|
|
|
|
অধিকারীদের সামনে এখন প্রত্যাশা-পূরণের ‘চ্যালেঞ্জ’ |
সুব্রত গুহ • কাঁথি |
হলদিয়ার পুরভোটে জিততে না পারা পূর্ব মেদিনীপুরে তাদের ‘খাসতালুকে’ প্রধান শাসকদল তৃণমূলকে নিশ্চিতই খানিক ধাক্কা দিয়েছে। জেলায় দলের সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বও এই প্রথম কোনও কোনও মহলের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ২০০৭-এর নন্দীগ্রাম-পর্বে উত্থানের শুরু তৃণমূলের। সেই নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের ‘খলনায়ক’ প্রতিপন্ন হওয়া লক্ষ্মণ শেঠের ‘দুর্গ’ হলদিয়ায়, তিনি জেলে থাকাকালীনও জিততে না পারা— জেলায় তৃণমূলের শক্তি-হ্রাসের লক্ষণ কি না, সে নিয়েও চর্চা
শুরু হয়েছে। জল্পনা চলছে জেলায় তৃণমূলের সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁদের হাতে, সেই ‘অধিকারী’দের ক্ষমতা খর্ব হবে কি হবে না, তা নিয়েও। জেলা-রাজনীতিতে তৃণমূল তথা অধিকারীদের শক্তিকেন্দ্র কাঁথি, বিশেষত কাঁথি পুরসভার হালচাল নিয়ে আলোচনা এই অবস্থায় কাঁথির গণ্ডি ছাড়াচ্ছে। ১৯৫৮-য় কাঁথি পুরসভার গোড়াপত্তন। গত ৫৪ বছরের মধ্যে প্রায় ৩২ বছরই পুর-ক্ষমতায় থেকেছেন অধিকারীরাই। শিশির অধিকারী পুরপ্রধান ছিলেন দু’দফায় মোট ২৮ বছর (১৯৭১ থেকে ’৮০ এবং ১৯৯০ থেকে ২০০৯)। ২০০৯ থেকে ’১০-এর মাঝামাঝি অবধি পুরপ্রধান ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। আর ২০১০ থেকে এখনও পর্যন্ত সৌমেন্দু অধিকারী। ২০০৫-এ কংগ্রেসকে সঙ্গী করে ১৮-০ ফলে বিরোধীশূন্য পুরবোর্ড গড়েছিল শিশিরবাবুর নেতৃত্বে তৃণমূল। ২০১০-এ কংগ্রেসের সঙ্গ ছেড়ে একক ভাবে লড়ে ২০-০ ফলে ফের বিরোধীশূন্য পুরবোর্ড গড়েছে তারা। হলদিয়া-পাঁশকুড়ার সাম্প্রতিক পুরভোটের প্রচারে শুভেন্দু অধিকারীর ‘বিরোধীশূন্য’ বোর্ড গড়ার ডাকের মূলে রয়েছে কাঁথিতে তাঁদের এই ‘সাফল্য’-জাত শ্লাঘাই।
কিন্তু অধিকারীদের এত বছরের শাসনেও পুর-পরিষেবা নিয়ে নাগরিকদের শ্লাঘা বা মাথা উঁচু করার সুযোগ তেমন তৈরি হয়নি বলেই অভিযোগ। ১৪.২৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কাঁথি পুর-এলাকার ২০টি ওয়ার্ডের (২০১০ সালেই ১৮ থেকে বেড়ে ২০টি ওয়ার্ড হয়েছে) মধ্যে বেশ কিছু ওয়ার্ডেই এখনও গ্রাম্য-পরিবেশ। ২০১০-এর পুরভোটের আগে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, বাড়ি-বাড়ি পানীয়জলের ব্যবস্থা, নিকাশির হাল ফেরানো-সহ পরিষেবা ক্ষেত্রে ভোলবদলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু গত দু’বছরে বলবার মতো কাজ তেমন হয়নি বলেই অভিযোগ বিরোধীদের এবং পুর-নাগরিকদের একাংশের।
পুর-শহরের বাসিন্দা কাঁথি কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক অমলেন্দুবিকাশ জানা, সমবায় ব্যাঙ্কের ম্যানেজার শান্তিময় জানা, কাঁথি বাজার-ব্যবসায়ী সমন্বয়-সমিতির সম্পাদক ও প্রাক্তন কাউন্সিলর জগদীশ দিন্দাদের বক্তব্য, “কাঁথির সাধারণ মানুষ শহরের যানজটে ব্যতিব্যস্ত। শহরের পথে চলাই দুষ্কর। কাঁথি শহরে কোনও সাস্কৃতিক মঞ্চ, পার্ক নেই। এটাও কাঁথির মতো শহরের পক্ষে বেমানান। বেআইনি রিকশার ছড়াছড়ি রাস্তা জুড়ে। অনেক জায়গায় জবরদখলও হয়ে রয়েছে রাস্তা।” বিরোধীদল সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য প্রশান্ত পাত্রের অভিযোগ, “শিশির, শুভেন্দু আর সৌমেন্দু অধিকারীদের তিন দশকের শাসনে কাঁথি পুরসভা উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করতে পারেনি। পানীয় জলের সমস্যা রয়ে গিয়েছে। অনেক ওয়ার্ডের রাস্তা পাকা করা হলেও তা অত্যন্ত সরু। ফলে যানবাহন চলাচলের খুব অসুবিধা। বস্তি-উন্নয়ন থেকে ইন্দিরা আবাস যোজনার বাড়ি নিয়েও চরম দলবাজি। পুরসভার অস্থায়ী কর্মীদের দীর্ঘ দিন স্থায়ী করা হয়নি। কর্মসংস্থানের সুযোগ-সৃষ্টিতেও বিশেষ কোনও উদ্যোগ নিতে পারেনি কাঁথির পুরবোর্ড।”
পুরপ্রধান সৌমেন্দু অধিকারীর অবশ্য দাবি, “গত দু’বছরে অনেক কাজই হয়েছে। বাড়ি-বাড়ি পানীয় জলের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, জল-সরবরাহের সেই কাজও চলতি মাসের ২৬ তারিখেই শুরু হবে। ২৬ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তিনটি জলাধার ও ৯টি পাম্প-হাউস তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্প-সূচনার পরে পুর-এলাকার পূর্বাংশের ৩, ৫, ৭, ৮ এবং পশ্চিমাংশের ১৭, ১৮, ১৯ ও ২০নং ওয়ার্ডের অনেকাংশে জল-সরবরাহ হবে।” প্রস্তাবিত ১০৫ কিলোমিটার পাইপলাইনের মধ্যে বর্তমানে অবশ্য মাত্র ৪৬ কিলোমিটার পাইপলাইনের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। নিকাশি-সমস্যার কথা অবশ্য মেনে নিয়েছেন পুরপ্রধান। তবে তিনি জানিয়েছেন, জেলা পরিষদের উদ্যোগে ৫০ লক্ষ টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে প্রথম-পর্যায়ে ২৫ লক্ষ টাকায় যমুনাজলা সংস্কারের কাজ চলছে। এ ছাড়াও পুরসভার পক্ষ থেকে বেশ কিছু ড্রেন তৈরি করা হয়েছে। পুরপ্রধানের আরও দাবি, “পুর-এলাকার ৬৫ শতাংশ রাস্তাই বিটুমিন বা ঢালাইয়ের হয়েছে। সব ওয়ার্ডে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। অনেক জায়গাতেই পথবাতির ব্যবস্থা হয়েছে। কাঁথি শহরের কেন্দ্রস্থলে ভূ-গর্ভস্থ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরির কাজও সম্পূর্ণ।” প্রায় এক লক্ষ জনসংখ্যার কাঁথি পুর-এলাকায় গত কয়েক বছরে যে হারে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে, তাতে অবশ্য পরিকাঠামো নিয়ে পুরসভাকেও নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছেই। যানজট সমস্যা, অপরিসর রাস্তার কথাও স্বীকার করতে হয়েছে পুরপ্রধানকে। এ জন্য অবশ্য ভৌগোলিক ও আয়তনগত সীমাবদ্ধতাকেই কারণ দর্শিয়েছেন তিনি। রাস্তার ধারের দখল-উচ্ছেদে অভিযান হয় দাবি করে পুরসভার হাতে খুব একটা জমি না-থাকায় পার্কিংপ্লেস করা যাচ্ছে না বলে যুক্তি দিয়েছেন তিনি। বিরোধীরা অবশ্য এ-সবই ‘অক্ষমের অজুহাত’ বলে দাবি করেছেন। রাজ্যে নিজেদের সরকার চললেও ২৫৮ জন অস্থায়ী-কর্মীর স্থায়ীকরণের দাবিটি সরকারের উপরে ছেড়েই দায় এড়িয়েছেন পুরপ্রধান। তাঁর আশ্বাস, “পুরবাসী গত তিন দশক ধরে আমাদের উপরে যে আস্থা রেখে চলেছেন, আমরা তার উপযুক্ত মর্যাদাই দিয়েছি এবং দেব।” বিরোধীদের অবশ্য অভিযোগ, পরিবারতন্ত্রে আটকেই বিকাশ-রোধ হয়েছে কাঁথির। পুরবাসীও আরও স্বাচ্ছন্দ্য চান। তৃণমূল তথা অধিকারীদের ‘চ্যালেঞ্জ’ এখন এই প্রত্যাশা-পূরণের। |
|
|
|
|
|