|
|
|
|
সরকারের যুক্তি উড়িয়ে কড়া দাওয়াই চাইল দল, শিল্পমহল |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
মন্দার কালো মেঘ যতই ঘনাচ্ছে, ততই ফাটল তৈরি হচ্ছে মনমোহন সিংহের সরকার ও শিল্পমহলের মধ্যে। এমনকী শাসক দল কংগ্রেসের একটা বড় অংশও সরকারের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট। শিল্প মহল ও শাসক দল দুই পক্ষেরই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল আজ। এক দিকে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে সরকারকে বিঁধলেন শিল্প ও বণিক মহলের কর্তারা। অন্য দিকে, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত বৈঠকে সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সামনেই অসন্তোষ উগরে দিলেন বিভিন্ন রাজ্যের দলীয় নেতৃত্ব।
চলতি আর্থিক সঙ্কট সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাখ্যা: মূলত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিই এর জন্য দায়ী। কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করে আর্থিক সঙ্কট সামাল দেওয়ার ব্যাপারে গ্রিসের টালবাহানার কারণে ইউরোপ জুড়ে যে অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে, (যাকে বলা হচ্ছে ইউরোজোন সঙ্কট) তারই ছায়া পড়ছে ভারতের বাজারে। ডলারের দাম ক্রমশ বাড়ছে। এ দেশের শেয়ার বাজার থেকে লগ্নি তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ফলে পড়ছে শেয়ারের দাম। ক্রমশ ঘনাচ্ছে মন্দা।
কিন্তু সরকারের এই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ শিল্প ও বণিক মহলের কর্তারা। তাঁদের যুক্তি, বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার জন্য গ্রিসের সমস্যার থেকেও বেশি দায়ী দেশের বাজারে চড়া সুদের হার ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রের বিভিন্ন প্রকল্পে ছাড়পত্র দিতে টালবাহানা। জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ বিলেও শিল্পের কথা না-ভেবে শুধুই রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভাবা হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ।
আজ বর্ধিত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আর্থিক সঙ্কট নিয়ে যে আলোচনা হয়, সেখানেও মূলত ইউরোজোন সঙ্কটকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করান কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। পাশাপাশি তিনি বলেন, “বর্তমান সমস্যাকে যতটা বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে, অবস্থা মোটেই তত খারাপ নয়।” তাঁর যুক্তি, ১৯৯০ সালের মতো সঙ্কট তৈরি হয়নি। পরে অর্থ মন্ত্রকের এক অনুষ্ঠানে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম কমার ফলে এবং বর্ষা ভাল হলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। প্রধানমন্ত্রীও বলেন, “অর্থনীতিতে এমন সঙ্কটের পরিস্থিতি আসে, যখন তার উপর সরকারের বিশেষ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিন্তু এই সব সময়ই আসল পরীক্ষা। নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে।”
কিন্তু সরকারের যুক্তি খারিজ করে দিয়ে শিল্প মহল বলছে, সঙ্কট কতটা গভীর, তা এখনও বুঝতেই পারছে না সরকার। আর সমস্যার মূল ইউরোপে নয়, এ দেশেই। চড়া সুদের হার, দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার স্তব্ধ হয়ে থাকা, পরিবেশের দোহাই দিয়ে শিল্প প্রকল্পের ছাড়পত্র আটকে রাখা এবং সর্বোপরি আমলাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত না নেওয়ার মানসিকতাই শিল্প ক্ষেত্রে মন্দা ডেকে এনেছে। ফিকি-র মহাসচিব রাজীব কুমারের মতে, “গ্রিসের সমস্যার মতো যে সব বিষয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, তা নিয়ে না ভেবে ঘরোয়া সমস্যাগুলি সমাধান করা উচিত।” |
আর্থিক সঙ্কটের চাপানউতোর |
যতটা বলা হচ্ছে, অবস্থা মোটেই তত খারাপ নয়। অশোধিত তেলের দাম কমার ফলে এবং বর্ষা ভাল হলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
প্রণব মুখোপাধ্যায়, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী |
|
এই সঙ্কট কতটা গভীর, তা এখনও বুঝতে পারেনি সরকার।
আর ভি কানোরিয়া সভাপতি, ফিকি |
|
যা নিয়ন্ত্রণে নেই, তা নিয়ে না ভেবে ঘরোয়া সমস্যা সমাধান করা উচিত।
রাজীব কুমারমহাসচিব, ফিকি |
|
সংস্কার নিয়ে দোলাচল লোকে মোটেই ভাল
চোখে দেখছে না।
মণীশ তিওয়ারি, কংগ্রেস মুখপাত্র |
|
কংগ্রেসের বিভিন্ন রাজ্যের নেতারাও সরকারের যুক্তিতে বিশেষ সন্তুষ্ট নন। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আজ সব রাজ্যের কংগ্রেস সভাপতি এবং মুখ্যমন্ত্রী বা পরিষদীয় দলনেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাঁদের অনেকেই বলেন, সাধারণ মানুষ এ সব অর্থনীতির হিসেবনিকেষ বোঝে না। তারা দেখছে জিনিসের দাম বাড়ছে। সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। সুতরাং সরকারকে কিছু করে দেখাতে হবে।
শিল্প মহলও চাইছে সরকার কিছু করে দেখাক। সরকারের সামনে ১২ দফা দাবি পেশ করে ফিকি-র সভাপতি আর ভি কানোরিয়া আজ বলেন, “অর্থনীতিতে যে বড়সড় সঙ্কট তৈরি হয়েছে, কেন্দ্রকে প্রথমে তা মেনে নিতে হবে। এই সঙ্কট কতটা গভীর, তা এখনও বুঝতে পারেনি সরকার।” বণিকসভার বক্তব্য, অনেকেই বলছেন, আর্থিক বৃদ্ধিতে শুধু শিল্পপতিদের লাভ হয়। কিন্তু বৃদ্ধির হার ৯% থেকে ৬%-এ নেমে আসার অর্থ ৩ কোটি নতুন কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ হারানো। এই অবস্থায় সরকারের জনমোহিনী নীতি থেকে সরে এসে রাজকোষ ঘাটতিতে রাশ টানা উচিত।
কিন্তু প্রণববাবু আজই যুক্তি দিয়েছেন, ২০০৮ সালের মন্দার রেশ কাটতে না-কাটতেই যে ভাবে আর একটি মন্দা এসে পড়েছে, তাতে ঘাটতি কমানোর জন্য কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগই মেলেনি। শিল্প মহল অবশ্য সেই যুক্তি মানতে নারাজ। ফিকি-র মতে, সরকারের উচিত পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধি কমানোর চেষ্টা করা। কিন্তু কেন্দ্র সুদের হার বাড়িয়ে, নগদের জোগান কমিয়ে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। ফলে নতুন বিনিয়োগে ধাক্কা লেগেছে। শিল্প মহলের আরও অভিযোগ, লগ্নি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতেই ব্যর্থ কেন্দ্র। যার মূল কারণ সংস্কার নিয়ে তাদের দোলাচল। এক পা এগিয়েও শরিকদের চাপে দু’পা এগিয়ে আসা। যার উদাহরণ, বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির অনুমতি বা পেনশন ও বিমা ক্ষেত্রের সংস্কার। সরকারের নীতিপঙ্গু দশা নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সরব হন কংগ্রেস মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারিও। তিনি বলেন, “সংস্কার নিয়ে সরকারের দোলাচল সাধারণ মানুষ মোটেই ভাল চোখে দেখছে না। সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
অর্থনীতির দাবি মেটাতে সরকার কতটা কড়া হতে পারে তার দিকেই এখন তাকিয়ে দল ও শিল্প মহল। |
|
|
|
|
|