মাঝেমধ্যেই অর্থনৈতিক সংস্কারের কথা বলা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বিশেষ পছন্দের ব্যসন ছিল। দেখা যাইতেছে, অভ্যাসটি সমগ্র কংগ্রেস দলের মধ্যে সংক্রামিত হইয়াছে। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে দল সরকারকে ডাকিয়া বলিয়াছে, এই বার আর্থিক নীতির দিকে নজর দেওয়া হউক। দলের মুখপাত্র বলিলেন, সংস্কার লইয়া দোলাচল লোকে পছন্দ করে না, কাজেই এই বার দৃঢ় ভাবে সংস্কারের পথে হাঁটিতে হইবে। প্রধানমন্ত্রী বা কংগ্রেসের কোনও শীর্ষ নেতা এই কথাগুলি বলিলে পূর্বে মানুষ কিঞ্চিৎ আশাবাদী হইত। ভাবিত, সত্যই বোধ হয় সরকারের ঘুম ভাঙিল। এখন আর সেই বিভ্রমের অবকাশ নাই। মানুষ বুঝইয়াছে, ইহা ঘুমের মধ্যে হাঁটিয়া বেড়াইবার ব্যাধিমাত্র। খানিক পরে ফের ঘুমাইয়া পড়া ভিন্ন পরিণতি নাই। সরকার যে জাগিবে না, তাহার লক্ষণ স্পষ্ট অর্থমন্ত্রী এখনও বিপদের গুরুত্ব স্বীকার করিতেই নারাজ। তিনি বলিতেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমিলে এবং দেশে ভাল বর্ষা হইলেই ভারতীয় অর্থনীতি ঘুরিয়া দাঁড়াইবে। চিন্তার কিছু নাই। বিপদের মুখে অর্থমন্ত্রী মাথা ঠাণ্ডা রাখিলে বাজারে একটি ইতিবাচক বার্তা পৌঁছয়, তাহা সত্য। কিন্তু, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য যদি বাস্তবের সহিত সঙ্গতিহীন হয়, তবে বার্তাটি বদলাইয়া যায়। বোধ হইতে থাকে, সরকার বুঝি নিজের দায়িত্ব বিষয়ে সচেতন নহে। অর্থমন্ত্রী বর্তমানে সেই বিপজ্জনক পথে হাঁটিতে আরম্ভ করিয়াছেন। ভারতীয় অর্থনীতির গতিভঙ্গের সম্পূর্ণ দায় ইউরোপের অর্থনৈতিক অস্থিরতার ঘাড়ে চাপাইয়া দিলে তাহা বালিতে মুখ গুঁজিয়া থাকা হয় মাত্র। বাহিরের সমস্যা তাঁহার হাতে নাই। কিন্তু, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি যে গভীর অসুখে আক্রান্ত, তাহা স্বীকার না করিলে চিকিৎসার ব্যবস্থা হইবে কী উপায়ে? দায় এড়াইবার খেলায় অর্থমন্ত্রী যে বাজি রাখিয়াছেন, তাহা মারাত্মক ভারতীয় অর্থনীতির প্রতি বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস এক বার ভাঙিলে ভারত কোন অতলে তলাইয়া যাইবে, অর্থমন্ত্রী ভাবিয়াছেন কি?
ভারতের সমস্যা বহুবিধ। বস্তুত, আজ গ্রিস যে রোগে মরণাপন্ন, ভারতও তাহাতেই আক্রান্ত আয়ের সহিত সঙ্গতিহীন ব্যয়ের কু-অভ্যাস। সেই রোগের চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু, তাহা এক দিনে হইবার নহে। প্রথম যে রোগটির চিকিৎসা প্রয়োজন, তাহা কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা। ইউ পি এ সরকার নীতিনির্ধারণ-পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। কখনও শরিকি চাপে, কখনও অরাজনৈতিক মোড়কে রাজনৈতিক তাণ্ডবে হাত গুটাইয়া থাকাই এই সরকারের একমাত্র কাজ হইয়াছে। ফলে, দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার গত তিন বৎসরে যে কয়টি সিদ্ধান্ত করিয়াছে, সেগুলির অভিমুখ দ্ব্যর্থহীন ভাবে জনমোহিনী। এই অভ্যাস ত্যাগ না করিলে নিস্তার নাই। সরকারকে কঠোর আর্থিক সিদ্ধান্ত করিতেই হইবে। অর্থমন্ত্রী কয়েক সপ্তাহ পূর্বে আর্থিক কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলিয়া ফের নিজেই রসিকতা করিয়া তাহাকে লঘু করিয়া দিয়াছিলেন। পরিস্থিতিটি রসিকতা করিবার মতো নহে। যে দেশের রাজকোষে অসীম শূন্যতা বিরাজ করে, সেই দেশের শাসকদের ভর্তুকি দেওয়ার বাসনা হওয়াও পাপ। প্রতিটি ভর্তুকির বিশদ পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। একান্ত অনিবার্য না হইলে ভর্তুকি রদ করাই বিধেয়। তাহার জন্য সরকারকে গা ঝাড়া দিয়া উঠিতে হইবে। তাহাতে অবশ্য বিপদ। কারণ, বর্তমান সরকারের স্থবিরতা অপেক্ষাও যাহা বিপজ্জনক, তাহা হইল সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত করিবার প্রবণতা। সরকার সম্প্রতি পেট্রোলের দাম বাড়াইল, ডিজেল-কেরোসিন-এলপিজির দাম অপরিবর্তিত থাকিল। বাস্তব বলিতেছে, এই পণ্যগুলির দাম না বাড়াইলেই নহে। অনুমান করা চলে, এক বারের পরিবর্তে দুই বার রাজনৈতিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়াকেই সরকার শ্রেয় জ্ঞান করিতেছে। যেখানে ব্যক্তিগত ব্যবহারের ডিজেল গাড়ি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করিয়া দেওয়ার কথা ভাবা দরকার, সেখানে সরকার ডিজেল গাড়ির উপর চড়া কর বসাইতেও নারাজ। যে দেশের রাজার বুদ্ধিনাশ হয়, পণ্ডিত সেই দেশ পরিত্যাগ করে। বিনিয়োগকারীরা পণ্ডিতদের অনুগামী হইলে নেতারা ঠেকাইতে পারিবেন কি? |