|
|
|
|
ছায়াভর্তি ভরদুপুর ও আমপোড়া |
যখন মাটির কুঁজোয় খাবার জল থাকত, যখন শশা বিক্রির বাজার রমরমিয়ে উঠত ‘দেব নাকি ছাল ছাড়িয়ে, নুন মাখিয়ে’ বলে।
আর এক এক দিন দুপুরবেলায় পরমান্নের মতো আমরা তারিয়ে তারিয়ে খেতাম নুন-লঙ্কা দেওয়া কাঁচা আম। সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
ভত্তি দুপুরবেলা, ভূতে মারে ঢ্যালা... এই অমোঘ বাক্যটা মনে রেখে ছোট্ট বেলার গরমের দুপুরগুলো চুপচাপ শুয়ে থাকতে হত মা’র পাশে। নচেত, বেরোলেই ঢ্যালা। আমায় বলা হয়েছিল, লু-এর সঙ্গে বয়ে আসে এই ঢ্যালা। অতএব নট নড়নচড়ন। ঘুম না এলেও চুপটি করে শুয়ে থাকতেই হবে। তবে শুয়ে থাকলে যে ভূত আসত না এ কথা ডাঁহা মিথ্যে। জানলার খড়খড়ি দিয়ে সিধে এক ফালি চোরা আলো দেওয়ালে এসে পড়ত, আর সেখানে অবিরত ভূতেদের যাতায়াত। কালো কালো চেহারার ছোট্ট ছোট্ট লোক সর্বদা হেঁটে যেত। কারও হাতে ব্যাগ, কারও মাথায় ঝুড়ি, কারও অনেক লম্বা চুল আমি বেশ বুঝতে পারতাম। কেউ যদি এই দুপুরবেলায় না বেরোয়, তা হলে এরা কারা? কোনও বিশ্বাসযোগ্য জবাব আমি পাইনি।
এ রকম ছায়াভর্তি ভরদুপুর আমার মতো নিশ্চয়ই অনেকেই এনজয় করেছে। অন্তত যাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল করে। যারা আমদের ছোটবেলার দুপুরে উপস্থিত থেকে গিয়েছে তাদের ছায়া উপহার দিয়ে। এ সব গরমের দুপুর তখন ছিল যখন জানলায় খড়খড়ি ছিল, যখন সব্বার বাড়ি ফ্রিজ আসেনি, যখন মাটির কুঁজো বা জালায় জল খাবার জল থাকত, যখন রইরই করে বাসস্ট্যান্ডে শশা বিক্রির বাজার রমরমিয়ে উঠত ‘দেব নাকি ছাল ছাড়িয়ে, নুন মাখিয়ে’ বলে। আর এক এক দিন দুপুরবেলায় পরমান্নের মতো আমরা তারিয়ে তারিয়ে খেতাম নুন-লঙ্কা দেওয়া কাঁচা আম এবং অবশ্যই এক চোখ বুজে।
সে কালে লোডশেডিং-এর ভারী বাজার ছিল। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওঁদের মধ্যে, মানে যাঁরা ইলেকট্রিক অফিসে সময়ে সময়ে কারেন্ট অফ করে দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন, অনেকেই ছিলেন ঘোর ষড়যন্ত্রী। আমার মা সারা সকাল খেটেখুটে, ঘেমেনেয়ে যেই না খেয়ে উঠে খোঁপাটা খুলে চুলগুলো বালিশের ও পারে দিয়ে শুত, অমনি ফুউউউসসসস করে পাখাটি বন্ধ হয়ে যেত। না না, এরা কী করে ঠিক জানত যে মা ঠিক এই সময়টাতেই এসে শোবে। আগের দিন তো প্রায় পনেরো মিনিট পরে শুতে এসেছিল ঠিক তখনই গেল। আজ তাড়াতাড়ি হল আজও ঠিক কী করে এই সময়ই কারেন্ট যায়! বললে হবে এটা সমাপতন? এতে পৈশাচিক আনন্দ পায় ওরা। আমি জানি মা, ওরা ঠিক তোমায় কষ্ট দেবে বলেই এই ব্যবস্থা করেছে। এবং আমি শিয়োর যে এটা শুধু আমার মা নয়, তখনকার সব মায়েদের প্রতি অন্যায় ষড়যন্ত্র। মা, আমি এখনও এর প্রতিবাদ জানাই।
এর চেয়ে যখন একটু বড়, তখন হঠাৎই গরমের দুপুরের ঘুমটাকে বাড়ির বড়রা খুন করে দেয় ছুটির কাজ বা ভেকেশন টাস্ক করো বলে। যারা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ত, তারা কী সব প্রোজেক্ট-ফোজেক্ট করত। আমরা যারা বাংলা মিডিয়াম, তাদের নিয়ম করে গোটা কুড়ি অঙ্ক আর ইংরেজি ট্রান্সলেশন করতেই হত। কী বিপদ! সকালে করলে হবে না, সন্ধেয় করলে হবে না। ঠিক দুপুরবেলাতেই কেন এই কাজগুলো করতে হবে কে জানে। হঠাৎ ফরমান জারি হল দুপুরে ঘুমোবে না। আর যে বয়সটার কথা বলছি, সেই বয়সে ছুটির দুপুরে ঘুমোতে কী যে ভাল লাগে, সে কথা সব্বাই জানে। সারা সকাল ঘেমে, লোডশেডিং-এর অত্যচার সহ্য করে, দুপুরবেলা টাইট করে জানলা-দরজা বন্ধ করে, মেঝেতে জল ঢেলে পাখা চালিয়ে, এমনকী ঘর ঠান্ডা করার আকিঙ্খেয় জানলার পর্দা অবধি ভিজিয়ে, যখন প্রার্থিত ঘরটার দিকে পা বাড়াবে একটা আয়েশের ঘুমের জন্য, ঠিক তখনই ‘অঙ্ক করতে বোস, দুপুরে ঘুমোনো ভাল নয়!’ এই নীতিবাক্যটি ধাঁ এসে পড়বে ঘুমের সামনে। অগত্যা।
এর পরেও যে কোনও কোনও গরমের দুপুরে বালিশ বগলে অন্য ঘরে ঘুমিয়ে নেওয়া যায় না, তা কিন্তু নয়। এবং মায়ের দুর্ভাগ্যের দোসর হয়ে লোডশেডিংও সহ্য করতে হয়। কিন্তু এই গরমে পাখা ছাড়া ঘেমেনেয়ে একটা যা ঘুম হয় না সে কথা বলার নয়। যে দিকে পাশ ফিরে শোবে সে দিকটা চুপচুপে ভিজে। মাটিতে শুলে একপাশ ঘামে ভেজার প্রমাণ হয়ে ফুটে উঠবে লাল মাটিতে স্বেদবিন্দুরা। সেই ঘুমটা যে না উপভোগ করেছে, সে ফাঁকি, ফাঁকি। আর তার পর ঘামে ভিজে যখন সাড়ে তিনটে নাগাদ ঘুমের দফারফা হয়ই হয় গরমের তড়পানিতে, তখন যদি পাশ থেকে কেউ বলে কী রে আমপোড়ার শরবত খাবি নাকি এখন? ‘বরফ কোথায় পেলে?’ ‘দাদা গেছিল বরফকলে’। দিব্যি করে বলছি আশির দশকেও গোটা কয়েক বরফকল ছিল কিন্তু। মায়েদের নীলষষ্ঠীর দিন নিয়ম করে সেখান থেকে বরফের চাংড় আসত। বেলের শরবতে দেওয়া হত। আর এ রকম অবরেসবরে এক-আধ দিন আমপোড়ার শরবত কিংবা ঘোলের কপালেও জুটে যেত দু-চার টুকরো সাদা গোলা। আর গালাগাল কুড়োনো দুপুরবেলাটা হয়ে উঠত চিকচিকে, ঝিকমিক।
আর ঝিকমিকে দুপুরের শেষে এক এক দিন কালবোশেখি আসত। একটা ঠান্ডা হাওয়া নাকে এসে লাগত আর লাগ লাগ লাগ ভেলকি। প্রবল ঝড়ে নাকে-মুখে বালি নিয়ে চোখ পিটপিট করে দাঁড়িয়ে থাকতাম রাস্তার দিকে বারান্দায়। ছোট ছোট এ দিক ওদিক, দোকানের চাল উড়ে গেল, কিছু লোক দৌড়ে গিয়ে দাঁড়াল উজ্জ্বলা সিনেমার বারান্দার নীচে, হুস করে উড়ে গেল পাজামা, গামছা, ফ্রক, ট্রামের তার ছিঁড়ে পড়ল, হকার্স কর্নারের দোকানের প্লাস্টিক ইট দিয়ে চাপা দেওয়া হল, আর তার পর বৃষ্টি বৃষ্টি, কী বৃষ্টি। আমি ভিজছি, দিদি ভিজছে, মা ভিজছে, জেঠিমা ভিজছে, এমনকী কাজে এসেছিল একাদশী মাসি সে-ও খিলখিলিয়ে ভিজছে। শিল পড়লে তো কথাই নেই। ছোট্ট বারান্দায় এ দিক ওদিক শিল কোড়ানো নিয়ে লাফালাফি, কয়েকটা টপাটপ মুখে। মা অবধি বকছে না, খালি হাসি হাসি মুখে ভিজছে। একাদশী মাসি তো কাজ সেরে ভিজে কাপড়েই চলে গেল ফের অন্য বাড়ি। আজ ওর একটুও মেজাজ খারাপ নেই। এমন জমকালো দুপুর বলেই না ওরম ঝমঝমে বিকেল!
তবে গরমের দুপুরে নাকে গরম হাওয়া না লাগলে আর গরম কী? সে কোটাও পূর্ণ করেছে কলেজবেলা। কলেজকালে তো ম্যাটিনিতে সিনেমা নিয়ম করে। না হলে কলেজ-ধর্মে পাপ। গরম বলে তো আর ধর্মচ্যুতি ঘটানো যায় না। আর ২:৪৫-এর শো মানে বেরোতে হবে ভরদুপুরেই। সানস্ক্রিন তখনও যৌবন দখল করে নেয়নি। গরম হাওয়ার কবল থেকে কিঞ্চিত ছাড়ের জন্য নাকমুখ চেপে মেট্রো স্টেশনের সামনে বন্ধুদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা আর তার পর ঠান্ডা হলে ঢুকে সেই সিনেমা হল-সিনেমা হল টিপিকাল গন্ধ, রোদ থেকে অন্ধকারে ঢুকে চোখে তারা দেখা, কোনও দুপুরে ক্যান্টিন গ্যাংয়ের সঙ্গে দুপুর দুপুর গঙ্গার ধারে স্কুপ-এ আইসক্রিম খেতে যাওয়া মানে তো হাতে এক পিস গিনি। আর ফেরার পথে বাবুঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা ফাঁকা প্রাইভেট বাসের জানলা থেকে বিকেলের ডুবন্ত সূর্য দেখে কলেজ-কুইনের কোটেশনের বহর সে কথা না হয় কোনও এক গনগনে গরমের দুপুরে বন্ধুর বাড়ির ছাদের ঘরের আড্ডার জন্য তোলা থাক।
|
সব ছবি এঁকেছেন: উপল সেনগুপ্ত |
|
|
|
|
|