বঙ্গে বাণিজ্য
ভ্রমণ-কথা
ভিড় এড়াতে রেশন দোকানে ইট পেতে আসতে হয়। আর কুণ্ডু স্পেশালে বেড়াতে গেলে টোকেন নিতে হয়।
ভিড় মানে? অক্টোবরে পুজোর ছুটিতে রেলের টিকিট রিজার্ভেশন এখনও শুরু হয়নি। কিন্তু অক্টোবর থেকে নভেম্বর অবধি কুণ্ডু স্পেশালের যাবতীয় ট্যুর (দক্ষিণ ভারত, রাজস্থান, কেরল, উটি, মুম্বই, দ্বারকা, সিমলা, নৈনিতাল যেখানকার কথাই ভাবা যাক না কেন) ইতিমধ্যেই ‘ফুল বুক্ড’। প্রতিটি ট্রিপে ৪২ থেকে ৪৩ জন যাত্রী, তার বেশি হলেই ‘দুঃখিত। পরের বার চেষ্টা করুন।’
যাত্রীর ভিড় সামাল দিতেই টোকেন ব্যবস্থা। ‘‘বুকিং শুরুর দিন কী হয় জানেন? রানাঘাট, নৈহাটি, বর্ধমান...দূরদূরান্ত থেকে লোক ভোরবেলায় লাইন দেন। সকাল আটটার মধ্যে প্রায় দেড়শো লোকের লাইন। ফলে যিনি আগে আসছেন, টোকেন নেবেন। পরে এসে কেউ ঝামেলা বাধাতে পারবেন না,” বলছিলেন সংস্থার ম্যানেজার আশিস বিশ্বাস।
কিন্তু ভারতের পুরনো এই ভ্রমণ-সংস্থার জাদুকাঠিটি ঠিক কোথায়? কেন জুন-জুলাই মাসের মধ্যে তাঁদের যাবতীয় পুজো ট্যুর ‘বুকড’? ঐতিহাসিক আভিজাত্য নাকি বনেদিয়ানা?
দু’য়ের কোনওটিই নয়। কুণ্ডু স্পেশালের বটমলাইন অন্যত্র। ‘পার্সোনালাইজ্ড সার্ভিস’। আহারে-বিহারে প্রতিটি যাত্রীকে তোয়াজে রাখার মতো ব্যক্তিগত পরিষেবা। বছর পাঁচেক আগেও কুণ্ডু স্পেশালের একটি ‘অমরনাথ ট্যুর’ ছিল। এ বার সেই ট্যুর হচ্ছে না। কেন? এখন তো অমরনাথ যাত্রায় অনেক সুবিধা। পহলগাঁও থেকে লঙ্গর শুরু হয়ে যায়, চড়াইপথে যাত্রীদের নিখরচায় খিচুড়ি, ভাজাভুজি থেকে ফ্রুট স্যালাড সব কিছু খাওয়ানো হয়। কুণ্ডু স্পেশালের সৌমিত্র কুণ্ডুর বক্তব্য, “হ্যাঁ, লঙ্গরের খাবারই খাওয়াতে হয়। আমরা নিজেরা যেখানে বাজারহাট, রান্না করতে পারি না, যাত্রীদের নিই না। আগে ডাবল ক্লথ টেন্ট পেতাম। এখন এক পর্দা। আগে আমাদের লোক তাঁবুর মধ্যে ছোট তক্তাপোষ, লেপ, কম্বলের ব্যবস্থা করতে পারত। এখন সকলের জন্য ঢালাও খড়ের বিছানা। ফলে ট্যুরটা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।” বাঙালি ব্যবসাবিমুখ বলে দুর্নাম রয়েছে। কিন্তু ১০ কোটি টাকা ‘টার্ন ওভার’-এর কুণ্ডু স্পেশাল কেন ৮০ বছর ধরে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে, তার রহস্য ওখানেই। নিজেদের তৈরি ‘ব্যবসায়িক নিয়ম’ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি তাঁরা।
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
এই নিয়ম সৌমিত্রবাবুর ঠাকুর্দা, ‘কুণ্ডু স্পেশাল’-এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীপতিচরণ কুণ্ডুর তৈরি। সৌমিত্রবাবু বাজারহাট, রান্না করে যাত্রীদের খাওয়ানোর কথা বলছিলেন। ইতিহাস জানাচ্ছে, শ্রীপতিবাবু বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়েতে কেটারিং ইনস্পেক্টরের চাকরি করতেন। ১৯৩০ সালে তীর্থে বেরিয়েছিলেন। সেখানে থাকা-খাওয়ায় মানুষজনের হয়রানি দেখেই নতুন ব্যবসার আইডিয়াটা তাঁর মাথায় খেলে গেল।
শ্রীপতিচরণের স্বপ্ন সফল হল দুই বছর পরে। ১৯৩২ সালে। ২৫৬ জন যাত্রীকে নিয়ে তিনি তীর্থসফরে বেরোলেন। ভাড়া করা হল একটি ট্রেন, ২৫৬ জনের মধ্যে মাত্র এক জন সেই ট্রেনে উঠলেন কলকাতা থেকে। বাকি ২৫৫ জনের সকলে উঠবেন বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর থেকে। ৫৬ দিনের সফর, মাথাপিছু খরচ সেই আমলে ১৪৬ টাকা। সফরশেষে ট্রেন যখন হাওড়া ফিরল, সৌদামিনীদেবী নামে এক প্রৌঢ়া বিধবা শ্রীপতিবাবুর গলায় ঝুলিয়ে দিলেন সোনার মেডেল। তাঁর এবং আরও অনেকের তীর্থভ্রমণের স্বপ্ন সফল হয়েছে। ফলে শ্রীপতিবাবুর জন্য মাঝপথে যাত্রীরা নিজেরা চাঁদা তুলে মেডেলটি কিনে রেখেছিলেন।
ব্যবসা শুরুর গল্পটি এই রকমই। কিন্তু কুণ্ডু স্পেশালের এই কাহিনির আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের এক অধ্যায়। রেলগাড়ি এসে বাণিজ্যের পাশাপাশি আমাদের তীর্থভ্রমণ অনেক সহজ করে দেয়। উনিশ ও বিশ শতকের পঞ্জিকাতেই লেখা থাকত, রেলগাড়িতে কোন তীর্থে কী ভাবে যেতে হবে, সেখানে কোথায় ধর্মশালা আছে। একদা কৃষ্ণভামিনী দেবী স্বামীর সঙ্গে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। রেলগাড়িতে উঠে তাঁর প্রথম অনুভূতি, ‘আজ আমি প্রথম কলের গাড়িতে উঠিলাম।’ বাংলার নারী-স্বাধীনতার আখ্যানে সেই ভাবে কুণ্ডু স্পেশালও উজ্জ্বল পাদটীকা হয়ে থাকতে পারে। শ্রীপতিবাবু ব্যবসাটি শুরু করলেন বলেই বিধবা সৌদামিনী রেলগাড়ি চেপে বেরোলেন তীর্থসফরে।
আশি বছর পরেও কুণ্ডু স্পেশাল ধরে রেখেছে সৌদামিনীদেবীদের মতো বয়স্কদের ভ্রমণ-পরিষেবা দেওয়ার সেই ব্র্যান্ড ইকুইটি। “অবসরপ্রাপ্ত লোকেরাই আমাদের সঙ্গে বেশি যান। এবং বয়স্ক মহিলাদের অনুপাত আজও বেশি,” বলছিলেন সৌমিত্রবাবু। তিরিশের দশকে ভাড়া করা স্পেশাল ট্রেনে থাকতেন রান্নার ঠাকুর, পোশাক কাচাকুচির লোক, ক্ষৌরকার, চিকিৎসক, মায় চিঠি লেখা এবং পড়ার জন্য এক জন। সকলেই তখন চিঠিচাপাটি লিখতে পারতেন না যে! ট্রেন স্টেশনের এক ধারে সাইডিং-এ দাঁড়াত। এক দল গাইডের সঙ্গে বেড়াতে চলে যেতেন, সংস্থার লোকেরা বেরোতেন বাজার করতে। দুপুরে রান্নাখাওয়া সেরে ফের বিকেলে ঘুরতে যাওয়া। শোওয়ার ব্যবস্থা ট্রেনেই। বাঙ্ক এবং ফোল্ডিং খাটে তোষক পেতে ঢালাও বিছানা।
কিন্তু এ সবই গত শতকের গল্প। সময়ের তাগিদেই এখন এসে গিয়েছে অনেক পরিবর্তন। যেমন ট্রেন থেকে নেমে হোটেল। “যাত্রীরা আজকাল প্রাইভেসি পছন্দ করেন। আগে ধরুন, হোটেলে দেড় হাজার টাকায় যে ঘর পেতাম, এখন তার দাম আড়াই হাজার। ফলে খরচ বেড়েছে,” বলছিলেন সৌমিত্রবাবু। কিন্তু অন্য ঝামেলাও তো আছে। বাঙালি ট্যুরিস্ট তো নৈনিতালের পাহাড়ে লুচির সঙ্গে আলুচচ্চড়ি খাওয়ার আব্দার ধরেন, জয়সলমীরে পাতে মাছের টুকরো ছোট কেন তা নিয়ে হরেক প্রশ্ন তোলেন। “সেই সব সমস্যা তো আছে। হাতের পাঁচটা আঙুল তো সমান হয় না। আমাদের ট্যুর ম্যানেজারেরা অভিজ্ঞ, তাঁরা সামাল দিয়ে দেন। তবে এখনকার সমস্যা কোথায় জানেন? সবাইকে সমান ভাবে তুষ্ট করা যায় না। স্বামী ব্রেকফাস্টে লুচি-আলুর দম চান তো স্ত্রীর পছন্দ ব্রেড, বাটার। আর ছেলের পছন্দ পিৎজা,” বলছিলেন আশিসবাবু। আশি বছরের এই ভ্রমণসংস্থার অন্যতম সাফল্য শুধু বেড়ানোর নিখাদ বন্দোবস্তে নয়, যথাযথ ম্যান ম্যানেজমেন্টেও!
শ্রীপতিবাবুর আমলে ছিল বছরে এক বারই ট্যুর, এখন কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী বিভিন্ন দিকে সব মিলিয়ে বছরে ২৫০টি ট্যুর। হোটেলে পৌঁছে দ্রষ্টব্য স্থান দেখার জন্য এসি বাস অথবা ২/২ এসি গাড়ি। তীর্থস্থান ছাড়া লাদাখ, আন্দামানেও চালু হয়েছে সফর। এখন তো কলকাতা-গোয়া ফ্লাইটের থেকে কলকাতা-ব্যাঙ্কক কম খরচ। বিদেশভ্রমণও অনেক সহজ। সৌমিত্র কুণ্ডু হাসলেন, “দূর! ডোমেস্টিক ট্যুরেই আসল চ্যালেঞ্জ।” প্রতিটি ব্যবসার সাফল্যের পিছনে একটি ‘স্পেশালাইজেশন’ মন্ত্র থাকে। কুণ্ডু স্পেশালের সেই বিশেষ মন্ত্র: দেশের মধ্যে সফর!
আর শ্রীপতিবাবুর তৈরি করা সেই ‘পার্সোনালাইজড সার্ভিস?’ এখনও বিচ্যুত হননি কুণ্ডুরা। ক্ষৌরকার থাকেন না ঠিকই, কিন্তু এখনও প্রতিটি ট্রিপে যাত্রীদের সুবিধার্থে ম্যানেজার, সহকারী ম্যানেজার, পাচক, সহকারী পাচক ও চার জন সার্ভিস বয়ের টিম। তা হলে ভারতের প্রাচীনতম এই ভ্রমণসংস্থায় কর্মীর সংখ্যা কত? “অফিসে ২০ জন। আর আউটফিল্ডে ১২০,” জানালেন সৌমিত্রবাবু।
অন্য দিকে শ্রীপতিবাবুর কেটারিং-এর ঐতিহ্য মেনে আজও প্রতিটি ট্রিপে এঁচোড়, মোচা...ইলাহি আয়োজন। শেষ দিকে বিরিয়ানি, চিকেন চাঁপ সহযোগে এক দিন ‘গ্র্যান্ড ফিস্ট’। পাকস্থলী বেয়েই যাত্রীদের হৃদয়ে পৌঁছে যায় কুণ্ডু স্পেশাল। বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য মেনেই খেয়ে এবং
খাইয়ে তৃপ্তি।
আর ব্যবসার ঐতিহ্য? দেশভ্রমণ, বিনোদন, বিশ্রাম সব একাকার। “আমাদের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। কুণ্ডু স্পেশালের প্রতিদ্বন্দ্বী শুধুই কুণ্ডু স্পেশাল,” হাসলেন সৌমিত্র কুণ্ডু।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.