|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
দ্বৈতের সংঘাতেই নারী খুঁজে পায় তাঁর আত্মপরিচয় |
সম্প্রতি উইভার্স স্টুডিও গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল রোমি মজুমদারের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
রোমি মজুমদারের দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি উইভার্স স্টুডিও গ্যালারিতে। তিনি কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের স্নাতক। পাশ করেছিলেন ১৯৯১তে। বিষয় ছিল টেক্সটাইল ডিজাইন। পরে আমদাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজাইন থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। বলা যেতে পারে ‘ডিজাইন’ তাঁর নিবিষ্ট চর্চা ও গবেষণার বিষয়। তাঁর ছবিও গড়ে উঠেছে এই ডিজাইন বা অলঙ্করণের ভিত্তি থেকে। চিত্রের সঙ্গে অলঙ্করণ সব সময়ই নিবিড় ভাবে যুক্ত। অলঙ্করণ ছাড়া কোনও ছবি হয় না। কোথাও কোথাও চিত্রক্ষেত্রের বিন্যাসের মধ্যে অলঙ্করণ থাকে প্রচ্ছন্ন ভাবে। কোথাও বা অলঙ্করণের বৈশিষ্ট্যগুলি স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয়। কোনও কোনও লৌকিক পটচিত্রে, যেমন যামিনী রায়ের ছবিতেও অলঙ্করণের সুষমাময় ছন্দ অনেক সময়ই প্রাধান্য পেয়েছে।
রোমির ছবিতে অলঙ্করণ যে প্রাধান্য পেয়েছে তার একটা কারণ তাঁর ছবি গড়ে উঠেছে লৌকিক বা বাংলার পরম্পরাগত শিল্পের ভিত্তি থেকে। বয়নশিল্প পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর অধ্যয়ন ও ভাবনা হয়তো এই ক্ষেত্রে তাঁকে প্রভাবিত করেছে। কেননা টেক্সটাইল ডিজাইনের সঙ্গে পরম্পরাগত শিল্পের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকে সব সময়ই। পরম্পরার সঙ্গে সংযোগের সূত্রেই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উন্মীলিত হয়েছে তাঁর ছবিতে। তা হল দেশীয় আত্মপরিচয়।
জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা নিয়ে বিতর্ক আমাদের চিত্রকলার আধুনিকতার সঙ্গে দীর্ঘ দিন থেকে জড়িয়ে আছে। আজকের বিশ্বায়িত পরিস্থিতিতে জাতীয়তাকে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হয়। কিন্তু নিজস্ব আত্মপরিচয় বা ‘আইডেন্টিটি’ গড়ে তোলার প্রকল্প আধুনিকতার সূচনা পর্ব থেকেই চর্চিত হয়ে আসছে। আজও সেটা অবান্তর হয়ে যায়নি। দু’ভাবে কাজ করে এই প্রকল্প। পরিপূর্ণ ভাবে ঐতিহ্যগত আঙ্গিক নিয়েই কাজ করে আসছেন কেউ কেউ। নব্য-ভারতীয় ঘরানায় অবনীন্দ্রনাথ বা নন্দলালের নিমগ্ন চর্চার মধ্য দিয়ে যে প্রকল্প শুরু হয়েছিল, সেই ধারা আজও প্রবহমান। হাকু শা, মাধবী পারেখ বা জয়শ্রী বর্মনের মতো ১৯৬০, ১৯৭০ বা ৮০-র দশকের অনেক শিল্পী এখনও নিবিষ্ট ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের এই প্রয়াসের মধ্য দিয়েই আমাদের আধুনিক চিত্রকলা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ সম্মানে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। |
|
শিল্পী: রোমি মজুমদার |
এই যে দেশীয় পরম্পরা থেকে তুলে আনা সারল্যময় রূপভঙ্গি এবং তাকে আধুনিক মননে ঋদ্ধ করে তোলা এখানেই শিল্পী স্বকীয় ভাবনার পরিচয় দেন। গড়ে তোলেন নিজস্ব আঙ্গিক। এই রূপভঙ্গির মধ্য দিয়ে তিনি মূলত এক মানবী চেতনাকে অভিব্যক্ত করতে চান। মানবীসত্তার ভিতর তিনি দেখতে পান দ্বৈতবোধের সহাবস্থান। এই দ্বৈতের সংঘাত থেকে নারী তাঁর নিজস্ব আত্মপরিচয় সন্ধান করে। শিল্পী বিভিন্ন ছবিতে এই সন্ধানকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন। এই দ্বৈতকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। তাঁর নিজস্ব মানবীসত্তার প্রতিফলন ঘটেছে এখানে। অলঙ্করণময় সুস্মিত লৌকিক রূপায়ণের ভিতর এই যে আধুনিকতার অন্তর্নিহিত দ্বৈতকে মিলিয়ে দেওয়া, এখানেই তাঁর ছবি সাম্প্রতিকের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে।
তাঁর ছবিতে যেমন রৈখিক অলঙ্করণ থাকে, তেমনই তিনি অলঙ্করণ করেন লিখনশৈলী বা ক্যালিগ্রাফির মধ্য দিয়েও। অনেক ছবিতেই প্রতিমাকল্প বিন্যাসের মধ্যে তিনি ইংরেজি অক্ষরে তাঁর নিজস্ব ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। চিত্রীয় প্রতিমার প্রকাশ-ক্ষমতাকে প্রসারিত করেছেন এ ভাবে। এ রকম একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে উপস্থাপিত হয়েছে একটি মেয়ের মুখ। তাকে ঘিরে চিত্রক্ষেত্রের বিভিন্ন অংশে অলঙ্করণের ভঙ্গিতে গাঁথা হয়েছে শব্দমালা। লেখা হয়েছে ‘আমিই প্রথম এবং শেষ। আমিই সম্মানিত এবং অবজ্ঞাত। আমিই মা এবং কন্যা’ ইত্যাদি। নারীর দ্বৈতসত্তাকে পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন এ ভাবে। আর একটি ছবিতে নারীর বুকের কাছে প্রস্ফুটিত পদ্ম। প্রেক্ষাপটেও জলজ পদ্মের বিন্যাস। লিখেছেন শিল্পী ‘সে আমার কাছে সব সময়ই একজন মানবী। হাসতে হাসতে হত্যা করতে পারে সে। চোখ দিয়ে সে আহত করতে পারে।’ এ রকম দ্বৈতের ভিতর থেকেই শিল্পী রচনা করতে চেয়েছেন মানবীর সামগ্রিক হয়ে ওঠার আলেখ্য। মানবী মুখের সমাহারের একটি প্রতিমাকল্পে লিখেছেন ‘পরিশেষে সবটাই এক জন মহত্তর মানুষ হওয়ার প্রকল্প’।
মোট ৪৬টি ছবির ভিতর অনেক ছবিতে তিনি যেমন লৌকিক পুরাণকল্প থেকে বিষয় তুলে এনেছেন, তেমন অনেক ছবিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন অভিব্যক্তিবাদী গাঠনিক রূপকল্প নিয়েও। বয়নশিল্পের বিমূর্ত অলঙ্করণ নিয়েও গড়ে উঠেছে কয়েকটি ছবি। রূপের এ রকম বহুমুখী প্রকাশে প্রদর্শনীটি যথেষ্ট উজ্জ্বল। |
|
|
|
|
|