নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
রাজ্যে এখনও সিপিএম ‘গ্রহণযোগ্য’ নয়। এখনও রাজ্যের ভোটারদের ঝোঁক মূলত বাম-বিরোধিতার দিকেই।
মঙ্গলবার ছ’টি পুরসভার ভোটের ফলাফল তা-ই বলছে।
ছ’টির চারটিতেই জিতেছে তৃণমূল। দখল করেছে ধূপগুড়ি। যেখানে গত বিধানসভা ভোটেও এগিয়েছিল সিপিএম। তৃণমূল হেরেছে হলদিয়া ও কুপার্স ক্যাম্পে। যে দু’টির ক্ষমতায় ছিল যথাক্রমে সিপিএম এবং কংগ্রেস। আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রধান শাসক দল ক্ষমতায় ছিল মাত্রই একটিতে। তা-ও কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ ভাবে (পাঁশকুড়া)। অন্য একটিতে জয়ী কংগ্রেসিরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন (নলহাটি)।
তৃণমূলের হেরে-যাওয়া হলদিয়ায় ভোট পড়েছে মূলত ‘ব্যক্তি অপশাসনে’র বিরুদ্ধে। প্রশাসন ও শাসক দলের সকলে জানেন, হলদিয়া ‘দিদির শাসনে’রও আওতার বাইরে। তৃণমূল হেরেছে কুপার্স ক্যাম্পে। যা কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। সেখানে বাম-বিরোধী ভোট গিয়েছে কংগ্রেসের ঝুলিতেই।
ভোট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশদে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে বলেছেন, “আমরা একা লড়েছি! তাতেই আমাদের অগ্রগতি হয়েছে। মা-মাটি-মানুষকে ধন্যবাদ।”
কুপার্স ক্যাম্প জয় নিয়ে কংগ্রেস শিবির ‘আন্দোলিত’ (রাজ্যের নেতাদের মতে, এর ফলে পঞ্চায়েতে জোট-আলোচনার সময় তাঁদের ‘গলার জোর’ কিঞ্চিৎ বাড়বে)। কিন্তু এই পুরভোট দেখিয়েছে, সামগ্রিক ভাবে কংগ্রেসের ‘প্রাসঙ্গিকতা’ কমছে। একলা লড়ে রাজ্যে কংগ্রেস পেয়েছে মোট ১৫টি আসন। শুধু কুপার্সেই ১১টি! অন্য পাঁচটি পুরসভায় বাকি চারটি! তবে হলদিয়ার কয়েকটি ওয়ার্ডে তাঁরা ‘ফ্যাক্টর’ হয়েছেন বলে কংগ্রেস নেতাদের দাবি।
বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের জয়জয়কারের এক বছরের মাথায় এই পুরভোটের ফলাফল আরও বলছে, রাজনীতির ওঠাপড়ায় তৃণমূল এখনও ‘উঠতি’। সিপিএম ‘পড়তি’। অর্থাৎ, কালীঘাটে এখনও ভরসা করছেন ভোটাররা। তাঁরা এখনও ‘আলিমুদ্দিন-বিমুখ’। যা থেকে এই উপসংহারে আসা যায়, বিধানসভায় ভোটদানের ‘ধারা’ মোটামুটি এখনও বজায় রয়েছে। বস্তুত, এক বছর পর পঞ্চায়েত ভোটেও এই ধারা বজায় থাকলে সিপিএমের ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র প্রক্রিয়া আরও পিছিয়ে যাবে।
রাজ্য-রাজনীতিতে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে নলহাটি, দুর্গাপুর এবং ধূপগুড়ি পুরসভায় মোট তিনটি আসন পেয়েছে বিজেপি। শাসক ও বিরোধী শিবিরের একাংশ একমত সিপিএম-বিরোধী মনোভাব যেমন এখনও বজায় রয়েছে, তেমনই কিছু এলাকায় শাসক দল সম্পর্কেও ‘মোহভঙ্গ’ হয়েছে। সেই ভোট পেয়েছে বিজেপি। দলের রাজ্য নেতৃত্ব আশাবাদী, এই ‘ধারা’ অব্যাহত থাকবে এবং তাঁরা তার ফল পাবেন আগামী নির্বাচনে।
হলদিয়ার ফলাফল যেমন তৃণমূলের কাছে ‘অপ্রত্যাশিত’, তেমনই বামেদের কাছে ‘অপ্রত্যাশিত’ ধূপগুড়ি। হলদিয়ার ফলাফলকে রাজ্য-রাজনীতির সাম্প্রতিক ধারার ‘ব্যতিক্রম’ বলেই ধরতে হবে। তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের একাংশ মনে করছেন, হলদিয়ার পুরভোটে পরাজয়ের মূল কারণ ব্যক্তিবিশেষের ‘ঔদ্ধত্য’। নাম না-করলেও তাঁদের লক্ষ্য তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। দল অবশ্য প্রকাশ্যে শুভেন্দুর ‘পাশে’ই আছে। হলদিয়ার ‘বিপর্যয়ে’ অসন্তুষ্ট হলেও পাশাপাশি ‘আলোর রেখা’ দেখছে তৃণমূল শিবির প্রথমত, সময় থাকতে ‘বিপদসঙ্কেত’ দেখতে পাওয়া গিয়েছে। দলের এক প্রথম সারির মমতা-ঘনিষ্ঠ নেতার কথায়, “দলের নেতাদের একাংশের ঔদ্ধত্যের মাসুল দিতে হল আমাদের।” যে পূর্ব মেদিনীপুর থেকে তৃণমূলের রাজনৈতিক উত্থান শুরু হয়েছিল, সেই জেলারই হলদিয়ায় এই হার নিঃসন্দেহে শাসক দলের কাছে অশনি-সঙ্কেত। দ্বিতীয়ত, বোর্ড দখল করতে না-পারলেও হলদিয়ায় আসন বেড়েছে তৃণমূলের। তৃতীয়ত, কংগ্রেস কোনও আসন পায়নি।
হলদিয়ার ফলকে সামনে রেখে সিপিএম অবশ্য ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র সূচনার দাবি করতে পারে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “হলদিয়া শাসক দল বা সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। এতে কাজ না-হলে ভবিষ্যতে লাল কার্ড দেখাবেন মানুষ।”
|
৬ পুরসভার ফলাফল |
|
|
|
|
|
|
পুরসভা |
আসন |
তৃণমূল |
কংগ্রেস |
বামফ্রন্ট |
বিজেপি |
নির্দল |
হলদিয়া |
২৬ |
১১ (+৪) |
০ |
১৫ (-৪) |
০ |
০ |
পাঁশকুড়া |
১৭ |
১২ (+৫) |
০ (-৩) |
৫ (-২) |
০ |
০ |
দুর্গাপুর |
৪৩ |
২৯ (+২৬) |
১ (-২) |
১১ (-২৬) |
১ (+১) |
১ (+১) |
নলহাটি* |
১৫ |
৮ (+৮) |
৩ (-৮) |
৩ (-২) |
১ (+১) |
০ |
কুপার্স |
১২ |
১ (+১) |
১১ (০) |
০ (-১) |
০ |
০ |
ধূপগুড়ি |
১৬ |
১১ (+৮) |
০ (-১) |
৪ (-৭) |
১ (০) |
০ |
*গত বার ছিল ১৬টি আসন। এ বার ১৫টি। বন্ধনীতে ২০০৭-এ প্রাপ্ত আসনের সঙ্গে তুলনা |
|
হলদিয়া দখলে রাখতে পারলেও দুর্গাপুর পুরসভার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে বামেরা। উচ্ছ্বসিত তৃণমূলের বক্তব্য, দুর্গাপুর জয় অত্যন্ত ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। একা লড়ে পাঁশকুড়া থেকে তৃণমূল মুছে দিয়েছে কংগ্রেসকে। নলহাটি এবং ধূপগুড়িও জয় করেছে তৃণমূল। বস্তুত, ধূপগুড়ির জয়কেই তৃণমূলের ‘আসল জয়’ বলে অভিহিত করেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু। তাঁর কথায়, “বামেদের ওখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে।”
মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরের মতো জেলা ছাড়া দক্ষিণবঙ্গে কুপার্সের মতো ‘পকেটে’ই কংগ্রেস সীমাবদ্ধ। যেখানে দলের চেয়েও ব্যক্তির একটা ভূমিকা রয়েছে। যেমন কুপার্সে রয়েছে শঙ্কর সিংহের। কুপার্স নিয়ে অবশ্য তৃণমূলের পাল্টা তত্ত্ব রয়েছে। দলের এক ভোট-বিশারদ নেতার বক্তব্য, “কুপার্সে ভোটারের সংখ্যা ১২ হাজার। ২০০৭ সালে ওখানে কংগ্রেস প্রথম, সিপিএম দ্বিতীয় এবং তৃণমূল তৃতীয় ছিল। এ বার কিন্তু ওখানে সিপিএম নেই। কংগ্রেস প্রথম, তৃণমূল দ্বিতীয়। ফলে এটা স্পষ্ট যে, কংগ্রেসকে সিপিএম জমিটা ছেড়ে দিয়েছে আমাদের হারানোর জন্য।”
নলহাটি পুরসভায় হারের ‘আশঙ্কা’ ছিল তৃণমূলের। কিন্তু তারা জিতেছে। কংগ্রেস সেখানে মাত্র তিনটি আসন পেয়েছে! ‘মর্যাদার লড়াই’য়ে হেরেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র, নলহাটির কংগ্রেস বিধায়ক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। হারের ‘দায়িত্ব’ নিলেও অভিজিৎবাবু ‘দায়’ চাপিয়েছেন কংগ্রেসের ‘অন্তর্কলহের’ উপর। হারের ময়নাতদন্ত চলবে বাম ও কংগ্রেস শিবিরে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে সম্ভবত খানিকটা ‘নিশ্চিন্ত’ই থাকবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |