আহত সিংহের মতোই তিনি একা। আপাতত।
তাঁর আঙুল আঁকড়ে ‘বড়’ হয়ে ওঠা অনুগামীরা একে একে সরে গিয়েছেন। হাতের মুঠো থেকে এক এক করে খসে গিয়েছে সাজানো ‘সাম্রাজ্য’। দু’বছর আগে নিজের খাসতালুক রানাঘাটেও মুখ থুবড়ে পড়েছেন তিনি। পড়ে থাকল, বারো ওয়ার্ডের প্রান্তিক জনপদ নদিয়ার কুপার্স ক্যাম্প। পনেরো বছর ধরে বুক দিয়ে যাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। বলছেন, “কুপার্সকে আমি চিনি, কুপার্সও আমায় চেনে। এখানকার মানুষ আমাকে ঠকাবে না।”
রাতে, বারো কিলোমিটার দূরে চাকদহের সিংহিবাগানের বাড়িতে নিতান্তই ঘণ্টা কয়েকের ঘুম বাদ দিলে কুপার্সের অলিগলি, আর আটপৌরে কংগ্রেস কার্যালয়টাই তাঁর সাম্প্রতিক ঠিকানা।
কালো প্যান্ট, খাটো পাঞ্জাবি। কচ্চিৎ, না-গুঁজে পড়া হাল্কা রঙের জামা। ’৯০-এর ৩১ মে, চাকদহের বাড়ি থেকে দু’পা বাড়াতেই দুষ্কৃতীদের বোমায় বাঁ চোখ গিয়েছিল তাঁর। তার বছর ছয়েক পরে বাড়ির কাছেই হবিবপুরে ফের গাড়ি থামিয়ে হামলা চালানো হয়। তার পর থেকে জামা গোঁজেন না তিনি। কেন? “ও এমনিই” প্রশ্নটা এড়িয়েই যান। |
নিজের খাসতালুকে বারংবার আক্রান্ত, শরীর জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অজস্র হামলার দাগ। গায়ে লটকে গিয়েছিল ‘গুন্ডা’ ইমেজ। যে কারণে ১৯৯৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পেলে গলায় দড়ি দেবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন তৎকালীন যুব কংগ্রেস সভাপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মনে পড়ে? টানটান ‘ক্ষতবিক্ষত’ ইমেজ নিয়ে খানিক চুপ করে থাকেন জাতে রাজপুত, নদিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি। তার পরে বলেন, “সবই মনে আছে। এত ঝড় সয়েও দলের একনিষ্ঠ সৈনিক হয়ে মাটি কামড়ে পড়ে আছি। রাজনীতির লড়াইয়ে গুন্ডা বলে কি আমায় দমানো যায়? মানুষ আমায় চেনেন, আমিও তাঁদের চিনি।”
তবে চেনা মানুষ অচেনা হতেও তিনি কম দেখেননি।
বছর তিনেক আগেও যে মুখগুলো সারাক্ষণ তাঁকে ঘিরে থাকত, তাঁদের অন্যতম রানাঘাটের পুরপ্রধান পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ‘পরিবর্তনের ভোটের’ ঠিক আগে হাওয়া বুঝে প্রায় সব কাউন্সিলর সঙ্গে নিয়ে তিনি তৃণমূলে ভিড়েছেন। হাতের তালুর মতো ‘চেনা’ রানাঘাট চলে গিয়েছে তাঁর হাতের বাইরে। এক দিন যিনি বলেছিলেন, ‘রানাঘাট হাতছাড়া হলে রাজনীতিই ছেড়ে দেব’ তাঁকেই পরে ঢোঁক গিলে বলতে হয়েছে, ‘দল অনুমোদন না দিলে কী করব!’
মনোমালিন্যের জেরে দল বদলেছেন আর এক ‘ঘনিষ্ঠ’ গৌরীশঙ্কর দত্তও। তাঁর সৌজন্যে কৃষ্ণনগর পুরসভায় কংগ্রেসের আধিপত্যে থাবা বসিয়েছে তৃণমূল। ‘পুরস্কার’ হিসেবে বিধানসভা ভোটে তেহট্টে গৌরীবাবুকে টিকিটও দিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় তিনি জিততে পারেননি। কংগ্রেসেরও নাক কাটা গিয়েছে। তাঁর এক সময়ের অনুগামী ‘জোটপন্থী’ অজয় দে অবশ্য কংগ্রেস ছাড়েননি। কিন্তু ২০০৯-এ লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই তাঁর সঙ্গে ‘দূরত্ব’ বেড়েছে। অজয়বাবুর শান্তিপুরে কোনও অনুষ্ঠানেই আর তাঁর ডাক পড়ে না আজকাল। হারানোর তালিকায় শেষ সংযোজন অনুগামীদের দখলে থাকা চাপড়া পঞ্চায়েত সমিতি। তৃণমূল ছিনিয়ে নিয়েছে তা-ও। |
জমি হারাতে হারাতে শেষে পা ঠেকেছে এখন সেই কুপার্স ক্যাম্পে, দেশভাগের পরে বাস্তুহারারা এসে যেখানে ঠাঁই নিয়েছিলেন। কার্যত ‘উদ্বাস্তু’ নেতার ভরসা এখন সেই উদ্বাস্তুরাই। অন্তত ছ’দশক আগে ‘ইন্ডিয়া’য় এসেও যাঁদের অনেকে এখনও জমির পাট্টা পাননি। গত তিন পুরভোটে কংগ্রেসকেই জিতিয়ে এসেছে কুপার্স। আর আপাতত সেই ভরসা আঁকড়েই পড়ে আছেন ‘একা কুম্ভ’। ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, “দাদা জানেন, এটাই তাঁর শেষ ভরসা। কুপার্স চলে গেলে জেলা থেকে তাঁর অস্তিত্বই মুছে যাবে।”
তিনিও হয়তো তা বুঝছেন। হয়তো সে কারণেই বারবার জোর দিয়ে বলছেন, “দেখবেন, এ বার কুপার্সে ১২-০ মার্জিনে জিতব।”
কোন জাদুমন্ত্রে? তাঁর দাবি, “বাম আমলে পুরসভা চালাতে গিয়ে পদে পদে বাধা পেয়েছি আমরা। গত এক বছরে তৃণমূলের সরকার দ্বিগুণ বাধা দিয়েছে। মানুষ তা জানেন। এ বার কুপার্স জিতেই পাট্টার জন্য বড় আন্দোলনে নামব।” কিন্তু কোথাও একটা কাঁটা হয়তো খচখচ করছে। হয়তো তাই দীপা দাশমুন্সি থেকে অধীর চৌধুরী দলের ডাকাবুকো এবং ঘোর তৃণমূল-বিরোধী সাংসদদের প্রচারে এনে ‘সংশয়’ দূর করতে চাইছেন তিনি।
ত্রিমুখী লড়াইয়ে বাকি দুই শিবিরও হুঙ্কার দিতে ছাড়ছে না। সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে-র প্রশ্ন, “যিনি ১২-০’র ভবিষ্যৎবাণী করছেন, গত পনেরো বছরে তিনি কোন কাজটা করেছেন?” তৃণমূল বিধায়ক আবীর বিশ্বাসের কটাক্ষ, “কুপার্সের মানুষ তাঁর চেহারা-চরিত্র সবই জানে!”
আর তিনি, কুপার্সের কেল্লা আঁকড়ে পড়ে থাকা শঙ্কর সিংহ? তিনি হয়তো এখনও জানেন, কুপার্সের ‘পাট্টা’ তাঁরই।
মরিয়া লড়াইটা কিন্তু চোখে পড়ছেই। |