পারথের ঠান্ডায় বসে আছি। ২৩ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও এখানে ঠান্ডা। এক্ষুনি জানলাম কলকাতায় তাপপ্রবাহ চলছে। কখনও কেউ শোনেনি, সে রকম মারাত্মক গরম পড়েছে ওখানে। প্রত্যেকটি শহরবাসীকে আমার সমবেদনা জানাচ্ছি। তীব্র গরমে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের প্রতি আমার শোকজ্ঞাপন করছি। যদিও প্রিয়জনকে চিরতরে হারানোর যন্ত্রণা কোনও সান্ত্বনাতেই যাওয়ার নয়।
তবে কলকাতা থেকে এত দূরে বসে আমার এও মনে হচ্ছে, বহু আকাঙ্খিত বৃষ্টি ছাড়া ইউরো কাপ এই দাবদাহে কলকাতাবাসীর কাছে পরম স্বস্তির বাতাবরণ আনতে পারে। আর ইউরোটাও এ বার খুব জমাটি টুর্নামেন্ট হয়ে উঠতে পারে।
কেন?
এক নম্বর কারণ হল, পোল্যান্ড আর ইউক্রেনের যৌথ উদ্যোগে ইউরো কাপ হচ্ছে। ইউরোপের এই দু’টো ছোট দেশ অনেক দিন ধরেই ফুটবলের বৃহৎ গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই টুর্নামেন্টটা ওদের সেখানে পৌঁছনোর সোনার সুযোগ এনে দেবে।
দ্বিতীয়ত, আর্থ-সামাজিক ফ্যাক্টর। ইউরো ২০১২-র সংগঠক দেশ হিসেবে এই দুই দেশ ঘরের দর্শকদের তুমুল সমর্থন পাবে তো বটেই। এমনকী পূর্ব ইউরোপের চেহারাও পাল্টে যেতে পারে।
শুধু ফুটবলের কথায় ফিরে বলা যায়, ইংল্যান্ডের কাছে টুর্নামেন্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। অনেক বছর ধরেই ইংল্যান্ড সমস্ত বড় টুর্নামেন্টে নেমেছে নিজেদের ফেভারিট ভেবে। কিন্তু এ বার ফার্দিনান্দ আর ল্যাম্পার্ড চোট পেয়ে টুর্নামেন্টের বাইরে চলে যাওয়ায় ইংল্যান্ড নিজেদের সম্পর্কে বাস্তবোচিত ধারণা নিয়ে নামবে। আর বড় টুর্নামেন্টে সেটাই হল ওদের পক্ষে সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক ব্যাপার। |
এ ছাড়া জার্মানি আর স্পেন হল প্রত্যেকের দুই ফেভারিট টিম। আমারও। কিন্তু আমি ওখানেই থেমে যেতে চাই না। আমার ইস্টবেঙ্গল দলের প্লেয়ারদের আমি সবসময় বলি, যে কোনও বড় টুর্নামেন্টে ইতালির ওপর খুব ভাল ভাবে নজর রেখো। যে কোনও কারণেই হোক না কেন, বড় টুর্নামেন্ট সবসময় ওদের থেকে সেরাটা বের করে আনে।
সত্যি বলতে কী আমার ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের বলছি, ইউরোর বিভিন্ন ম্যাচে বল ছাড়া যে সব মুভমেন্টগুলো হবে সেগুলোর দিকে তীক্ষ্ন নজর রাখতে। ওদের কাছে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
ফুটবলে এখন ফর্মেশন হল প্রচণ্ড নমনীয় একটা ব্যাপার। ৪-৪-২ ছকে একটা দল ম্যাচ শুরু করে পাঁচ মিনিট পরেই ৪-৪-১-১ ফর্মে চলে যেতে পারে। কিংবা ফর্মেশনটা পালটে যেতে পারে ৪-৫-১-এ। সে জন্য ফর্মেশন ছাড়া ওদের যেটা দেখার দরকার কত তাড়াতাড়ি এক-একটা দল ম্যাচে উঠছে আর যখন নিজেদের দখলে বল থাকছে না, তখন কত দ্রুত ডিফেন্সে নেমে আসছে। যদি ওরা এগুলো ভাল করে লক্ষ্য করতে পারে, তা হলে ইস্টবেঙ্গল টিমটার উপকারই হবে।
কী ভাবে আক্রমণ তৈরি হতে পারে? কী ভাবে কাউন্টার অ্যাটাকের মাধ্যমে বিপক্ষের আক্রমণ আটকানো যায়, এগুলোও ওরা শিখতে পারে। সত্যি বলতে কী, গত পাঁচ বছরে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন ঘটেছে প্রতিআক্রমণের ধরনধারণে।
আমার টিমের প্লেয়ারদের ব্যক্তিগত ভাবে কিছু বলতে হলে, আমি আন্তরিক ভাবে আশা করব মেহতাব নেদারল্যান্ডসের নাইজেল দে জং-এর দিকে ঈগলের মতো তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থাকবে। ইস্টবেঙ্গলে মেহতাবের মতোই হোল্ডিং মিডফিল্ডার পজিশনে নাইজেল খেলে আর মাঝমাঠের একজন অসাধারণ ফুটবলার।
একই ভাবে আমি চাইব টিভিতে যখন ইংল্যান্ডের ম্যাচ দেখাবে, তখন বলজিৎ সাইনি যেন মন দিয়ে দেখে। ওর আবার ড্যানি ওয়েলব্যাকের খেলাটা খুব ভাল ভাবে নজর করা উচিত। শক্তিশালী দু’টো পা, স্পিড, মুভমেন্টের পাশপাশি হেডেও খুব ভাল। ড্যানির খেলা দেখে বলজিৎ নিজের খেলার উন্নতি করতে পারে। একই নিঃশ্বাসে আমি চাইব জ্লাটান ইব্রাহিমোভিচের দিকে রবিন সিংহ খুব ভাল করে নজর রাখুক।
এ ছাড়া এ বারের ইউরো কিছু রঙিন চরিত্রের সন্ধান পেতে চায়। বেশ কিছু দিন ধরে আম্তর্জাতিক ফুটবল যে চরিত্রের অভাবে ভুগছে। এ রকম দুর্ধর্ষ চরিত্রগুলো কোচেদের কাছে হয়তো দুঃস্বপ্পের হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ফুটবল খেলাটাকে ধনী করে তোলে। ছিয়ানব্বই ইউরোয় পল গাসকোয়েনের গোলের পরে উচ্ছ্বাস প্রকাশের কথা আমার এখনও মনে আছে। এরা হল সব রংচঙে চরিত্র। যারা টুর্নামেন্টে রং এনে দেয়। এ ধরনের প্লেয়ার ইউরোতে দরকার। এই মুহূর্তে স্পেন ছাড়া আর কোনও দলে এ ধরনের চরিত্র নেই। আর সেটা দুঃখের। তবে আমি দুঃখ নিয়ে লেখা শেষ করতে চাই না। বরং এ বারের ইউরোয় আমার পছন্দের সেরা চারটে দলের নাম বলছি জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস। পঞ্চম টিমটার নাম আশা করি পাঠকরা বুঝতেই পারছেন, আমার দেশ ইংল্যান্ড।
চিয়ার্স। ইউরো উপভোগ করুন। আপনার ড্রইংরুমের বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টির আশা সমেত! |