মহাকরণের কোনও সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে বছরখানেক আগে পর্যন্ত তৎক্ষণাৎ বিক্ষোভে ফেটে পড়ত দার্জিলিং পাহাড়। কয়েক ঘণ্টার নোটিসে শুরু হত লাগাতার বন্ধ। জ্বলত সরকারি গাড়ি, বাংলো। আক্রান্ত হতেন পুলিশ থেকে পর্যটক সকলে। কিন্তু এ বার শ্যামল সেন কমিটির রিপোর্ট জানার পরে ‘আশাহত’ হওয়ার কথা বললেও আচমকা জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো কোনও আন্দোলনের কথা এখনও পর্যন্ত মোর্চা নেতৃত্বের মুখে শোনা যায়নি। বরং মোর্চার শীর্ষ নেতারা সমস্ত পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সব দিক খতিয়ে দেখে এগোতে চাইছেন।
দার্জিলিং পাহাড়ের এমন পরিবর্তন কেন? মোর্চার বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, এর একাধিক কারণ রয়েছে।
প্রথমত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বারবার বিপদে আপদে পাহাড়ে ছুটে আসায় তাঁর উপরে
বিস্তারিত জানতে
ক্লিক করুন... |
|
সেখানকার মানুষের কিছুটা হলেও আস্থা তৈরি হয়েছে। যার জোরে এ দিন মহাকরণে দাঁড়িয়ে তিনি জানিয়েছেন, পাহাড়ের মানুষ আর আন্দোলন চান না। কারণ, দীর্ঘদিন বাদে স্বাভাবিক ও ভরপুর পর্যটন মরসুম দেখলেন তাঁরা। এর মধ্যে রাস্তাঘাট-সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও শুরু হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে মোর্চা নেতাদের অনেকেরই আশঙ্কা, সাত তাড়াতাড়ি রিপোর্টের বিরোধিতা করার অর্থ, একই সঙ্গে পাহাড়ের মানুষ ও রাজ্য সরকারকে বিরূপ করে তোলা। তা ছাড়া, ‘মোর্চার টানা আন্দোলনে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত’ পাহাড়বাসী যে অশান্তি চান না, সেটা আঁচ করেই গত ফেব্রুয়ারিতে মোর্চা নেতাদের অনশন কর্মসূচি, ডুয়ার্স অভিযান স্থগিত করতে হয়। মোর্চার অন্দরের খবর, তাই রোশন গিরির মতো মোর্চার শীর্ষ নেতারা ‘দেড়শোর বেশি মৌজা আশা করেছিলাম’ বলে হতাশা প্রকাশ করলেও, দুম করে জনজীবন স্তব্ধ করার ঝুঁকি নিতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত, কেন্দ্র-রাজ্য ও মোর্চার সহমতের ভিত্তিতে জুলাইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (জিটিএ) ভোট হওয়ার কথা। সে জন্য মোর্চার পক্ষ থেকে ৪৫টি আসনের প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও শুরু হয়েছে। কয়েকটি এলাকায় প্রচারও চলছে। পাহাড়ের মোর্চা-বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের জোট যাতে এতটুকু পালের হাওয়া কাড়তে না-পারে, সে জন্যও যে কোনও রকম অশান্তি এড়াতে অতিমাত্রায় সতর্ক মোর্চা নেতৃত্ব। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা জানান, রিপোর্ট নিয়ে কোনও আন্দোলনের ডাক দিলে ভোটের প্রস্তুতিতে বিঘ্ন ঘটতে পারে। আর তাতে বিরোধী দলগুলি জোটবদ্ধ হয়ে ভোটের ময়দানে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নিতে পারে বলে মনে করছেন ওই নেতারা। এমনকী, এই মুহূর্তে পাহাড়ে মুখ্যমন্ত্রীর যা জনপ্রিয়তা, তাতে তাঁর দল সেখানে সংগঠন বিস্তার করতে চাইলে পাহাড়ের রাজনীতি ভিন্ন মাত্রা নিতে পারে বলেও মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির একাংশের অনুমান। অর্থাৎ, জিটিএ ভোটে নিরঙ্কুশ জয় মসৃণ করতেই মেপে পা ফেলতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন বলে মোর্চা নেতাদের অনেকেই স্বীকার করেছেন।
অবশ্য মোর্চার অন্দরের খবর, দলে ‘কট্টরপন্থী’ বলে চিহ্নিত নেতারা ‘রিপোর্ট মানি না’ এবং ‘জিটিএ চুক্তি মানি না’ বলে তড়িঘড়ি ঘোষণা করে ফের আন্দোলনে নামার জন্য চাপ বাড়াচ্ছেন। তবে ‘বাস্তব পরিস্থিতি’ রাস্তায় নামার অনুকূল নয় বলে তাঁদের নিরস্ত করতে চেষ্টা করছেন মোর্চার প্রবীণ নেতাদের অনেকেই। প্রবীণ নেতাদের অনেকেরই বক্তব্য, ‘অনেক স্বপ্ন’ দেখিয়ে জিটিএ চুক্তি সই করে এখন তা মানি না বললে পাহাড়ের মানুষ ছেড়ে কথা বলবেন না।
ঘটনাচক্রে, ওই প্রবীণ নেতাদের অনেকেই এক সময়ে সুবাস ঘিসিংয়ের সঙ্গে নানা আন্দোলন করেছেন। পরে তাঁরাই ঘিসিংয়ের লাগাতার বন্ধ, আন্দোলনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন। পুরানো অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখেই ওই নেতারা অপেক্ষাকৃত ‘জঙ্গি’ নেতাদের বোঝাচ্ছেন, কমিটির রিপোর্ট যাই-ই হোক না কেন তাতে পাহাড়বাসীর স্বপ্ন চিরতরে বিফল হয়ে যায়নি। বরং, রিপোর্ট হাতে পেলে তা খতিয়ে দেখে মানুষের মতামত নিয়ে পদক্ষেপ করার উপরে জোর
দিচ্ছেন তাঁরা।
এ ব্যাপারে মোর্চার প্রচারসচিব হরকাবাহাদুর ছেত্রী বলেছেন, “আমাদের চেষ্টাতেই পাহাড়ে শান্তি ফিরেছে। উন্নয়নের কাজ হচ্ছে। মানুষ এখন খুশি। তাই রিপোর্ট আমাদের আশাহত করলেও আমি ব্যক্তিগত ভাবে আচমকা কোনও আন্দোলনের ঘোষণা করার পক্ষপাতী নই। সভাপতির উপস্থিতিতে সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনা হবে। রিপোর্ট আমাদের হাতে আসার পরে তা খতিয়ে দেখতে হবে।”
দার্জিলিঙের রাস্তাঘাটে এখন পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। জুন মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পাহাড়ের কোনও হোটেল, অতিথি নিবাসে ঘর ফাঁকা নেই। বহু দিন পরে ভাল ব্যবসা হওয়ায় খুশির জোয়ারে ভাসছেন পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত পাহাড়বাসীরা। পর্যটকদের আগলে রাখছেন তাঁরা। এমতাবস্থায়, আন্দোলনের সামান্য আশঙ্কাও যে পাহাড়ের পর্যটন ব্যবসাকে ফের লাটে তুলে দিতে পারে, সেটা তাঁরা ভালই জানেন।
আর সেটা হলে পাহাড়েই বিক্ষোভের মুখে পড়তে হতে পারে মোর্চা নেতাদের। পাশাপাশি, পর্যটকেরা যাতে বিপাকে না-পড়েন, সে জন্য মহাকরণও অতিমাত্রায় সতর্ক। এ দিন রিপোর্ট ঘোষণার পরেই পাহাড়ের পথঘাট পুলিশে ছেয়ে যাওয়া থেকেই সেটা স্পষ্ট।
ঘরেবাইরে প্রবল চাপ। এ হেন পরিস্থিতিতে আজ, রবিবার বিমল গুরুঙ্গের গ্রাম পাতলেবাসের দলীয় অফিসে বৈঠকে বসছে মোর্চা। সেই বৈঠকে রিপোর্ট নিয়ে প্রশাসনিক পর্যায়ে আপত্তি জানিয়ে জিটিএ ভোটের দিকে এগোনোর কথা বলা হবে বলেই আশাবাদী মোর্চার অধিকাংশ নেতা। |