অর্ধেক মহাকাশের অভিসারে
ব্রিটেন ১, ফ্রান্স ১, দক্ষিণ কোরিয়া ১; কানাডা ২, জাপান ২; সোভিয়েত ইউনিয়ন (এবং রাশিয়া) ৩; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪৫। সাত দেশের ৫৫ জন মেয়ে এ যাবৎ মহাকাশে পাড়ি দিয়েছেন। সকালের মুখ দেখে দিনের চেহারা অবশ্য মোটেও বোঝা যায়নি। উনিশ বছর যাবৎ ভালেন্তিনা তেরেশকোভা একমাত্র নভশ্চারিণী ছিলেন, দ্বিতীয় নারী হিসেবে মহাকাশে গিয়েছিলেন তাঁর দেশেরই স্বেতলানা সাভিত্স্কায়া, কিন্তু তার পর, ১৮ জুন ১৯৮৩ ফ্লরিডার জন এফ কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে ‘চ্যালেঞ্জার’ স্পেস শাটল-এ চার পুরুষের সহযাত্রিণী হলেন স্যালি রাইড, সেই থেকে মেয়েদের মহাকাশযাত্রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই প্রায় অর্ধশত, অন্যেরা ধারে কাছে নেই। ১৯৯১-এর বড়দিনের দিন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলীন হয়ে যাওয়ার আগেই ওয়াশিংটন মস্কোকে ১৪-২ নভশ্চারিণীতে হারিয়ে দিয়েছিল। এই ফ্রন্টটিতে ঠান্ডা লড়াইয়ের ফলাফল নিয়ে কোনও তর্ক নেই।
সংখ্যার আড়ালে থাকে বাস্তব। ভালেন্তিনা-স্বেতলানারা ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন রাষ্ট্র তথা পার্টির দাক্ষিণ্যে। মার্কিন দুনিয়ার স্পেসকন্যারা মেয়ে বলে নির্বাচিত হননি, হয়তো মেয়ে হওয়াটা তাঁদের কাউকে কাউকে কিছুটা সাহায্য করেছে, এক পশলা ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন’-এর কিছুটা পড়েছে তাঁদের মনোনয়নের সময়ে, কিন্তু তাঁরা কেউ রাষ্ট্রীয় কুমিরছানা নন।
এ ক্ষেত্রে কিন্তু দিনের শুরুতেই বোঝা গিয়েছিল, দিনটা কেমন যাবে। শুরু মানে স্যালি রাইড। তাঁর সঙ্গে পরিচয় করার সময় মাথার পিছনে তেরেশকোভার কাহিনিটি ফেলে রাখলেই চলবে। স্যালি আশৈশব মেধাবী ছাত্রী, দুর্দান্ত খেলেন, টেনিসকেই পেশা করবেন ভেবে কলেজ ছাড়লেন, কিন্তু তার পর বুঝলেন এই ময়দানে শিখরে পৌঁছনোর সাধ্য নেই তাঁর, ফিরে এলেন পড়াশোনায়। স্ট্যানফোর্ড। স্যালি রাইড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-এ পিএইচ ডি। স্বচ্ছন্দে অধ্যাপনায় যোগ দিতে পারতেন, কিন্তু চোখে পড়ল নাসা-র বিজ্ঞাপন, মহাকাশ অভিযানের জন্য প্রার্থী চাইছে ওরা। স্পেস তাঁকে আশৈশব হাতছানি দেয়। দরখাস্ত করলেন স্যালি। পঁয়ত্রিশ জনকে স্বাগত জানাল নাসা, তাঁদের মধ্যে ছ’জন মেয়ে, স্যালি তাঁদের এক জন। সেটা ১৯৭৮। পাঁচ বছর পরে প্রথম ‘লিফ্ট-অফ’, তখন তাঁর বয়েস ৩২। কেবল মহাকাশে প্রথম মার্কিন কন্যা নন, সে-যাবৎ স্বদেশের সর্বকনিষ্ঠ নভোযাত্রী। পরের বছর আরও এক বার মাধ্যাকর্ষণ কাটিয়েছিলেন স্যালি। এবং ১৯৮৬ সালে তৈরি হচ্ছিলেন তৃতীয় অভিযানের জন্য, চ্যালেঞ্জারের ঐতিহাসিক বিপর্যয় সেই উদ্যোগে ছেদ টানল। পরের বছর মহাকাশযাত্রা থেকে অবসর নিলেন স্যালি ফিরে গেলেন পড়াশোনার জগতে।
এবং নটে গাছটি মুড়োল না। নতুন শতাব্দীর প্রথম বছরে প্রতিষ্ঠিত হল ‘স্যালি রাইড সায়েন্স’। স্যালি তার কর্ণধার। এই সংস্থার লক্ষ্য: অল্পবয়সী পড়ুয়াদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলা। সে জন্য ওঁরা নানা রকম বই, মডেল ইত্যাদি তৈরি করেন, নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, উৎসাহ দেন ছাত্রছাত্রীদের। বিশেষ করে ছাত্রীদের। কেন মেয়েদের প্রতি এই বিশেষ মনোযোগ? স্যালির জবাব: ‘বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি নিয়ে আমাদের সমাজে কতকগুলো বাঁধাধরা ধারণা তৈরি হয়েছে, ক্রমশ সেগুলো কমছে বটে, কিন্তু অনেকটাই যায়নি। একটা এগারো বছরের মেয়েকে যদি এক জন বিজ্ঞানীর ছবি আঁকতে বলা হয়, সে নির্ঘাত এলোমেলো পোশাক পরা উদ্ভ্রান্ত চেহারার এক জন পুরুষের ছবি আঁকবে। ওই মেয়েটি নিজে তো ও-রকম হতে চায় না! সে যখন নেট-এ ঘোরাফেরা করে, বিজ্ঞানী বলতে ছেলেদেরই ছবি দেখে। এতে নিশ্চয়ই একটা কিশোরীর কাছে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির দুনিয়াটা খুব আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে না।’ স্যালি এই স্টিরিয়োটাইপটা ভাঙতে চান। স্টিরিয়োটাইপ ভাঙার ব্যাপারে তাঁর মতো যোগ্যতা ক’জনেরই বা আছে?
এবং তার প্রয়োজন যে আজও মোটেই ফুরোয়নি, এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও, সে কথাও তো স্পষ্ট অর্ধ শতাব্দীর ইতিহাসে মহাকাশযাত্রীর মোট সংখ্যা ৫২৫, মেয়েরা তার এগারো শতাংশেও পৌঁছয়নি, অর্ধেক আকাশ এখনও অনেক আলোকবর্ষ দূরে। সেটাও অবশ্য এক দিক থেকে স্বাভাবিকতারই প্রমাণ, জোর করে অর্ধেক আকাশ দখল করার প্রকল্প নিলে শতাংশের হিসেবটা বাড়ানো যেত।
মার্কিন দেশের দুই ‘ভারতীয়া’। কল্পনা চাওলা-র প্রথম যাত্রা ১৯৯৭।
দ্বিতীয় বার, ২০০৩। এবং ‘কলম্বিয়া’র মর্মান্তিক বিপর্যয়। সুনিতা উইলিয়ামস
(২০০৬) মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় (১৯৫ দিন) মহাকাশে কাটিয়েছেন।
পুনশ্চ: যদি সব কিছু ঠিকঠাক চলে, তবে মহাকাশ অভিযানের হিসেবটা অতঃপর সামান্য শুধরে নিতে হবে। কারণ আজ আজই গোবি মরুভূমির বুকে জিউকুয়ান উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে ‘লং মার্চ-টু এফ’ রকেটে ভর করে একটি মহাকাশযান দশ দিনের যাত্রায় পাড়ি দেবে। যাবেন তিন জন, তাঁদের এক জন মেয়ে। তাঁর নাম, সম্ভবত, মেজর লিউ ইয়াং। পিপলস লিবারেশন আর্মির অফিসার। তবে, তিন দিন আগেও, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, তিনিই যাচ্ছেন। আর একটি নামও শোনা গেছে: ক্যাপ্টেন ওয়াং ইয়াপিং। তিনিও পি এল এ’র। যিনিই যান, এই পরিকল্পনা সার্থক হলে নভশ্চারিণীর তালিকায় যুক্ত হবে নতুন দেশের নাম। এবং নামটি যেহেতু চিন, অতএব, কে বলতে পারে, আজই হয়তো মহাকাশে স্যালি রাইডের প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটতে চলেছে। সে দিক থেকে, আজকের দিনটি কেবল ঐতিহাসিক নয়, হয়তো বা
ইতিহাস-সম্ভবও। অর্ধ শতাব্দী আগে যে তারিখে প্রথম নারী সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মহাকাশে গিয়েছিলেন, সেই তারিখেই চিনের প্রথম নারী নভশ্চারিণী হচ্ছেন এই সমাপতনকে আমেরিকা অন্তত তুচ্ছ করবে না। ভালেন্তিনা তেরেশকোভা তাঁর দেশকে যে শিরোপা দিয়েছিলেন, স্যালি রাইড এবং তাঁর উত্তরপথিকরা তাকে প্রাচীন ইতিহাসে পরিণত করেছেন। ক্যাপ্টেন ইয়াপিং কিংবা মেজর ইয়াং হয়তো সেই ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবেন। হয়তো মেয়েরা দেখতে দেখতে অর্ধেক মহাকাশ দখল করে নেবেন, স্যালি রাইডের স্বপ্ন সার্থক হবে আমেরিকায় নয়, চিনে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.