পুস্তক পরিচয় ১...
স্বপ্ন দেখারও অধিকার আছে
ওয়ান লিটল ফিঙ্গার, মালিনী চিব। সেজ, ৩৫০.০০
প্রতিবন্ধকতা কোনও অসুখ নয়। আগেও আমরা এ কথা শুনেছি। কিন্তু যখন আপনি মালিনী চিব-এর আত্মজীবনী ওয়ান লিটল ফিঙ্গার পড়বেন, আপনার মনে বার বার এই কথাটাই ঘুরে ফিরে আসবে। সচেতনতার অভাব থেকে প্রত্যেককে সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বের করে আনা আর মাঝে মাঝে অনুভূতিহীন শব্দ উচ্চারণ করার যে তীব্র ইচ্ছে আপনার মধ্যে মাথাচাড়া দেয়, তা অবদমিত হবে। মালিনী জন্মেছিলেন সেরিব্রাল পালসি নিয়ে। সেরিব্রাল পালসি এক ধরনের শারীরিক যন্ত্রণা, কোনও রোগ নয়। যাঁরা এর শিকার, তাঁদের অধিকাংশই মানসিক দিক থেকে একেবারে সুস্থ থাকেন, কিন্তু শরীর তাঁদের বশে থাকে না। আমাদের বোধশক্তিহীন এবং সময় সময় নিষ্ঠুর সমাজে আরও অনেকের মতোই মালিনীও প্রতি নিয়ত কোণঠাসা হচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি এমনই এক মানুষ, যিনি তাঁর মনের জোর, অটল সংকল্প এবং সর্বোপরি, তাঁর পরিবারের নিরলস উৎসাহে এ সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন।
মালিনীর গল্প কিন্তু পুরোপুরি রূপকথা নয়। বরং এর ঠিক উল্টো। তাঁর জীবনেও বিচ্ছেদ, অবসাদ, হতাশা, ক্ষতির মতো নিয়মিত ওঠাপড়া ছিল। কিন্তু এক অদম্য সাহসের সঙ্গে তিনি এর মোকাবিলা করেছেন। হুইলচেয়ারকে সঙ্গী করে তিনি খুব ধীরে ধীরে এই ধরনের বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। তিনি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন (‘এই ধরনের ছাত্রছাত্রীরা কেন পরীক্ষা দিতে চায়?’ এরকম মন্তব্য সত্ত্বেও), এর পরে বি এ এবং দু’টি আন্তর্জাতিক মাস্টার ডিগ্রিও লাভ করেন। চাকরি-জীবনে প্রবেশ করে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নিজের জীবনকে স্বাধীন এবং পরিপূর্ণ ভাবে গড়ে তুলতে পেরে তিনি আজ বিজয়িনী। এখন তিনি বিশ্বাস করেন যে, জীবনের সবটুকু নিয়ে বাঁচা উচিত এবং শারীরিক অক্ষমতা এ ক্ষেত্রে কোনও বাধাই নয়।
কিন্তু মালিনী ভাগ্যবান। নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তাঁর পরিস্থিতি অধিকাংশের চেয়ে অনেক ভাল, কারণ তিনি এক স্বচ্ছল পরিবার থেকে এসেছেন, এবং তাঁকে ঘিরে থেকেছে অত্যন্ত বুঝদার এবং সহানুভূতিশীল এক পরিবার এবং বন্ধুমণ্ডলী।
ওয়ান লিটল ফিঙ্গার শুধুমাত্র মালিনীকে নিয়েই লেখা নয়। বইটি সামনে নিয়ে এসেছে আমাদের সমাজের খামতিগুলিকে। এখানে ভারতীয় এবং ব্রিটিশ সমাজের মধ্যে এক কঠোর তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে; ব্রিটেন এবং ভারতের স্পেশাল এডুকেশন সিস্টেম-এর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে এবং শেষে প্রতিবন্ধী মানুষদের প্রদেয় সুযোগসুবিধের ক্ষেত্রে দুই দেশের বিশাল ফারাককে প্রকট ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ভারতীয় সমাজের প্রয়োজন নিজেকে বিবর্তিত করা এবং প্রতিবন্ধকতার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা। তথাকথিত সুস্থ সমাজ প্রতিবন্ধী মানুষদের দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, অথবা অধিকাংশ সময় তারা প্রতিবন্ধী মানুষের কাছ থেকে এমন আচরণ প্রত্যাশা করে, তা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। চরম নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক ওই তীব্র চাহনি, অনুভূতিহীন মন্তব্য এবং পরিকাঠামোর অভাব প্রতিবন্ধীদের প্রতি নিছক করুণা দেখানো বা কর্তৃত্বমূলক আচরণ প্রদর্শনের মতোই ঘৃণ্য।
মালিনী দুঃখ করেছেন, ‘দাতব্য প্রদর্শনই এখানে প্রধান ছিল, আর আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে। আশা করা হয়েছিল ওখানেই আমি মানিয়ে নেব।’ অনেকের মতোই একেবারে ছোটবেলা থেকে তিনি উপহাস এবং আপত্তিকর মন্তব্য সহ্য করার শেষ সীমায় চলে গিয়েছিলেন। মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে ছাড়েনি ডাক্তার, প্রতিবেশী এমনকী সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকেরাও। ‘ওর মাথাটা সোজা রাখতে কি কলারের দরকার পড়ে?’ বা ‘মনে হয় হোমিয়োপ্যাথি ওর কাজে আসবে’ এ হেন মন্তব্য সহ্য করা নিঃসন্দেহে কষ্টকর।
অনেক বছর আগে আমি সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশুদের একটি স্কুলে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতাম। একজন শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন যে কোনও তথাকথিত সুস্থ মানুষদের মতোই মালিনীদেরও কামনা-বাসনা রয়েছে। আর ঠিক এই দিকটিই স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে, যখন মালিনী দ্ব্যর্থহীন ভাবে লিখছেন তাঁর জীবনে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তার কথা। তিনি বলছেন, জুবিন নামের এক তরুণকে ঘিরে গড়ে ওঠা তাঁর আশার কাহিনি। জুবিনের বন্ধুত্ব তাঁর জীবনের সম্পদ ছিল সেই দিন পর্যন্ত যখন জুবিন ঘোষণা করেন তিনি সমকামী এবং তাঁর এক জন সঙ্গীও রয়েছে।
‘জুবিন যখন আমাকে ছেড়ে গেল, আমি কাঁদতে শুরু করলাম। আমি কাঁদছিলাম কেন?’... ‘নিশ্চয়ই আমি আরও রোম্যান্টিক একটা সম্পর্ক আশা করেছিলাম। আমার তখন ২১ বছর বয়স, এবং আমি পুরুষের মনোযোগ পেতে চাইতাম। আমার সব বান্ধবীর পুরুষসঙ্গী ছিল। আমিও চাইতাম আমার এক জন বয়ফ্রেন্ড হোক। কেন আমি কোনও সম্পর্কে জড়াতে পারব না? আমার মধ্যে কী এমন অস্বাভাবিকতা আছে? আমি আবেগ চেপে রাখতে পারতাম না। এই অক্ষম শরীর সত্ত্বেও যা কিছু স্বাভাবিক, সবের জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে উঠতাম।’ তাঁর এই নিঃসঙ্গতা বোধ পাঠকের চোখে জল নিয়ে আসে।
তবে একটা স্বাভাবিক প্রেম-জীবনের অপ্রাপ্তি মালিনীর মনোবলকে দমিয়ে দিতে পারেনি। তিনি পার্টিতে যান, দুর্দান্ত জায়গায় ছুটি কাটান এবং এই বিনোদন-ঠাসা জীবন ভোগ করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁর ‘বোল্ড ফ্রেঞ্চ হলিডে’-র বিবরণ পড়ে আপনি হাসতে বাধ্য হবেন। আসলে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, প্রতিবন্ধকতা পূর্ণ জীবন উপভোগ করার পথে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে না। এক এয়ারলাইন স্টুয়ার্ড অতি মাত্রায় পক্ষপাত দেখিয়ে চার বোতল শ্যাম্পেন পরিবেশন করে বসে এই দিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর ছুটি। আইফেল টাওয়ার, ল্যুভর, নোতরদাম এবং স্যেন-এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত সুন্দর ভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। লিখছেন, ‘আমার আত্মা শূন্যমার্গে বিচরণ করছিল। নিজেকে মনে হচ্ছিল খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়া একটা পাখির মতো।’
শিক্ষাক্ষেত্রে মালিনীর সাফল্য আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করে। তিনি দু’টি আন্তর্জাতিক মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেছিলেন একটি উইমেনস স্টাডিজ-এ, এবং অন্যটি লাইব্রেরি সায়েন্সেস অ্যান্ড ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে। অসাধারণ কৃতিত্ব। কিন্তু এখানেও তাঁকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে তাঁর সঙ্গে যা ঘটেছিল, তার বিবরণ আমাদের বিচলিত করে।
একটি ডাকাবুকো মেয়ে তাঁর টেবিলের কাছে এসে ঘোষণা করে, ‘আমি ম্যানেজমেন্টকে ডাকছি। ... একে এ ভাবে একলা ছেড়ে রাখা যায় না। আমি এ ধরনের মানসিক রোগীদের সঙ্গে কাজ করেছি। মারাত্মক কাণ্ড হতে পারে।’ এই কুৎসিততম পরিস্থিতি থেকে শেষপর্যন্ত তিনি রক্ষা পান, যখন মেয়েটি তাঁর ব্যাগ পরীক্ষা করে দেখে যে, তিনি এক জন লেখিকা।
মালিনী ক্ষিপ্ত না হয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন কেউ এক জন প্রতিবন্ধী মানুষের গায়ে মানসিক প্রতিবন্ধীর তকমা এঁটে দেন, সেটা সহ্য করা সত্যিই যন্ত্রণাদায়ক।
এই ঘটনার অকুস্থল লন্ডন, যেখানকার মানুষকে প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন বলে মনে করা হয়। মালিনী অনুভব করেছিলেন যে, ভারতের পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আরও বেশি খারাপ, এবং একে পাল্টাতেই হবে। তাই মালিনী মুম্বইয়ে একটি চাকরি গ্রহণ করেন এবং ভারতে ফিরে আসেন। তিনি একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। একে তিনি ডাকতেন ‘অ্যাডাপ্ট’ (ADAPT, অর্থাৎ, এবল ডিসএবলড অল পিপল টুগেদার)। এক সময় তাঁর সম্পর্কে এক জন মন্তব্য করেছিলেন ‘এদের তালাবন্দি করে রাখা উচিত’। সেই দীর্ঘ পথ তিনি পেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখনও অনেক কিছু করতে হবে, এবং তিনি নিরলস ভাবে তার জন্যই কাজ করে যাচ্ছেন।
মালিনী চিব-এর লেখা অসাধারণ বইটি অবশ্যই এক বার পড়ে দেখা উচিত। এটি কোনও পর্যবেক্ষক, শিক্ষক বা অভিভাবকের লেখা নয়। এটা এক জন প্রতিবন্ধী মানুষের বলা গল্প, জীবনের প্রতিরূপ। ফলে, বইটি থেকে আমরা এক বিরল অন্তর্দৃষ্টি লাভ করি, যা অন্য কোনও বইয়ের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। এই রকম বই আমাদের নিষ্পৃহ সমাজকে বোঝাতে পারবে যে, আমাদের মতোই প্রতিবন্ধীদের অধিকার আছে আরও সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখার, সম্মান এবং আশা নিয়ে বেঁচে থাকার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.