ব্যক্তিত্বের সংঘাত মিটবে কোন মন্ত্রে, প্রশ্ন সেটাই
কেন এমন হয়?
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে নীরদ সি চৌধুরী লিখেছিলেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। আর আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে জ্যোতি বসুর সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু দলের বাঙালি নেতারাও তখন তার বিরোধিতা করেছিলেন। জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি।
অনেক উথালপাথালের পর আজ ইউপিএ-র রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। নাম ঘোষণার সময়ে সনিয়া গাঁধী এবং মনমোহন সিংহের মাঝখানে দাঁড়ালেন তিনি। করুণানিধির প্রতিনিধি টি আর বালু তাঁকে পরিয়ে দিলেন সোনালি রঙের গরদের চাদর। শরদ পওয়ার থেকে অজিত সিংহ সকলে হাততালিতে মুখর। টিয়া-সবুজ সুতির শাড়িতে একগাল হেসে প্রণববাবুর সঙ্গে ছবি তুললেন সনিয়া। এক জনই তখন সেখানে নেই, তিনি বঙ্গললনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কেন এমন হল?
রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে প্রণববাবুর নাম ঘোষণার পরেই মুলায়ম থেকে মায়াবতী যে ভাবে তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এলেন, অপ্রত্যাশিত ভাবে তাতে রাজনৈতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গে বসে মমতা বুঝতেও পারেননি, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে কতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন প্রণববাবু।
কেন এমন হল?
মহাকরণে মমতা। শুক্রবার পিটিআইয়ের তোলা ছবি।
মমতা যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখনও এই দুই নেতার সম্পর্ক ছিল আপাত-মধুর। মমতা প্রায়ই ১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডে প্রণববাবুর বাসভবনে যেতেন। রেল বাজেট করার ব্যাপারে প্রণববাবুর পরামর্শ নিতেন। যখনই যেতেন, তখনই মমতা সঙ্গে নিয়ে যেতেন চকোলেট। এ রকম একটা দিনে প্রণববাবুর কাছে এই প্রতিবেদকের প্রশ্ন ছিল, “আপনার ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও অম্লান বদনে মমতার দেওয়া চকোলেট খেয়ে যাচ্ছেন?” পরিহাস ছলে প্রণববাবু বলেছিলেন, “কী করা যাবে? ও যে মমতা। ও কিছু বললে না শুনে উপায় আছে?”
রেল মন্ত্রককে যাতে পরিষেবা কর দিতে না হয়, তার জন্য প্রণববাবু অতিরিক্ত অর্থ সাহায্য করেছিলেন বাজেটে। বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে যতই বাদানুবাদ হোক, মমতা-প্রণব সম্পর্ক আজকের মতো এতটা কটু হয়নি। প্রণববাবু কালীঘাটে মমতার বাড়িতেও গিয়েছেন। কিন্তু গত ছ’মাসে সম্পর্কটা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকল। রাজধানীর পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, এটা যতটা না রাজনৈতিক বিরোধ, তার চেয়েও বেশি ব্যক্তিত্ব এবং আবেগের সংঘাত।
পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিন বছরের জন্য মোরাটোরিয়াম চেয়েছিলেন মমতা। মমতার অভিযোগ, সেই সুযোগ না দিয়ে অর্থমন্ত্রী রাজ্যকে বঞ্চিত করেছেন। তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় মমতা বলেছেন, যিনি রাজ্যকে আর্থিক সাহায্য করলেন না, তাঁকেই তৃণমূল সমর্থন করবে? তা হলে রাজ্যের মানুষের কাছে কী জবাব দেওয়া হবে? প্রণববাবু অবশ্য অমিত মিত্রকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, প্রকল্প-ভিত্তিক আর্থিক সাহায্য দেওয়া সম্ভব হতে পারে। কিন্তু কোনও একটি রাজ্যকে পৃথক ভাবে মোরাটোরিয়াম দেওয়া সম্ভব নয়। কেন্দ্র-রাজ্যের অধিকার সংক্রান্ত এই বিতর্কই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চিনের প্রাচীরের মতো মাঝখানে এসে দাঁড়াল।
তবে শুধুই কি আর্থিক প্রস্তাবগুচ্ছ আর মোরাটোরিয়াম নিয়ে বিরোধ? কংগ্রেস নেতাদের যুক্তি যদি সেটাই কারণ হয়, তা হলে তো মমতার খুশি মনে প্রণববাবুকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বলে মেনে নেওয়ারই কথা। কারণ, সে ক্ষেত্রে অন্য কেউ অর্থমন্ত্রী হবেন। এবং তাঁকে সামনে রেখে মমতা দাবি আদায়ের সুযোগ পাবেন।
কংগ্রেস এবং তৃণমূলের বহু নেতাই বলছেন, মূল কারণটা অন্য জায়গায়। প্রণব-মমতার মধ্যে গত ছ’মাস কার্যত কোনও বাক্যালাপই হয়নি। মমতার অভিমান, তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রণববাবুকে মহাকরণে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রণববাবু যাননি। চিদম্বরম মহাকরণে গিয়েছেন। অথচ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পরে প্রণববাবু মহাকরণে যাওয়ার উৎসাহ বোধ করেননি।
প্রণববাবু ও মমতা, দু’জনের ধাতটা আসলে আলাদা। প্রণববাবুকে এক বার এই প্রতিবেদক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বিজয়া দশমীর পর তিনি মহাকরণে গিয়ে মমতাকে আশীর্বাদ করবেন কি না। জবাবে প্রণববাবু কিঞ্চিৎ উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “এ সব নাটকে আমি বিশ্বাস করি না। এতে টিভির ইভেন্ট হতে পারে। কিন্তু আমি ঠিক ভিস্যুয়াল তৈরির জন্য রাজনীতি করতে শিখিনি।”
সন্দেহ নেই, মমতার থেকে অনেক বেশি দিন ধরে রাজনীতির ইনিংস খেলছেন প্রণববাবু। একই রাজ্যের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত রাজনীতিতে কোনও নতুন ঘটনাও নয়। প্রণববাবুর সঙ্গে অশোক সেনের একদা মতপার্থক্য হয়েছিল। ইন্দিরা-জমানায় প্রণববাবুর সঙ্গে বরকত গনি খান চৌধুরীর প্রবল সংঘাতের কাহিনিও সুবিদিত। প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে প্রণববাবুর সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। এখন মমতা পৃথক দলের নেত্রী, পশ্চিমবঙ্গের অঘটন-ঘটন-পটীয়সী। এখনও সেই সংঘাতের ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।
প্রণববাবুর সঙ্গে মমতার সংঘাত কি তবে চিরস্থায়ী ঘটনা হয়ে থেকে যাবে?
কংগ্রেসের ম্যানেজাররা কেউ কেউ মনে করছেন, এই জট খুলতে হলে হয়তো সনিয়া গাঁধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা আহমেদ পটেলের মতো কারও মধ্যস্থতা দরকার হবে। যিনি একদা সোমেন মিত্র এবং মমতাকেও এক টেবিলে বসাতে পেরেছিলেন। আহমেদ পটেল তখন পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। দিল্লিতে রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালের সামনে মমতার এই ফ্ল্যাটেই এসেছিলেন সোমেন। মমতার সঙ্গে বৈঠক করে ডিমের ওমলেট খেয়ে গিয়েছিলেন। আহমেদ পটেল কি এ বার প্রণব-মমতা বরফও গলাতে পারবেন?
তৃণমূল কংগ্রেসের বক্তব্য, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দর্শন হল, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। কালামকে পরিত্যাগ করে রণে ভঙ্গ দেওয়া মুলায়মের পক্ষে সম্ভব, মমতার পক্ষে নয়।
তা হলে? দিল্লিতে কংগ্রেসের এক ঠোঁট-কাটা নেতার তির্যক মন্তব্য, “এ বারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনটা তো কার্যত মুখোপাধ্যায় আর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইতেই পরিণত হয়েছিল। তবে প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলে নিশ্চয়ই আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চাইবেন না। তিনিই হয়তো তখন মমতাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবন ঘুরিয়ে দেখাবেন!”
হাজার হোক, প্রণববাবু তো আজই আবারও বললেন, ‘‘মমতা আমার বোনের মতো!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.