ব্যাগ গুছিয়ে...
চলো মন মধুবন
রে নিন একটি কবিতার পাতা উড়ে এসে পড়ল আপনারই সামনে। সে কবিতা জলের আখরে লেখা, বনের সবুজ মাখা, ভাষা তার স্তব্ধতার। অথবা ধরা যাক, একটা ছবি পড়ে আছে, জলরঙের। এক পাশে নদী মধুবনী। তার কটিদেশে পারাপার সাঁকো। নাথুয়া রোড খুঁটিমারি জঙ্গল চিরে গেছে দূরে। সেই পথে ছোটে ম্যাটাডর রাতভর। ভোরাই আলোয় হাঁটু-শাড়ি মেয়েটি জলে ‘জাখোই’ পেতে ধরছে রুপোলি ঝিলা, ইল মাছ। ভোর থেকে সকাল নদীর ফসল যাবে নাথুয়া বাজারে। দিনের প্রথম আলোয় উড়ে আসছে জংলি ময়না বোতলব্রাশের ফুলে। পাখি ফুল খায়, গান গায়। উত্তরে দেখা যায় সিলভার টোন গিরিশৃঙ্গ, আকাশ-মিনারে।
ওই কাঞ্চনজঙ্ঘা। দিগন্তের কুসুম আলোয় জাগছে গয়েরকাটা চা-বাগান। নির্জনতায় জড়িয়ে আছে মধুবনী কটেজ। তার প্রাঙ্গণে গাছের কেয়ারি, রেস্ট শেড, আর নদী মধুবনী। কটেজের নিশ্চুপ বারান্দায় বসে দেখেন সে ছবি। সকাল ৭টা। সাইরেন বাজল কাছে দূরে চা-বাগানে। বানারহাট, মোরাঘাট, নিউ-ডুয়ার্স বাতাসে ভাসিয়ে দেয় বার্তা কুলি লাইনে। ঘরে শিকলি তুলে কামিনের দল চলে ‘আড়াই পাত্তির’ জীবনে।
এখন মার্চের শেষ, বাগানে ফার্স্ট ফ্ল্যাশ প্লাক শুরু হল। দু’টি কচি পাতা, মাঝে খয়েরি কলি। বিঘা (অস্থায়ী) কামিনরা পিঠে ডোকো (ঝুড়ি) বেঁধে মেলা (হাজিরা) ধরতে চলে মিছিল করে। ওরা রজনী, আশ্রিতা, সোমারি, ক্রিস্টোফার, সিলভেস্টার। ‘বইদারি’ বাগানের হাজিরা দেখে। সেখানে এক দিন নাগা (গরহাজির) মানে মজুরিতে ফাঁক। সর্দার কাজের নজরদার। চা-বাগানের ভোঁ এ ভাবেই ওদের জীবনে বেঁধে দেয় ৬ দিনের কর্ম শৃঙ্খলা। শুধু একটা দিন মুক্তির আনন্দ। সে দিন মজুরির টাকায় ডবলু হাটে (বাগানের ছোট হাট) সাপ্তাহিক কেনাকাটা।
একটা দিন কাছাকাছি ঘুরে আসুন। নদীর সেতুটি পেরলেই খুঁটিমারি ফরেস্ট। অল্প এগিয়ে দেখছেন আরও এক নদীগরাতি। হলদিবাড়ি চা-বাগান ছেড়ে পিচ সড়কটিকে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে জঙ্গলের আঁধারে লুকিয়েছে গরাতি। এখানেই হাতিদের বাস। ধরলে মহা সর্বনাশের আশঙ্কা। বরং দ্রুত পায়ে ফিরে এসে বসুন কটেজে। জঙ্গলে আলতা রঙ ঢেলে দিয়ে আলো নিভে গেলে শোনা যায় ঘরে ফেরা ময়নার ডাক। চন্দনার ঝাঁক উড়ে যায়। কয়েকটা মদনটাক বাগানে ভেসে ভেসে গেল নিরুদ্দেশে। বাগিচার কেয়ারি ধরে লেবার ব্যারাকে ফেরে বুড়ো সর্দার।
তার পরে ঘটে যায় চাঁদের হাজিরা। নদী জেগেছে জ্যোৎস্নার জোয়ারে। মিহিন স্তব্ধতায় জড়ান মধুবনী কটেজ। আপনার খোয়ারি ভেঙে আচমকাই বসেছে এসে জঞ্জালু রায়, ঝিরকা বার্লারা। ওরা কেউ কটেজের রাতের প্রহরী, কেউ বা মালী। এ মুলুকের নিউজ এজেন্টও বলতে পারেন। বার্লা বলেছে, মধুবনী নদীটির ভরপেট মাছ ঝিলা, ইন, দাঁড়কা। রাঙ্গাতির মাছ দারাঙ্গি খুব স্বাদু স্যার। কেউ বলে আংরাভাসার রেড ক্র্যাব কারি ভাদোই ভাতের পাতে দুর্লভ ম্যাচ। ভাদোই কি? খাটো মিঠা খয়েরি চাল। আরও জানা, বিউগল ঝোরার চিংড়ি-কথা। ডুডুয়ার রাঘব বোয়াল। এমনকী নুনিয়ার সরু ভাত আর কুর্সা (মাছ) কারি, ওফ্! এ সবের স্বাদ চান তো দুরামারির হাটে যান।
দুরামারির শনির হাট বহ্বাড়ম্বর। এমন নিরীহ নির্জনে গ্রামীণ হাট যেন দূর অতীতে ফেলে আসা। চাঁদের আলোয় মুক্ত হাটে জটাধারী কন্দ আলু, তন্বী শ্যামা বেগুন, স্কোয়াশ, বোম্বাই সুপুরি, চ্যাংড়াবান্দার তামাক পাতা, আরও কত। মাছপট্টি ছোট হলেও কৃপণ নয়। দুপুরে যে দারাঙ্গি ছিল নদীতে বিকেলে আপনার হাতে। শালুক পাতায় ভাগা (২৫০ গ্রাম) ৩০ টাকা। তা হলে কেজি কত দাঁড়ালো? মেছো মানুষটি সরল হেসে বলেন, এই তো বিপদে ফেললেন। হুজুরই কষে দেন। আপনি বিলক্ষণ ভাবছেন, খাঁটি ধাতুর মুদ্রাগুলি বাতিল হয়নি এখনও। অপর দিকে ঢালাও নুনিয়া চাল, স্বর্ণলালট, পাইজাম। আরও কত বে-আন্দাজি পণ্য। একটা সন্ধ্যা হাটে হেঁটে কিনেকেটে জনতার দরবারে বসে ওপেন-হার্ট হৃদ্যতায় ভিতরটা রি-চার্জ করে ফেরেন ঘরে।
মধুবনী থেকে হাল্কা দূরত্বে বেশ ক’টি লাফা-যাত্রা হতে পারে। প্যাকেজ একলাটাগুড়ি, গরুমারা, রামসাই, নেওড়া ক্যাম্প। প্যাকেজ দুইচিলাপাতা, জলদাপাড়া, খয়েরবাড়ি, কুঞ্জনগর। প্যাকেজ তিনসামসি ভুটান।
বানারহাট রোড ধরে ছুটে চলে গাড়ি। পথের দু’ধারে গামার, অর্জুনের সারি। আর প্রাণবন্ত চা-কেয়ারি পলাশবাড়ি, আমবাড়ি। মাঝে পড়ছে অভিশপ্ত কাঁঠালগুড়ি। তার ছায়া-গাছগুলি শ্রমিকের ক্ষুধায় পুড়ে ছাই। তার পরে চামুর্চি, ভারতের শেষ ভূখণ্ড। ছোট ছোট তক্তা ঘরের দোকান, বাজার, বসত। নেপালি ভুটিয়ার জীবন চলে মন্দ চালে। সামনেই সামসির (ভুটান) ‘ওয়েলকাম’ গেট। সময়ের মুহূর্তে বদলে গেল জীবন, জগত।
এ দেশে প্রতি পদক্ষেপে চড়াই-উতরাই। তবুও মানুষের বাস তৃপ্তির ভিতর। পাহাড়ি গুম্ফা, ধর্মীয় লামা, স্কুল-ছুট শিশুদের ঢাল ধরে নামা, মাথার উপরে গিরিমালা। নীচে পাতাল পথে পাইনের ফাঁকে বাঁকে মুছে গেল যে পথ, সেটা ধরেই জনপদ সিবসু। সামসি জংখায় (জেলা) এক মুঠো জীবন। এ দেশে চিঠিঘর আছে পত্রালাপ নেই। আদালত আছে ফরিয়াদ নেই। পাহাড়ি পাকদণ্ডীতে গাড়ি ছোটে, ওঠে ট্রাফিকের রক্তচক্ষু মানা।
ছুটিতে লেগেছে টান। আকাশে জেগেছে চাঁদ। নদীর তরঙ্গে বাজে ছমছম মৃদঙ্গ। খঁটিমারি বনের পথে চাঁদের সোনালি সাপ। তার গায়ে কালো ছায়া দাগ। আলোর ভৃঙ্গারে ভেজে লসুনি, লাটোর, চাপ, চিকরাশি, শাল। রিসর্ট প্রাঙ্গণে লাগুক চা-বাগিচার নাচ। স্থানীয় লোকদল গেয়ে দিক ফোক। সঙ্গে থাক আরও কিছু তামাশা। সফরের এই শেষ রাত। তার পর সরাসরি শহর সংগ্রামে। তখনও সঙ্গে থাক স্মৃতির মধুবনী।

কী ভাবে যাবেন
শিয়ালদহ থেকে কাঞ্চনকন্যায় পরদিন সকালে দলগাঁও নেমে গাড়িতে মধুবনী।
কোথায় থাকবেন
স্ব-নির্ভর প্রকল্পের সচ্ছল কটেজ আছে। জল, আলো আপাতত জেনারেটরে।
সঙ্গে রাখুন
টর্চ ও মশার ক্রিম।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.