|
|
|
|
মনমোহনের ঢাল সনিয়া, তবু ক্ষোভ দলীয় বৈঠকে |
ভাবমূর্তি ফেরাতে ‘ঝাঁকুনি’ চায় কংগ্রেস |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাড়িয়ে বৈঠকের গোড়াতেই সুর বেঁধে দিয়েছিলেন সনিয়া গাঁধী। কিন্তু ক্ষোভের প্রকাশ তাতেও ঠেকানো গেল না। সরকারের কাজকর্ম নিয়ে একটা নেতিবাচক ধারণা যে
তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে দলের অনেক নেতাই আজ সরব হলেন কেংগ্রস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে। দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করার দাবি জানালেন মনমোহন সরকারের উদ্দেশে।
চলতি আর্থিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে এই বৈঠক। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রণব মুখোপাধ্যায় জানালেন, অবস্থাটা মোটেই ১৯৯০-৯১ সালের মতো খারাপ নয়। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ দাবি করলেন, সরকার ভাল কাজই করেছে। বিরোধীদের মিথ্যা প্রচার ও অপপ্রচারের মোকাবিলা করতে হবে দলকে। এই
সব সত্ত্বেও দল ও সরকারের কাজকর্ম নিয়ে সমালোচনায় সরব হলেন দলের অনেক নেতাই। ইউপিএ-র দ্বিতীয় সরকারেরর এই মাঝামাঝি সময়ে সঙ্কটের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তির জন্য একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনির দাবি দলের মধ্যে ছিলই। আজ তা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের মতে, বল এখন সনিয়া গাঁধীর কোর্টে। দলের বর্ষীয়ানদের মত শোনার পর এখন তাঁকেই দাওয়াই ঠিক করতে হবে। তীব্র আর্থিক সঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধি, নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে পঙ্গু দশা ও পরের পর দুর্নীতির অভিযোগে যে ভাবে সরকারের ‘মলিন’ ও ‘মেরুদণ্ডহীন’ ভাবমূর্তি প্রকট হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে বর্ধিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ঝড় ওঠা প্রায় প্রত্যাশিতই ছিল। তা যাতে বিদ্রোহের আকার না নেয় সে জন্য শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী ও সরকারকে আড়াল করার পথ নেন কংগ্রেস সভানেত্রী।
কেন্দ্রে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার আসার এক বছর পর থেকেই তৈরি হতে শুরু করেছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পরিবেশ। স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি থেকে কমনওয়েলথ দুর্নীতি, অণ্ণা হজারের আন্দোলন, খাদ্যদ্রব্য ও পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে তা ক্রমশই জোরদার হয়। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডাকা হল দীর্ঘ এক বছর পর। দলে যে বেশ কিছু ক্ষোভ জমেছে তা আঁচ করে শুরুতেই আজ সনিয়া বলেন, “বিরোধী দল ও কিছু কংগ্রেস-বিরোধী শক্তি যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনছে, তা দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।” সেই সঙ্গে তাঁর এ-ও বক্তব্য, “সঙ্কটের পরিস্থিতিতেও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে সরকার।” পাশাপাশি কেন্দ্রের নীতি রূপায়ণে রাজ্যের অসহযোগিতার প্রসঙ্গও আজ তুলে ধরেন সনিয়া। |
|
বৈঠকে সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহ। সোমবার। ছবি-পি টি আই। |
এতে স্বাভাবিক ভাবেই পরিবেশ কিছুটা ইতিবাচক হয়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে। তিনি বলেন, “অর্থনীতিতে এমন সঙ্কটের পরিস্থিতি আসে, যখন তার উপর সরকারের বিশেষ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু এই রকম সময়ই আসল পরীক্ষা। নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।” তাঁর কথায়, “সরকার যে ভাল কাজ করেছে তা ভুলে গেলে চলবে না। সুতরাং সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার ও অপপ্রচারের মোকাবিলা করতে হবে দলকে।” যদিও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, আর্থিক সঙ্কটের পরিস্থিতি নিয়ে মনমোহন নিজেও কিছুটা অসন্তুষ্ট। অর্থনীতিকে বৃদ্ধির পথে ফেরানোর জন্য তিনি নিজেও সক্রিয় হচ্ছেন।
পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় অর্থমন্ত্রী এ দিন বলেন, “বিশ্বজনীন মন্দার প্রভাব এ দেশে পড়েছে। তাই বৃদ্ধির হার কমেছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্তরে পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ার কারণেই পেট্রোলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে তেল বিপণন সংস্থাগুলি।” পাশাপাশি তাঁর এ-ও বক্তব্য, বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিকে ’৯০-৯১ সালের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। কিন্তু এটা একেবারেই ঠিক নয়। তখনকার তুলনায় অর্থনীতি এখন অনেক মজবুত। তখন মাত্র ১৭ দিনের আমদানি খরচ মেটানোর মতো বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ছিল দেশে। এখন যা রয়েছে তা দিয়ে সাড়ে সাত মাসের আমদানি খরচ মেটানো সম্ভব।
কিন্তু মনমোহন-প্রণববাবুদের এই সব যুক্তি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের থামাতে পারেনি। দলের সব রাজ্য সভাপতি, মুখ্যমন্ত্রী ও পরিষদীয় নেতাকেও ডাকা হয়েছিল আজকের বৈঠকে। এ দিন সমালোচনার পুরোধা হয়ে ওঠেন কেরলের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি রমেশ চেন্নিথালা। তাঁদের বক্তব্যের নির্যাসটা এই রকম: অর্থনীতির অত হিসেবনিকেশ আম-আদমি বোঝেন না। তাঁরা দেখছেন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। বিরোধীরা সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ তুলছে, কিন্তু তাদের দুর্নীতি নিয়ে কংগ্রেসের আক্রমণ ঢিলেঢালা। দল ও সরকারকে এ কথা মাথায় রেখে এ বার কাজ করতে হবে। একই ধরনের মত প্রকাশ করেন ওয়ার্কিং কমিটির আরও কিছু সদস্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বৈঠকে বলেন, কেন্দ্রে সরকারের বাধ্যবাধকতা স্থানীয় মানুষকে বোঝানো সম্ভব নয় রাজ্য নেতৃত্বের পক্ষে। এ জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদেরই রাজ্যে রাজ্যে গিয়ে জনসভা করতে হবে। বর্ধিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আমন্ত্রিত নেতারা তাঁদের মতো করে এমন আরও কিছু দাওয়াইয়ের সুপারিশ করেছেন এ দিনের বৈঠকে।
সরকারের নীতিপঙ্গু দশা নিয়ে আলোচনায় শরিক দলের বাধার প্রসঙ্গটিও ওঠে আজ। মহারাষ্ট্রের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মাণিক রাও ঠাকরে সরাসরি এনসিপি নেতা শরদ পওয়ারের নাম তুলে তাঁর সমালোচনা করেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিরাও ক্ষোভ জানান যে, তৃণমূল শরিক দল হয়েও কেন্দ্রের নীতির বিরোধিতা করে যাচ্ছে। রাজ্যে মন্ত্রিসভায় কংগ্রেস থেকেও না থাকার সামিল। ফলে কংগ্রেস কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেও এ বার এই সব বিষয় ভাবতে হবে।
সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য না করলেও, অজিত যোগী, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিংহ হুডার মতো কিছু নেতা বলেন, নেতিবাচক বাতাবরণ কাটাতে তরুণ প্রজন্মকে এ বার বৃহত্তর দায়িত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। রাহুল গাঁধীকে কেবল যুব কংগ্রেসের দায়িত্ব দিলে চলবে না। আরও বড় দায়িত্ব দিতে হবে। রাহুল নিজে অবশ্য বৈঠকে নীরব ছিলেন আগাগোড়া।
কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, আসলে দলের নেতাদের মতামত শুনতেই সনিয়া-রাহুল এই বৈঠক ডেকেছিলেন। এর পর সরকার ও সংগঠনকে ঝাঁকুনি দিতে তাঁরা বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে আশা করা হচ্ছে। তার আগে আজকের বৈঠকের গোড়াতেই সনিয়া আসন্ন বিধানসভা ও ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের জন্য দলকে প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে দলের নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “দলের নেতারা দলবাজি, ফালতু কথা ও কাজে যতটা সময় ব্যয় করেন তা যদি কাজের কাজে লাগান তবে দ্বিগুণ ভাল ফল হতে পারে কংগ্রেসের।” |
|
|
|
|
|