দশ বছরে এক ছেলের বয়স হয়েছে ১৮, অন্য জনের ১৬।
দশ বছরে দুই ছেলে আরও লম্বা হয়েছে। কণ্ঠস্বর পাল্টেছে, চেহারাও।
তবু, গনগনে রোদের মধ্যে বাংলাদেশের বেনাপোলের দিক থেকে শুক্রবার দুপুরে আইনুদ্দিন ভাই কামালউদ্দিন গাজিকে নিয়ে যখন পেট্রাপোল সীমান্তের দিকে হেঁটে আসছিল, হারিয়ে যাওয়া ছেলেদের চিনতে ভুল হয়নি মা সাবিনা বিবির। পরদেশের গণ্ডি পেরিয়ে তারা স্বভূমিতে পা দেওয়ামাত্র ছেলেদের জড়িয়ে ধরলেন মা। তিন জনেরই চোখে জল। সাবিনা বললেন, “আল্লাকে ধন্যবাদ।” ছেলেরা বলল, “কখনও মাকে ছেড়ে যাব না।”
মা-দুই ছেলের এই মিলনের সাক্ষী থাকলেন পেট্রাপোলের বিএসএফ জওয়ানরা, শুল্ক ও অভিবাসন দফতরের আধিকারিকরা এবং বহু শ্রমিক, ট্রাক-চালক, সাধারণ মানুষ।
খেতমজুরের কাজ করে ছোট ছোট দুই ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন স্বামী-বিচ্ছিন্না সাবিনা। কিন্তু ২০০২ সালের ২০ অগস্ট তাঁর সেই স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। হারিয়ে যায় তাঁর দুই ছেলে। দীর্ঘ দিন ধরেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাশীপুরের নাটাপুকুর এলাকায় বাপেরবাড়িতে থাকেন সাবিনা। ওই দিন বিকেলে বাড়ি ফিরেই ছেলেদের হারিয়ে যাওয়ার কথা শোনেন তিনি। পরে জানতে পারেন, পরিচিত কারও সঙ্গে তাদের বাবার বাড়ি বসিরহাটে চলে গিয়েছিল দুই ছেলে। আর সেখান থেকেই হাঁটতে হাঁটতে সীমান্ত পেরিয়ে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশে। তাদের ঠিকানা হয় যশোহরের একটি সরকারি ‘হোম’। |
দুই ছেলেকে ফিরিয়ে আনা হতদরিদ্র, অক্ষরজ্ঞানহীন সাবিনার পক্ষে সহজ ছিল না। তবে, তিনি পাশে পান দুই দেশের দুই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। মায়ের আর্তিতে দুই ভাইকে ফিরিয়ে আনতে ‘তৎপর’ হয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ বাংলাদেশ হাই-কমিশনে তদ্বির করে। এ পারের আর্জিতে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকও নির্দেশ দেয় আইনুদ্দিন এবং কামালউদ্দিনকে ভারতে ফিরিয়ে দেওয়ার।
শুক্রবারই ছিল মায়ের কাছে ছেলেদের ফিরে আসার দিন। বেলা ১১টার মধ্যেই পেট্রাপোলে পৌঁছে যান সাবিনা। সঙ্গে ছিলেন দাদা মহম্মদ মইনুদ্দিন মোল্লা এবং তাঁদের প্রতিবেশী রহুল আমিন। বিএসএফ ক্যাম্পে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন, কিন্তু এক বারের জন্যও বসেননি সাবিনা। ঘন ঘন তাঁর চোখ বেয়ে জল নেমেছে। শাড়ির আঁচলে সেই জল মুছেছেন।
বেলা দেড়টা নাগাদ এল সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ। বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক সদস্য এসে সাবিনাকে বললেন, ওদের আনা হচ্ছে। হাসি ফুটল মায়ের মুখে। গুটি গুটি পায়ে এসে দাঁড়ালেন সীমান্তের নো-ম্যানস্ ল্যান্ডের গেটের মুখে। দেখলেন, হেঁটে আসছে ছেলেরা। ফের চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা। ফের আঁচলে চোখ মুছলেন। গেট পেরিয়ে ছেলেরা ঢোকা মাত্র জড়িয়ে ধরলেন মা। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ভরিয়ে দিলেন আদরে। তাঁর কথায়, “এক সময়ে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। অবশেষে ছেলেদের ফিরে পেলাম। আল্লাকে ধন্যবাদ। আমার আর কিছুই বলার নেই।” সাবিনার দাদা বলেন, “ছেলেদের কথা ভেবে সাবিনা এক সময়ে হতাশ হয়ে পড়েছিল। এ বার বোনটা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে। দুই দেশের সরকার এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দু’টির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।”
যশোহরের ‘হোমে’ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে দুই ভাই। অয়্যারিংয়ের কাজ শিখেছে আইনুদ্দিন। ছবি আঁকা শিখেছে কামালউদ্দিন। এত দিন পরে মাকে ফিরে পেয়ে আর আর কাছছাড়া করতে চাইছিল না। সীমান্তের গেটের পাশেই একফালি ছায়ায় মাকে নিয়ে বসে পড়ে দু’ভাই। আইনুদ্দিন বলে, “হাঁটতে হাঁটতে ভুল করে ও দেশে চলে গিয়েছিলাম। আর কখনও মাকে ছেড়ে যাব না। মায়ের জন্য কত কেঁদেছি। ভাই মায়ের ছবি আঁকত।” ফের দুই ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সাবিনা। |