তিন জনেই খেলছেন মাঝমাঠে। যদিও মুখোমুখি দেখা হবে না।
এক জনের বাবা প্রবাদপ্রতিম কংগ্রেস নেতা। কিন্তু তিনি দল ছেড়েছেন। বরং এই যুদ্ধে তিনি, সেই অপূর্ব মুখোপাধ্যায়ই ‘দিদি’র দলের সেনানায়ক।
সিপিএম ‘সেনানায়ক’ বা ‘মেয়র পদপ্রার্থী’ বলে না কাউকে প্রকাশ্যে। কিন্তু দুর্গাপুরে ‘লালদুর্গ’ বাঁচাতে এ বার যাঁকে সামনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, সেই বিপ্রেন্দু চক্রবর্তীর আবার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল অপূর্ববাবুর বাবার হাতেই।
তৃতীয় জনের সম্বল এআইসিসি-র দেওয়া একটি জিপ, যা নাকি কংগ্রেসের প্রতি তাঁর ‘বিশ্বস্ততা’র প্রতীক। যদিও তৃণমূলের লোকেরা যখন এক সময়ে কংগ্রেস নেতাদের ‘তরমুজ’ (বাইরে সবুজ, ভিতরে লাল) বলত, বংশীবদন কর্মকারকেও তা শুনতে হয়েছে।
ভোটের সিঁড়িভাঙা অঙ্ক ধরে যদি বিচার করা যায়, বংশীবাবু বাকি দু’জনের তুলনায় কিছুটা পিছিয়েই রয়েছেন। বিপ্রেন্দুবাবু শুধু দু’বারের কাউন্সিলর নন, প্রাক্তন বিধায়কও। ১৯৯৭ সালে প্রথম পুরবোর্ড গঠন হওয়া ইস্তক প্রকাশ্যে-প্রচ্ছন্নে তিনিই ছিলেন অন্যতম নিয়ন্তা। অপূর্ববাবু আগে কখনও পুরভোটে দাঁড়াননি, কিন্তু দু’বারের বিধায়ক। এ বার জিতেছেন বিপ্রেন্দুবাবুকে হারিয়েই। বংশীবাবুও বিধানসভা ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু জিততে পারেননি। তবে পুরভোটে তাঁর অভিজ্ঞতা কম নয়। |
বামেরা এত দিন সাধারণ
পরিষেবাটুকুও দিতে পারেননি।
অপূর্ব মুখোপাধ্যায়, তৃণমূল |
উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অধিকার
অক্ষুণ্ণ রাখতে আমাদের ভোট দেবেন।
বিপ্রেন্দু চক্রবর্তী, সিপিএম |
আমি ঢাক পেটাই না। মানুষ
আমার কাজ দেখেই ভোট দেবেন।
বংশীবদন কর্মকার, কংগ্রেস |
|
এ বারে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হলে হয়তো চিত্রটা আলাদা হত। কিন্তু এখন ত্রিমুখী লড়াইয়ে (বিজেপি তত শক্তিধর নয়) তিন প্রধান নেতার গ্রহণযোগ্যতা এবং রণকৌশল ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে গোটা ভোট-রঙ্গ। রাজ্যে পালাবদলের পর থেকে ‘কোণঠাসা’ সিপিএম মুখে স্বীকার না করলেও রাজ্য সরকারের দুই শরিকের ভোট কাটাকাটিতেই বেশি আস্থা রাখছে। তৃণমূল আবার চাইছে বামফ্রন্টকে মূল বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে কংগ্রেসকে ‘সাইনবোর্ড’ করে দিতে। এক কালে আনন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের চারণভূমি দুর্গাপুরে কংগ্রেসের সুদিন অনেক আগেই গিয়েছে। নিজেদের ক্ষমতায় বোর্ড দখলের আশা সম্ভবত তারা করছেও না। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তলায়-তলায় সমঝোতা না হলে তৃণমূলকে তারা ফাঁকা মাঠও ছাড়বে না। ফলে নানা অঙ্ক মাথায় রেখেই এগোতে হচ্ছে তিন নেতাকে।
প্রাক্তন সাংসদ, বিধায়ক তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি আনন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের ছেলে হওয়ার সুবিধা অপূর্ববাবু চিরকালই কমবেশি পেয়েছেন। কিন্তু পিতৃবিয়োগের পরে আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের টিকিট চেয়েও পাননি। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের ঘর ছাড়লে তিনিও পিছু-পিছু পা বাড়ান। ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে জিতেই বিধায়ক হন তিনি। কিন্তু পরের বার বিপ্রেন্দুবাবু তাঁকে পরাজিত করেন। তা সত্ত্বেও গত বছর ‘পরিবর্তনের ভোটে’ তৃণমূল তাঁকে ফের টিকিট দেয় এবং প্রায় ১৬ হাজার ভোটে বিপ্রেন্দুবাবুকে হারিয়েই তিনি ‘মধুর প্রতিশোধ’ নিয়েছেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, দলে তাঁর ‘কাঁটা’ আইএনটিটিইউসি প্রভাত চট্টোপাধ্যায়। প্রভাতবাবুও পুরভোটে দাঁড়িয়েছেন। তবে আপাতত ভোটের বাজারে দু’জন দু’জনকে দেখলেই জড়িয়ে ধরছেন।
তুলনায় সময়টা খারাপ যাচ্ছে বিপ্রেন্দুবাবুর। গত বছর থেকেই। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেস সেবাদল করতে করতে যিনি আনন্দগোপালের পোলিং এজেন্ট হয়েছিলেন, এমএএমসি কারখানায় শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত দাদার প্রভাবে তিনিই পরে সিপিএমে চলে যান। ১৯৯৭ সালের প্রথম পুরভোটে জিতেই মেয়র পারিষদ, পাঁচ বছর পরে পুনরাবৃত্তি। দল তো বটেই, চেনা-পরিচিত সকলের মুখে-মুখেই ‘ভজনদা’ হয়ে ওঠেন তিনি। প্রতিপত্তি বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছয় যে রথীন রায় মেয়র হলেও তাঁকেই ‘ডি-ফ্যাক্টো’ (অর্থাৎ কার্যত) মেয়র বলে ডাকত লোকজন। ২০০৬-এর বিধায়ক হওয়ার পরে, পরের বছর পুরভোটে দল আর তাঁকে দাঁড় করায়নি। কিন্তু এ বার কঠিন সময়ে তিন বারের মেয়র রথীন রায়কে সরিয়ে তাঁকে ফের প্রার্থী করা হয়েছে। বামফ্রন্ট জিতলে তাঁর মেয়র হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু সময়টাই যে গোলমেলে। নিজের ওয়ার্ডে মিছিল করতে ‘ভজনদা’কে পুলিশ ডাকতে হয়েছে, এক বছর আগে মার্কসের নামে দিব্যি দিয়ে বললেও সিপিএম কর্মীরা তা বিশ্বাস করতেন না। |
সার কথা |
মোট ভোটার: ৩,৬৭,০৪০ জন
পুরুষ: ১,৯৭,৬১৪ জন
মহিলা: ১,৬৯,৪২৬ জন
ওয়ার্ড: ৪৩টি
মোট বুথ: ৪৫৮টি
মোট প্রার্থী: ১৬৭ (
তৃণমূল ৪৩, সিপিএম ৩৮, কংগ্রেস ৩৫, বিজেপি ৩০, সিপিআই ৩, জেডি (ইউ) ৩, ফরোয়ার্ড ব্লক ১,
আরএসপি ১, নির্দল ১৩) |
|
এত ‘মহিমা’ না থাকলেও বংশীবাবু কিন্তু ছোট মাঠের খেলাটা যথেষ্ট ভাল বোঝেন। এককালে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ‘কাছের লোক’ বলে পরিচিত, প্রদেশ কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটির সদস্য। ১৯৯৭ ও ২০০২ পরপর দু’বার ২৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জেতেন। গত বার ওয়ার্ডটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ায় সেখানে স্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে নিজে পাশের ওয়ার্ডে সরে যান। স্ত্রীকে জিতিয়ে আনেন, নিজেও জেতেন। এ বারও পাশাপাশি ওয়ার্ডে ‘দাদা-বৌদি’ দাঁড়িয়েছেন। যদিও আগের বারের মতো তৃণমূল তাঁদের পাশে নেই।
৪৩ ওয়ার্ডের দুর্গাপুরে তিন বাহিনীর মাথাই দাঁড়িয়েছেন কাছাকাছি, কার্যত মাঝমাঠে। গত বছর প্রায় দেড় হাজার ভোটে তৃণমূলকে ‘লিড’ দেওয়া সিটি সেন্টারে (২২ নম্বর) অপূর্ববাবু। সেই পরিবর্তনের ভোটেও সিপিএমকে এগারোশো ভোটের লিড দেওয়া বেনাচিতিতে (২১ নম্বর) ‘ভজনদা’। আর হাতের মুঠোয় থাকা ২৬ নম্বরে স্ত্রীকে রেখে ২৭ নম্বরে বংশীবাবু।
দাবায় রাজা খাওয়া না গেলে কিস্তিমাত হয় না। ভোটের নিয়ম আলাদা।
দল হারে হারুক, ‘দলনেতা’ যেন না হারেন। |