিপল্লি স্টেশন দু’টির মধ্যে ২২ ও ২৩ নম্বর চিহ্নিত এই যমজ সুড়ঙ্গদ্বয়ের দৈর্ঘ্য ৭০১ মিটার।
ঘণ্টা তিনেক লাগল বোরাগুহালু পৌঁছতে। স্টেশনের পরিবেশটিও অত্যন্ত রমণীয়।
স্টেশনের বাইরে থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম এক কিলোমিটার দূরে বোরাগুহার উদ্দেশ্যে। গাড়ি নামিয়ে দিল গুহার টিকিট কাউন্টারের সামনে। প্রবেশ মূল্য মাথাপিছু ৪০ টাকা (শিশুদের ক্ষেত্রে ৩০)। ডিজিটাল ক্যামেরার জন্য টিকিট ১০০ টাকা।
গেট পেরিয়ে ঢুকতেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাঁ দিকে নিশ্ছিদ্র জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা গোষ্ঠানি নদী। অনেকগুলি সিঁড়ি নেমে পৌঁছলাম গুহার ঠিক মুখে।
১৮০৭-এ ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ উইলিয়াম কিং আবিষ্কৃত এই প্রাকৃতিক গুহাটি পনেরো কোটি বছরের প্রাচীন বলে মনে করা হয়। পূর্বঘাট পর্বতমালার অনন্তগিরি শ্রেণীতে অবস্থিত এই বোরাগুহার উপর দিয়েই গিয়েছে কিরান্দুলের রেলপথ।
বড় বড় গাছপালার ছায়াঘেরা গুহার মুখটি কিন্তু বিশাল। ভিতরে সারা গুহা জুড়ে অসামান্য সব শিল্পকর্মের অনুপম এক প্রদর্শনী, যার প্রতিটিই প্রকৃতির আপন হাতে সৃষ্ট। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এগুলি গড়ে উঠেছে একান্তই প্রকৃতির নিজস্ব খেয়ালে ও অদ্ভুত স্বতন্ত্রতায় এবং নিরন্তর ঘটেই চলেছে সেই প্রক্রিয়া।
গুহার এখানে ওখানে ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়া জলে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম বাইকার্বনেটের সঙ্গে মৃত্তিকাস্থিত বিবিধ খনিজের সমন্বয়ে গঠিত দু’টি জটিল যৌগ স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট সুদীর্ঘ কাল ধরে সঞ্চিত হতে হতে জন্ম দিয়েছে নানারূপ প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের যার কোনওটি দেখতে বাঘের মতো, তো কোনওটি যেন কুমির। কোনওটি ধ্যানমগ্ন ঋষি, তো কোনওটি অবিকল মা ও শিশু। আবার কোনওটা যেন মানব মস্তক। কোথাও কোথাও গুহার ছাদেও সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব সব ঝুলন্ত ভাস্কর্য। এ শুধু নির্বাক মুগ্ধতায় আত্মস্থ করা যায়, বর্ণনা করা কঠিন। এ ছাড়া ১৯৯২-এর ২১ নভেম্বর গুহার ভিতরে আলোককিরণের পর সারা গুহা জুড়েই এখন আলো-আঁধারির এক মোহময় পরিবেশ।
বোরাগুহার বিস্তৃতি ২০০ মিটার হলেও কিন্তু আঁকাবাঁকা হাঁটাপথে গুহার শেষ প্রান্তে পৌঁছতে প্রায় ৩৫০ মিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। শেষ প্রান্তেও রয়েছে আর একটি বিস্ময়। লোহার খাড়া সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছই অনেকটা উঁচুতে অবস্থিত আর একটি ছোট্ট গুহায়, যেখানে প্রদীপের আলোয় চলছে প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গের উপাসনা। এক জন স্থানীয় পুরোহিতও রয়েছেন সেখানে।
ওড়িয়া ভাষায় ‘বোরা’ শব্দের অর্থ গর্ত। কিন্তু গর্ত কোথায়, এ তো রীতিমতো সুসজ্জিত পাতালপুরী। প্রাকৃতিক এই বিস্ময়ের কন্দর থেকে বেরিয়েও তাই ঘোর কাটে না।

কী ভাবে যাবেন

হাওড়া থেকে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে কিংবা চেন্নাই মেলে বিশাখপত্তনম।
সেখান থেকে সকাল ৬-৫০ মিনিটের কিরান্দুল প্যাসেঞ্জারে বোরাগুহালু। অথবা
বিশাখাপত্তনম থেকে গাড়ি ভাড়া করে সড়ক পথে বোরাগুহালু তথা বোরাগুহা।
কোথায় থাকবেন
একমাত্র থাকার জায়গা রেলের রিটায়ারিং রুম। তাই বোরাগুহা দেখে সড়ক পথে আরাকু পৌঁছে
সেখানে রাত কাটানোই ভাল। অথবা আরাকু, টাইডা ঘুরে বিশাখাপত্তনমে ফিরে আসা।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.