বাইশ বছর পরেও বাইশ গজটাই তাঁর প্রাণ। অভিধানেও একটাই শব্দ। ক্রিকেট!
তাই স্থান, কাল এক হলেও রাজ্যসভার আর পাঁচটা শপথগ্রহণের থেকে কোথাও অনেকটা আলাদা হয়ে রইল সোমবারের অনুষ্ঠান। পাত্র যে এখানে ক্রিকেটের শাহেনশা। ‘ফেরারি কা সওয়ারি’ না হয়ে যতই সরকারি সাদা অ্যাম্বাসাডরে সংসদ ভবনে শপথ নিতে আসুন, ভিতরে-বাইরে তিনি সেই পরিচিত সচিন তেন্ডুলকর। যিনি সব তকমার উপরে ক্রিকেটের জার্সিটাই গায়ে চড়িয়ে রাখবেন। ৩৯ বছর বয়সে হাজারো রেকর্ডের পাহাড়ে পৌঁছেও যিনি এগোতে থাকবেন অভিষেক ম্যাচের উৎসাহ নিয়ে! হয়তো সেই কারণেই শপথ নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে এসে সাংসদসুলভ কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার বদলে অবলীলায় বলে দেবেন, “আমি ক্রিকেটার। সেটাই আমার পরিচয়। আর এখানে এসেছি ক্রিকেট খেলেই। আমার জীবনে ক্রিকেটই সবার আগে। তাই ভাববেন না, সাংসদ হলাম বলে খেলাটার সঙ্গে কোনও রকম আপস করব!” |
এমনিতে রাজধানীর গরম এতটাই মারমুখী ব্যাটিং করছে, সোমবার সকালে কাজে বেরোনো মুখগুলো দেখে শুক্রবারের সকাল বলে ভুল হওয়া আশ্চর্যের নয়। সপ্তাহের প্রথম দিনের সতেজ ভাবটাই উধাও। কিন্তু সংসদ ভবনের সামনে এ দিন গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়েছে উৎসাহ আর উত্তেজনার পারদও। সচিন কখন আসবেন, মোটামুটি জানাই ছিল। আর আসতেই যে সংসদের অফিসার-কর্মীরা তাঁকে ক্যামেরা-বন্দি করতে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়বেন, সেটাও প্রত্যাশিত। চেক শার্ট আর সানগ্লাস পরে স্ত্রী অঞ্জলির সঙ্গে যখন গাড়ি থেকে নামছেন, তখন খেলার মাঠের জনতার সঙ্গে সংসদের মুখগুলোর কোনও পার্থক্য নেই। কেউ একের পর এক ছবি তুললেন, কেউ রেকর্ড করে রাখলেন সচিনের কণ্ঠস্বর। তার মধ্যেই সচিনকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব শুক্ল।
সংসদের অলিন্দও তখন সচিনময়। উপ-রাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হামিদ আনসারির উপস্থিতিতে তাঁর ঘরে যখন ক্রিকেটের ঈশ্বর সাংসদ হিসেবে শপথ নিচ্ছেন, তখন অঞ্জলি ছাড়াও ছিলেন রাজীব শুক্ল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরিশ রাওয়াত ও ভি নারায়ণস্বামী। আপাত সরকারি আনুষ্ঠানিকতা। অলিন্দে তখনও ভিড় করে দাঁড়িয়ে আমলারা। সচিনের অভিষেকের সাক্ষী হওয়ার মুহূর্ত ছাড়তে কেউই রাজি নন। শপথগ্রহণের পরেই উৎসাহীদের প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন হামিদ আনসারি। শপথগ্রহণে অন্য রকম কিছু লাগল? সাফ উত্তর, “সব শপথই এক রকম, এখানে সব সদস্য সমান।”
সত্যিই তাই কি?
প্রশ্ন এসেছিল, ক্রিকেটার হিসেবে সংসদে কতটা সময় দিতে পারবেন। সচিন সাফ বললেন, “এমন কোনও গুজব শুনতে চাই না যে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিচ্ছি। যে দিন ছাড়ব... কবে ছাড়ব যদিও এখনও জানি না, সবাইকে বলে দেব। তার পরে ভাবব অন্য কী কাজ করতে পারি।”
কিন্তু তাতে কি সাংসদ হিসেবে সুবিচার করতে পারবেন? এ বার বল সোজা মাঠের বাইরে
ফেলে দিলেন ‘মাস্টার-ব্লাস্টার’! “আমি
মনোনীত সদস্য। কাউকে নিজের থেকে গিয়ে বলিনি সাংসদ হতে চাই। এই পদে মনোনীত হয়ে আমি অত্যন্ত সম্মানিত। কিন্তু এখানে এসেছি আমার ক্রিকেট কেরিয়ারের জন্যই। ওটা থেকে মনঃসংযোগ সরাচ্ছি না।”
স্বপ্ন দেখতেন ক্রিকেট ছাড়ার পরেও ক্রিকেটের উন্নতিতে কাজ করবেন। সাংসদ হওয়াটা সেই দিক থেকে একটা ধাপ এগোনো, এমনও মনে করছেন সচিন। জানালেন, সুযোগ পেলে শুধু ক্রিকেট নয়, সব খেলারই উন্নতি করার চেষ্টা করবেন। সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। ‘পরিবর্তন’ সহজে আসবে না, তা-ও জানেন সচিন। তাই ‘বাধা পেরোতে’ সাংসদ, প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম, সাধারণ মানুষ সবাইকে পাশে চাইলেন। বললেন, “মানুষ যদি আমায় শুধু ক্রিকেটের পরিসংখ্যান দিয়ে মনে না রেখে দেশের খেলাধুলোয় অবদানের জন্য মনে রাখেন, সেটা অনেক বেশি আনন্দের হবে।”
নতুন সাংসদকে নিয়ে সরকারি গাড়িটা যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, তখনও সবার মুখে ক্রিকেটার সচিন। যেখানে শুধু ক্রিকেট আর ক্রিকেট। বদলাননি। সেটাই হয়তো সবথেকে বড় বদল।
শপথগ্রহণ শেষ। সাংসদ সচিন আপাতত ফের বাইশ গজের বৃত্তেই! |